আঞ্জুমান রোজী

লেখক

নারীবাদেই নারীর মানুষসত্তা

যখন একজন নারী 'মানুষ' হয়ে উঠতে না পারে তখন সেই নারী যতো বড় লেখকই হোক না কেনো তার কোনো লেখা তো দূরে থাক তার ব্যক্তিত্বও আমাকে টানে না; ঠিক সেভাবে একজন পুরুষ লেখকও যখন 'মানুষ' না হয়ে পুরুষ হয়ে থাকে তাকেও আমি দূরে ঠেলে দেই। প্রাকৃতিক নিয়মে আমি একজন নারী বটে, ঠিক যেভাবে একজন পুরুষের জন্ম। ভেদাভেদটা শুধু শরীরবৃত্তীয়। কিন্তু মননের জায়গায় বা সৃষ্টিশীল জায়গায় নারী পুরুষের কোনো ভেদাভেদ থাকে না। যদিও পুরুষতান্ত্রিক সমাজ এই ভেদাভেদ করে এবং এই ভেদাভেদে অনেক নারী লেখকও একই দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেন। অথচ সৃষ্টিশীল কিংবা মননশীল জায়গায় নারীপুরুষ সব একাকার হয়ে যায়। সেক্ষেত্রে একজন নারী যখন পূর্ণাঙ্গ 'মানুষ' হওয়ার অভিপ্রায় রাখে না তখন তার সৃষ্টিশীল কোনো কাজও গুরুত্ব পায় না। আমি এমন নারী লেখক খুঁজে বেড়াই, যার ভেতর 'মানুষ' হয়ে বেঁচে থাকার পাশাপাশি মাথা উঁচু করে চলার প্রবণতা প্রবল। আমি তাঁদের কাছেই যাই এবং তাঁদেরকেই কাছে টানি।

অনেক নারী লেখক 'নারীবাদ' বিষয়টাকে উপেক্ষা করেন। বলেন, এটি একটি ক্লিশে বিষয়। আরো বলেন, নারী নারীর মতো থাকবে, পুরুষ পুরুষের মতো থাকবে। নারী পুরুষে এতো সমান সমানের কী আছে? প্রাকৃতিকভাবে নারী একটা আলাদা সত্তা, তাকে তার মতো করেই থাকা উচিৎ। এই মানসিকতা নিয়ে অনেক বিখ্যাত নারী লেখক আছেন। তাদের অনেকেই পারিবারিক পরিবেশে পুরুষের আনুকূল্য পেয়েছেন, পেয়েছেন আদর সোহাগ , এমনকি কেউ কেউ প্রচুর স্বাধীনতাও পেয়েছেন, সেই মানসিকতা এবং দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে তারা সাহিত্য রচনা করেছেন বা করে যাচ্ছেন। যার কারণে 'নারীবাদ' বিষয়টি তাদের মাথায় আসে নি। নারী জন্মেই যুদ্ধ করে এমন পরিবেশ এসব নারী লেখক কল্পনাই করতে পারেন না। এটা কি তাদের ভাগ্য বলবো নাকি আমি তাদের ভাগ্যকে হিংসে করবো? অথচ আপামর জনসাধারণের একটি বৃহৎ অংশ নারী। যেই বৃহৎ অংশের প্রতিনিধিত্বকারী ঐসব নারী লেখক। সেই বৃহৎ অংশের নারীর সবাই কি আদরে আহ্লাদে বড় হচ্ছে? পাচ্ছে কি সামাজিক মর্যাদা? এমন অনেক প্রশ্ন আসে মাথায়।

