বুন্দেলখণ্ডের মেয়ে রোহিণী। তাকে পৈশাচিকভাবে আগুনে পুড়িয়ে মারা হয়। মেয়েটার অপরাধ ছিলো খুবই সামান্য। তার বিয়ের প্রস্তাব এসেছিলো প্রতিবেশী এক পরিবারের কাছ থেকে। অন্য জায়গা বিয়ে ঠিক করা ছিলো বলে তার বাবা-মা সেই প্রস্তাবকে ফিরিয়ে দেয়। জানতো না যে তাদের এই না বলার প্রায়শ্চিত্ত রোহিণীকে দিতে হবে নিজের জীবন দিয়ে।
রোহিণীর বাবা-মায়ের প্রত্যাখ্যানকে নিজের জাত-পাত, পরিবার এবং বংশের উপরে অপমান বলে মনে করে নেয় ছেলেটা। রোহিণীকে অনুসরণ করা শুরু করে। একদিন যখন বাড়িতে রোহিণীর বাবা-মা কেউ নেই, জমিতে কাজ করতে গিয়েছে, সেই সময়ে আরো তিনজন সঙ্গী নিয়ে রোহিণীদের বাড়িতে আসে ছেলেটা। চারজনে মিলে বারান্দাতে ধর্ষণ করে তারা রোহিণীকে। শুধু এইটুকুতেই থামে না তারা। ধর্ষণ শেষে একটা টুলের উপর রোহিণীকে বসিয়ে তার গায়ে আগুন ধরিয়ে দেয় তারা।
রোহিণীর শরীরের পুরো অংশটাই পুড়ে গিয়েছিলো প্রায়। প্রাণটা অবশিষ্ট ছিলো শুধুমাত্র ধর্ষক এবং খুনিদের নাম বলার জন্য, মৃত্যুর আগে চার দুর্বৃত্তের নাম বলে যায় রোহিণী। শুধু নামই বলে না, লিখিত বক্তব্যে স্বাক্ষরও করে যায়।
রোহিণীর মৃত্যুশয্যায় দেওয়া এই বক্তব্যকে কোর্টে অসার প্রমাণ করে ফেলে আসামী পক্ষের উকিল। একশভাগ পুড়ে যাওয়া রোহিণী বক্তব্য দেবার মতো শারীরিক এবং মানসিক সুস্থতায় ছিলো না, এটাকে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলে আসামী পক্ষ। ডেলিরিয়াম অবস্থায় ছিলো রোহিণী, কাজেই তার বক্তব্যকে শতভাগ সত্য হিসাবে নেওয়া যায় না। অন্য কোনো সাক্ষী না থাকায়, রোহিণীর বক্তব্যই ছিলো এই মামলার মূল শক্তির জায়গা। ফলশ্রুতিতে, তাসের ঘরের মতো ভেঙে যায় মামলাটা। আসামিরা মাথা উঁচু করে বের হয়ে যায় আদালত থেকে।
শুধু রোহিণীর ক্ষেত্রেই নয়, ধর্ষণের মামলা থেকে আরো অসংখ্য ধর্ষকই এভাবে বের হয়ে যায় ভারতে। ধর্ষণের বিচার ঠিকভাবে হয় না বলে, সম্ভাব্য অন্য ধর্ষকেরাও সাহস এবং উৎসাহ পায় ধর্ষণ করার। এটাই যে একমাত্র কারণ ধর্ষণের, তা নয়। এর সাথে আরো বেশ কিছু কারণ জড়িত রয়েছে ক্রমবর্ধমান ধর্ষণের ক্ষেত্রে।
রোহিণীর শরীরের পুরো অংশটাই পুড়ে গিয়েছিলো প্রায়। প্রাণটা অবশিষ্ট ছিলো শুধুমাত্র ধর্ষক এবং খুনিদের নাম বলার জন্য, মৃত্যুর আগে চার দুর্বৃত্তের নাম বলে যায় রোহিণী। শুধু নামই বলে না, লিখিত বক্তব্যে স্বাক্ষরও করে যায়।
রোহিণীর মৃত্যুশয্যায় দেওয়া এই বক্তব্যকে কোর্টে অসার প্রমাণ করে ফেলে আসামী পক্ষের উকিল। একশভাগ পুড়ে যাওয়া রোহিণী বক্তব্য দেবার মতো শারীরিক এবং মানসিক সুস্থতায় ছিলো না, এটাকে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলে আসামী পক্ষ। ডেলিরিয়াম অবস্থায় ছিলো রোহিণী, কাজেই তার বক্তব্যকে শতভাগ সত্য হিসাবে নেওয়া যায় না। অন্য কোনো সাক্ষী না থাকায়, রোহিণীর বক্তব্যই ছিলো এই মামলার মূল শক্তির জায়গা। ফলশ্রুতিতে, তাসের ঘরের মতো ভেঙে যায় মামলাটা। আসামিরা মাথা উঁচু করে বের হয়ে যায় আদালত থেকে।
শুধু রোহিণীর ক্ষেত্রেই নয়, ধর্ষণের মামলা থেকে আরো অসংখ্য ধর্ষকই এভাবে বের হয়ে যায় ভারতে। ধর্ষণের বিচার ঠিকভাবে হয় না বলে, সম্ভাব্য অন্য ধর্ষকেরাও সাহস এবং উৎসাহ পায় ধর্ষণ করার। এটাই যে একমাত্র কারণ ধর্ষণের, তা নয়। এর সাথে আরো বেশ কিছু কারণ জড়িত রয়েছে ক্রমবর্ধমান ধর্ষণের ক্ষেত্রে।
১৯৭১ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত ভারতে ধর্ষণের হার বেড়েছে ৯০২ শতাংশ। এটা একটা অবিশ্বাস্য সংখ্যা। ধর্ষণের হার যে গতিতে আকাশ ছুঁয়েছে, আর কোনো অপরাধের বৃদ্ধি এই রকম ঊর্ধ্ব লম্ফন প্রক্রিয়াতে হয় নি। ১৯৭৩ সালে যেখানে ধর্ষণের মামলার সংখ্যা ছিলো ২৯১৯, যেখানে ২০১১ সালে এই সংখ্যাটা ছিলো ২৪,২০৬। শুধু মামলাই যে বেড়েছে, তাই নয়, অপরাধ প্রমাণিত হয় নি, এই কারণে মুক্তিপ্রাপ্তের সংখ্যাও বেড়ে গিয়েছে ১৮ শতাংশ।
এই বিপুল পরিমাণ ধর্ষণ নিয়ে মানুষের বিকার খুবই কম ছিলো। জনসচেতনতা সেভাবে গড়ে ওঠেনি ধর্ষণের বিরুদ্ধে, যদিও এটাই ছিলো ভারতের সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল অপরাধ। ২০১২ সালের ডিসেম্বর মাসের ১৬ তারিখে পরিস্থিতি পালটে যায়।
এই দিনে, দিল্লীতে একজন মেডিক্যালে পড়া তরুণী গণ ধর্ষণের শিকার হয়। তার পুরুষ সঙ্গীকে বেঁধে রেখে মেয়েটার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে একদল হিংস্র হায়েনা। পরে দুজনকেই লোহার রড দিয়ে পিটিয়ে রক্তাক্ত ক্ষত-বিক্ষত এবং বিধ্বস্ত অবস্থায় রাস্তায় ফেলে রেখে চলে যাওয়া হয়। এই ঘটনা ভারতে বিপুল আলোড়ন তোলে। ধর্ষণের মতো একটা নিকৃষ্ট অপরাধের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে ওঠে, সচেতনতা তৈরি হয় শিক্ষিত শ্রেণির মাঝে। মানুষজন রাস্তায় নেমে আসে। এর প্রতিবাদ জানায়। একই সাথে ভারতের নারীদের নিরাপত্তার বিষয়টাও দাবী হিসাবে উঠে আসে। গড়ে ওঠে ভার্মা কমিটি। ধর্ষণের কারণ এবং প্রতিকারের উপায় হিসাবে বিস্তারিত একটা রিপোর্ট তৈরি করা হয় সরকারের জন্য।
ভারতের ধর্ষণ সংস্কৃতিকে বোঝার জন্য এগিয়ে আসেন সাংবাদিক প্রিয়াঙ্কা দুবে। ছয় বছর ধরে তিনি অসংখ্য ধর্ষণ ঘটনার শিকার হওয়া নারীদের এবং তাদের পরিবারের সাথে কথা বলেন। এর জন্য সারা ভারত চষে বেড়াতে হয় তাকে। সেইসব সব ধর্ষণ ঘটনাকে ব্যবচ্ছেদের মাধ্যমে ভারতে কতো বিচিত্র কারণে ধর্ষণ হয়, সেই চিত্রটা তিনি তুলে ধরেন সবার সামনে। ধর্ষণ শুধুমাত্র দৈহিক চাহিদার প্রয়োজনেই হয় না, বরং এর পিছনে রয়েছে অত্যাচারের ভিন্ন কারণসমূহ। জেন্ডার রিলেটেড অপরাধের নানা ডাইমেনশন রয়েছে, যদিও এদের সবারই মূল গ্রন্থিত রয়েছে পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার মধ্যে।