বিশেষ করে লেখালেখির মাধ্যমে একজন নারী লেখক যদি মনুষ্যত্বের বিকাশ 'মানুষ' হিসেবে দেখাতে না পারেন, তাহলে সমাজে পরিবর্তন আসবে কেমন করে? আমরা যারা লেখালেখি করি, তাদেরকে অনেক সময় প্রশ্ন করা হয়, কেনো লেখালেখি করি কিম্বা এর উদ্দেশ্য কী? অনেকেই উত্তরে বলেন, "ভালো লাগে তাই লেখি। লিখলে নিজের সঙ্গে কথা বলার মতো মনে হয়। একটা কিছু লেখার পর খুব রিলাক্স লাগে।" তারপর? এরপর চুপ করে থাকে। যদি জিজ্ঞেস করা হয়, আপনি চান না আপনার লেখা অন্য কেউ পড়ুক? "অবশ্যই চাই। তবে কে পড়বে আর না পড়বে, সে আশা করে তো লেখি না! লেখি আর কি।" এক্ষেত্রে এমন নারী লেখকদের বলবো, আপনাদের লেখা ডাইরির মধ্যে বন্দি করে রাখুন। এখানে একটা প্রশ্নও জুড়ে দিতে চাই, শিল্পের সুষমা ছড়ানোর জন্যই কি লেখালেখি? আনন্দ আর চিত্তবিনোদনের জন্যই কি সাহিত্য রচনা? তাহলে সে লেখা সিন্দুকে তুলে রাখুন। বিশেষ করে নারী লেখকদের লেখা।

নারীপুরুষ যারাই লেখালেখি করুক না কেনো এর একটা প্রভাব সমাজে পড়বেই। পাঠক পড়া মাত্রই নিজের মননের সঙ্গে বোঝাপড়া করবে। এমতাবস্থায় লেখকদের কী ভাবা উচিৎ? অবশ্যই সব লেখক চায় তার লেখাটা যেনো পড়া হয়। লেখালেখি হলো সমাজের দর্পণ। পাঠকও সেখানে নিজেকে দেখে, লেখকও সেখানে নিজেকে দেখে। তাই লেখালেখির উদ্দেশ্যেই হলো, অর্জিত জ্ঞান, তথ্য, আবেগের যাত্রাপথ সবই অন্যের মধ্যে বিলিয়ে দেয়া। এই বিলিয়ে দেয়ার মধ্য দিয়ে লেখক সামাজিক সচেতনতায় বিরাট ভূমিকা রাখছে। বিশেষ করে নারী লেখকদের মধ্যে সেই আলোকবর্তিকা না দেখা গেলে, নারী সমাজের পথ মসৃণ তো হবেই না এমনকি নারী সমাজ বুঝতেও পারবে না তারাও যে 'মানুষ'।

এমনই অনেক নারী লেখক আছেন, যারা 'নারীবাদ' বুঝতে চান না। 'নারীবাদ' অর্থ যে নারীর 'মানুষ' হওয়ার একটি দিক, এই দিকটি দুঃখজনক হলেও সত্য অনেক নারী লেখক তা মানতেই চান না। নারীপুরুষ ভেদাভেদ গুলিয়ে এ সমস্ত নারী লেখক যাই লিখুক না কেনো, তারা যে সমাজের প্রতিনিধিত্ব করছেন সে সমাজে তার কোনো গ্রহণযোগ্যতা রাখে না। যদি রাখতই তবে আজকের বাংলাদেশে নারী সমাজের এমন রূপ দেখতে হতো না।

বেগম রোকেয়ার সময় থেকে সময় তো অনেক গড়িয়েছে। নারী সমাজের পরিবর্তনের যে ছিটেফোঁটা দেখছি তা পুঁজিবাদী শ্রেণিতে আবদ্ধ। অধিকাংশ নারী লেখক নিজের অবস্থান ঠিক রাখার জন্য লিখে যাচ্ছেন। আর এজন্য পুরুষের সঙ্গেই তাদের আপোষ করতে হচ্ছে। তাই তারা 'নারীবাদ' বিষয়টি লেখাতে আনা তো দূরে থাক, মুখেও আনেন না। তাদের এমন লেখক স্বীকৃতি দিয়ে কী হবে নারী যদি নারীমুক্তির পথ না দেখায়?

এসব নিয়ে ভাবি আর মাথা খারাপ করি। সেইসাথে নারী হয়ে জন্মানোর শত পাপ মাথায় বয়ে বেড়াই।

1245 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।