নারীদের উপর ঘটা তেরোটা নির্মম যৌন নির্যাতনের কাহিনির সংকলন নিয়ে একটা বই প্রকাশ করেন তিনি। বইটার নাম হচ্ছে 'নো নেশন ফর উইমেন'। নামটা শুনলেই তসলিমা নাসরিনের লেখা একটা বইয়ের কথা মনে পড়ে যায়। তাঁর বইয়ের নাম ছিলো 'নারীর কোনো দেশ নেই'। প্রিয়াঙ্কা কিংবা তসলিমার বই দুটো পড়লে সত্যি সত্যিই মনে হবে নারীর আসলে কোনো দেশ নেই, পুরুষের হাতে নির্যাতিত হবার জন্যই জন্ম হয়েছে তার।
প্রিয়াঙ্কা দেখিয়েছেন, কাম নয় ক্ষমতাই বরং ধর্ষণের জন্য মূল দায়ী। তাঁর বইয়ের প্রতিটা চ্যাপ্টারের তিনি একেক ধরনের ধর্ষণের কথা লিখেছেন, যেটা সেই এলাকায় প্রচলিত। সেই ধর্ষণের পিছনের সেখানকার মানুষের সুনির্দিষ্ট মনস্তত্ত্বও তুলে ধরেছেন তিনি। কোথাও ধর্ষণ হচ্ছে প্রতিশোধের অস্ত্র, কোথাও ধর্ষণ হচ্ছে অরক্ষিত ছোট বাচ্চাদের উপরে, কোথাও বা সেই ধর্ষণ রূপ নিচ্ছে রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রয়োগের অংশ হিসাবে, কোথাও নারীকে বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে দাস হিসাবে, কখনো কখনো ক্ষমতার দাপটে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীও ধর্ষণে জড়িয়ে পড়ছে।
'নো নেশন ফর উইমেন' সহজ এবং সরল ভাষায় লেখা বই। ধর্ষণের ঘটনাগুলোর বিস্তারিত বর্ণনা প্রিয়াঙ্কা দিলেও তিনি সেগুলোর খুব গভীরে ঢুকে এর দর্শন নিয়ে ঘাটাঘাটি প্রিয়াঙ্কা করেন নি। করার অবশ্য প্রয়োজনও ছিলো না। তিনি ভারতের ধর্ষণ সংস্কৃতিকে তুলে ধরতে চেয়েছেন সবার সামনে। কারণ, এই জিনিসটা যে আছে সমাজে, সেটা সমাজ স্বীকারই করতে চায় না। ফলে, সহজবোধ্য ভাষাতেই মানুষের মস্তিষ্কে এই বার্তাটা পৌঁছে দেবার প্রয়োজন ছিলো। তবে, সহজ ভাষায় লেখা হলেও, প্রিয়াঙ্কার বইটা পড়া সহজ কোনো কাজ নয়। বইটা পড়ার সময়ে বিষণ্ণতায় আক্রান্ত না হয়ে পারা যায় না। একেকটা চ্যাপ্টার যেনো নির্মমতার ভয়ংকর সাক্ষ্য। শেষ হবার পরেও সেই বিষণ্ণতা গ্রাস করে রাখে। শুধুমাত্র নারী হবার অপরাধে নারীদের কিসের মধ্য দিয়ে যেতে হয়, সেটা ভাবলে শিরদাঁড়া বেয়ে ভয়ের একটা ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে যেতে থাকে।
বইটা পড়া কতোখানি শক্ত সেটা একজন পাঠক লিখেছেন এভাবে, “I thought I was strong and mature enough to handle the distress. I always think that, and then I fall on my face. Because every time I think I am capable enough, inhumanity hits me in the face really hard. I shatter from inside, I cry, I almost scream, I hold my heart, I close the book, I want to throw it away in the deep seas.”
আমাদের বাংলাদেশও এখন পরিণত হয়েছে ধর্ষকদের অভয়ারণ্যে। এইতো সেদিন একটা ভিডিও প্রকাশিত হয়েছে সামাজিক মাধ্যমে। যেখানে দেখা গিয়েছে দলবদ্ধভাবে একজন নারীকে ধর্ষণ এবং নির্যাতন করছে চারজন পুরুষ। নির্যাতনের শিকার সেই নারী আকাশ-বাতাস ফাটিয়ে চিৎকার করছে, পায়ে ধরে ক্ষমা চাইছে নির্যাতকদের কাছে। এই ভিডিও শেষ না হতেই বের হয়ে এসেছে আরেক ভিডিও। সেখানে দেখা গেছে ধর্ষণে বাধা দিচ্ছে বলে মেয়েটার গলায় ছুরি চালিয়ে দিয়েছে ধর্ষকেরা। ক্রমবর্ধমান ধর্ষণ এবং নারীর প্রতি সহিংসতার প্রতিবাদে বাংলাদেশেও মেয়েরা নেমে এসেছে রাস্তায়। এই দেশেও মেয়েরা নিরাপদ নয়। এখানেও মেয়েরা ধর্ষণের শিকার হয় নানা কারণে। প্রেম প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলে ধর্ষণ করা হয়, অরক্ষিত অবস্থায় একা পেলে নারীকে ধর্ষণ করে পশুরা, রাজনৈতিক ক্ষমতার দম্ভে করা হয় ধর্ষণ, কখনো শুধুমাত্র ভিন্ন জাতিসত্তা হবার কারণেও পাহাড়ে ধর্ষণের শিকার হয় নারীরা। রক্ষক সেজে পুলিশও ভক্ষক হয়ে ওঠে এই সমাজে। আমাদেরও রয়েছে ইয়াসমিন, তনু, পূজাদের ইতিহাস।
এই বিপুল পরিমাণ ধর্ষণ নিয়ে মানুষের বিকার খুবই কম ছিলো। জনসচেতনতা সেভাবে গড়ে ওঠেনি ধর্ষণের বিরুদ্ধে, যদিও এটাই ছিলো ভারতের সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল অপরাধ। ২০১২ সালের ডিসেম্বর মাসের ১৬ তারিখে পরিস্থিতি পালটে যায়।
এই দিনে, দিল্লীতে একজন মেডিক্যালে পড়া তরুণী গণ ধর্ষণের শিকার হয়। তার পুরুষ সঙ্গীকে বেঁধে রেখে মেয়েটার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে একদল হিংস্র হায়েনা। পরে দুজনকেই লোহার রড দিয়ে পিটিয়ে রক্তাক্ত ক্ষত-বিক্ষত এবং বিধ্বস্ত অবস্থায় রাস্তায় ফেলে রেখে চলে যাওয়া হয়। এই ঘটনা ভারতে বিপুল আলোড়ন তোলে। ধর্ষণের মতো একটা নিকৃষ্ট অপরাধের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে ওঠে, সচেতনতা তৈরি হয় শিক্ষিত শ্রেণির মাঝে। মানুষজন রাস্তায় নেমে আসে। এর প্রতিবাদ জানায়। একই সাথে ভারতের নারীদের নিরাপত্তার বিষয়টাও দাবী হিসাবে উঠে আসে। গড়ে ওঠে ভার্মা কমিটি। ধর্ষণের কারণ এবং প্রতিকারের উপায় হিসাবে বিস্তারিত একটা রিপোর্ট তৈরি করা হয় সরকারের জন্য।
ভারতের ধর্ষণ সংস্কৃতিকে বোঝার জন্য এগিয়ে আসেন সাংবাদিক প্রিয়াঙ্কা দুবে। ছয় বছর ধরে তিনি অসংখ্য ধর্ষণ ঘটনার শিকার হওয়া নারীদের এবং তাদের পরিবারের সাথে কথা বলেন। এর জন্য সারা ভারত চষে বেড়াতে হয় তাকে। সেইসব সব ধর্ষণ ঘটনাকে ব্যবচ্ছেদের মাধ্যমে ভারতে কতো বিচিত্র কারণে ধর্ষণ হয়, সেই চিত্রটা তিনি তুলে ধরেন সবার সামনে। ধর্ষণ শুধুমাত্র দৈহিক চাহিদার প্রয়োজনেই হয় না, বরং এর পিছনে রয়েছে অত্যাচারের ভিন্ন কারণসমূহ। জেন্ডার রিলেটেড অপরাধের নানা ডাইমেনশন রয়েছে, যদিও এদের সবারই মূল গ্রন্থিত রয়েছে পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার মধ্যে।
নারীদের উপর ঘটা তেরোটা নির্মম যৌন নির্যাতনের কাহিনির সংকলন নিয়ে একটা বই প্রকাশ করেন তিনি। বইটার নাম হচ্ছে 'নো নেশন ফর উইমেন'। নামটা শুনলেই তসলিমা নাসরিনের লেখা একটা বইয়ের কথা মনে পড়ে যায়। তাঁর বইয়ের নাম ছিলো 'নারীর কোনো দেশ নেই'। প্রিয়াঙ্কা কিংবা তসলিমার বই দুটো পড়লে সত্যি সত্যিই মনে হবে নারীর আসলে কোনো দেশ নেই, পুরুষের হাতে নির্যাতিত হবার জন্যই জন্ম হয়েছে তার।
প্রিয়াঙ্কা দেখিয়েছেন, কাম নয় ক্ষমতাই বরং ধর্ষণের জন্য মূল দায়ী। তাঁর বইয়ের প্রতিটা চ্যাপ্টারের তিনি একেক ধরনের ধর্ষণের কথা লিখেছেন, যেটা সেই এলাকায় প্রচলিত। সেই ধর্ষণের পিছনের সেখানকার মানুষের সুনির্দিষ্ট মনস্তত্ত্বও তুলে ধরেছেন তিনি। কোথাও ধর্ষণ হচ্ছে প্রতিশোধের অস্ত্র, কোথাও ধর্ষণ হচ্ছে অরক্ষিত ছোট বাচ্চাদের উপরে, কোথাও বা সেই ধর্ষণ রূপ নিচ্ছে রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রয়োগের অংশ হিসাবে, কোথাও নারীকে বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে দাস হিসাবে, কখনো কখনো ক্ষমতার দাপটে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীও ধর্ষণে জড়িয়ে পড়ছে।
'নো নেশন ফর উইমেন' সহজ এবং সরল ভাষায় লেখা বই। ধর্ষণের ঘটনাগুলোর বিস্তারিত বর্ণনা প্রিয়াঙ্কা দিলেও তিনি সেগুলোর খুব গভীরে ঢুকে এর দর্শন নিয়ে ঘাটাঘাটি প্রিয়াঙ্কা করেন নি। করার অবশ্য প্রয়োজনও ছিলো না। তিনি ভারতের ধর্ষণ সংস্কৃতিকে তুলে ধরতে চেয়েছেন সবার সামনে। কারণ, এই জিনিসটা যে আছে সমাজে, সেটা সমাজ স্বীকারই করতে চায় না। ফলে, সহজবোধ্য ভাষাতেই মানুষের মস্তিষ্কে এই বার্তাটা পৌঁছে দেবার প্রয়োজন ছিলো। তবে, সহজ ভাষায় লেখা হলেও, প্রিয়াঙ্কার বইটা পড়া সহজ কোনো কাজ নয়। বইটা পড়ার সময়ে বিষণ্ণতায় আক্রান্ত না হয়ে পারা যায় না। একেকটা চ্যাপ্টার যেনো নির্মমতার ভয়ংকর সাক্ষ্য। শেষ হবার পরেও সেই বিষণ্ণতা গ্রাস করে রাখে। শুধুমাত্র নারী হবার অপরাধে নারীদের কিসের মধ্য দিয়ে যেতে হয়, সেটা ভাবলে শিরদাঁড়া বেয়ে ভয়ের একটা ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে যেতে থাকে।
বইটা পড়া কতোখানি শক্ত সেটা একজন পাঠক লিখেছেন এভাবে, “I thought I was strong and mature enough to handle the distress. I always think that, and then I fall on my face. Because every time I think I am capable enough, inhumanity hits me in the face really hard. I shatter from inside, I cry, I almost scream, I hold my heart, I close the book, I want to throw it away in the deep seas.”
আমাদের বাংলাদেশও এখন পরিণত হয়েছে ধর্ষকদের অভয়ারণ্যে। এইতো সেদিন একটা ভিডিও প্রকাশিত হয়েছে সামাজিক মাধ্যমে। যেখানে দেখা গিয়েছে দলবদ্ধভাবে একজন নারীকে ধর্ষণ এবং নির্যাতন করছে চারজন পুরুষ। নির্যাতনের শিকার সেই নারী আকাশ-বাতাস ফাটিয়ে চিৎকার করছে, পায়ে ধরে ক্ষমা চাইছে নির্যাতকদের কাছে। এই ভিডিও শেষ না হতেই বের হয়ে এসেছে আরেক ভিডিও। সেখানে দেখা গেছে ধর্ষণে বাধা দিচ্ছে বলে মেয়েটার গলায় ছুরি চালিয়ে দিয়েছে ধর্ষকেরা। ক্রমবর্ধমান ধর্ষণ এবং নারীর প্রতি সহিংসতার প্রতিবাদে বাংলাদেশেও মেয়েরা নেমে এসেছে রাস্তায়। এই দেশেও মেয়েরা নিরাপদ নয়। এখানেও মেয়েরা ধর্ষণের শিকার হয় নানা কারণে। প্রেম প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলে ধর্ষণ করা হয়, অরক্ষিত অবস্থায় একা পেলে নারীকে ধর্ষণ করে পশুরা, রাজনৈতিক ক্ষমতার দম্ভে করা হয় ধর্ষণ, কখনো শুধুমাত্র ভিন্ন জাতিসত্তা হবার কারণেও পাহাড়ে ধর্ষণের শিকার হয় নারীরা। রক্ষক সেজে পুলিশও ভক্ষক হয়ে ওঠে এই সমাজে। আমাদেরও রয়েছে ইয়াসমিন, তনু, পূজাদের ইতিহাস।

আমাদের শুধু নেই একজন প্রিয়াঙ্কা দুবে, যা আছে ভারতে। একজন প্রিয়াঙ্কা দুবে আমাদের থাকলে, তিনি নিশ্চয় সারা বাংলাদেশ চষে বেড়াতেন। বের করে আনতেন ধর্ষণের প্রকৃতি এবং প্রকারভেদ। ব্যবচ্ছেদ করতেন নারীর উপরে ঘটা নৃশংস নির্যাতনের। সেগুলো বিশ্লেষণ করে আমরাও জানতে পারতাম আমাদের অঞ্চলের নারীদেরও আসলে কোনো ঠিকানা নেই, নেই কোনো অস্তিত্ব। প্রবল প্রতাপশালী পুরুষতন্ত্রে তারা আছে শুধুমাত্র নির্যাতিত হবার জন্যই। নারীর আসলেই কোনো দেশ থাকে না, তা সে যে দেশেই জন্মাক না কেনো।
