ফারজানা কাজী

সমাজ কর্মী

বাঙালি-মুসলমান বাঙালি নাকি মুসলমান?

বাঙালি মুসলমানদের বাঙালি না বলাই ভালো। কারণ উনারা আগে মুসলমান, পরে বাঙালি। কিন্তু পরে যে বাঙালি তাও উনারা স্বীকার করতে লজ্জা পান, দ্বীধাবোধ করেন। এদেশের বেশির ভাগ মুসলমান ভাবেন তারা মুসলমান, বাঙালি নন। কারণবাঙালিশব্দটির থেকে হিন্দু হিন্দু গন্ধ পাওয়া যায়!

বাঙালি মুসলমান হলো একটি জাতিগত, ভাষাগত ও ধর্মীয় সম্প্রদায় যারা বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিক এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরা রাজ্যের বৃহত্তম সংখ্যালঘু। জাতিগত বাঙালি যারা ইসলাম ধর্ম অনুসরণ করে এবং বাংলা অক্ষরে লিখিত বাংলা ভাষায় কথা বলে। ভাষা-জাতিগত দিক থেকে তারা পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম (আরব মুসলমানদের পরেই) মুসলমান সম্প্রদায়। বাঙালি ও মুসলমান সংস্কৃতির সম্মিলনে বাঙালি মুসলিম সম্প্রদায় গঠিত হয়েছে। বাঙালিরা দক্ষিণ এশিয়ার বঙ্গ অঞ্চলে বসবাসকারী এবং বাংলাভাষী লোক। ঐতিহাসিভাবে এ অঞ্চলটি গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র নদী দ্বারা ভারত থেকে বিভক্ত, যা বাঙালি জাতিকে একটি স্বাধীন ভাষা ও সংস্কৃতি তৈরি করতে সাহায্য করেছে। বাঙালি মুসলমানদের অধিকাংশই হানাফী দর্শনের অনুসারী সুন্নি মুসলিম। কিছু শিয়া, আহমদিয়া ও নির্দিষ্ট কোনো দর্শনের অন্তর্ভুক্ত নয় এমন মুসলিম ও এখানে বাস করে।প্রথম সহস্রাব্দে এ অঞ্চলে ইসলাম ধর্মের আগমন হয় এবং তা বাঙালি সংস্কৃতি ও সভ্যতাকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে। পারস্য, তুর্কি, আরব ও মুঘল ঔপনিবেশিকদের আগমন বাংলার সংস্কৃতিতে নতুন মাত্রা যোগ করে। ইতিহাসবিদগণ বলেন যে, ইসলাম ধর্মপ্রচারক দ্বারা নিম্ন বর্ণের হিন্দু থেকে অধিক সংখ্যায় বাঙালি ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়েছে। এই অঞ্চলে ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে সুফি ঘারানার যে সকল মুসলিম সাধক এসেছিলেন, তাদের মরমী সুফি দর্শনের সাথে এখানকার মানুষের উদারবাদী দৃষ্টিভঙ্গি মিলে যায় বলেই তারা এখানে ধর্ম প্রচারে সফল হয়েছেন।

১২০৪ খ্রিষ্টাব্দে বখতিয়ার খলজি বাংলায় যে মুসলিম শাসনের প্রতিষ্ঠা করেন তা ১৭৫৭ খ্রিষ্টাব্দের পলাশির যুদ্ধে সিরাজদৌল্লার পরাজয় পর্যন্ত এবং ১৭৬৫ খ্রিষ্টাব্দের ইংরেজদের দেওয়ানি লাভ পর্যন্ত বজায় ছিলো। ১২০৪ থেকে ১৭৬৫ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত অর্থাৎ ৫৬২ বছর সময়ে ৭৬ জন মুসলমান সুবাদার, রাজা, নাযিম বাংলা শাসন করেছেন।

এখানকার হিন্দু বা বৌদ্ধদের কিন্তু কোরআন-হাদিস পড়ে কিংবা কাবা-রওজা দেখে ভক্তিতে গদগদ হয়ে মুসলমান হওয়ার সুযোগ ছিলো না এবং আরবি ভাষা যেহেতু এখানকার মানুষের ভাষা নয়, তাই সে ভাষার ধর্মগ্রন্থ পড়ে ও বুঝে ঈমান আনাও সহজ ছিলো না। অর্থাৎ ইসলাম-আল্লাহ-নবীদের বিভিন্ন কেরামতির গল্পগুলো সুফি-দরবেশদের মুখে মুখে বিভিন্ন কেচ্ছা-কাহিনী হিসেবে বর্ণিত হয়েই এখানে ইসলামে ঢুকেছে। তারা জাতপাতহীন উদার মানবিকতার গল্প শুনিয়েছেন, সেটা মানুষ গ্রহণও করেছে। শুধু দোজখের ভয় বা বেহেশতের লোভ দেখিয়ে অমুসলিমদের আকৃষ্ট করা সম্ভব ছিলো না, তাই এসব কেচ্ছা-কাহিনী আর উদার জীবনযাত্রার কথাই মানুষকে আগ্রহী করেছে।

এখানকার নিন্মবর্ণের হিন্দুরা বর্ণবাদ কিংবা ব্রাহ্মণদের কাছ থেকে মুক্তি চেয়েছে বলে ইসলামে এসেছে, কেউ কেউ অর্থনৈতিক সুবিধা পাওয়ার আশায় নিজের আদি ধর্ম ছেড়েছে, তাদের সংস্কৃতিক পরিমণ্ডল থেকে মুক্তি চাইতে কিন্তু নয়।

আর শুধুই কি নিজেদের ইচ্ছায়ই ধর্মান্তরিত হয়েই এখানে বাঙালি মুসলমান এসেছে? উঁচিয়ে ধরা তরবারির ভয়েও এদেশের হিন্দুরা ধর্মান্তরিত হয়েছে, হতে বাধ্য করা হয়েছে। এখানকার মেয়েদের জোর করে তুলে নিয়ে গিয়ে যৌনদাসী বানিয়েছে মুসলমান বিজেতারা।

বাঙালি-মুসলমানেরা কি বাঙালি নাকি মুসলমান? নাকি একই সাথে বাঙালি এবং মুসলমান? এই আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে ভোগাটা বাঙালি-মুসলমানের সবচেয়ে বড় সমস্যা। পৃথিবীতে দ্বিতীয় কোনো জাতি নেই যারা এই ধরণের মনোজাগতিক সঙ্কটে ভোগে! বাঙালি+মুসলমান= একটি রোগের নাম। এই রোগ মধ্যযুগ থেকেই চলে এসেছে। কিন্তু এখন মধ্যযুগ থেকে চরমতর হয়েছে। মধ্যযুগের কবি আবদুল হাকিম নাকি ক্ষোভ করে বলেছিলেন, ‘বাঙালি মুসলমানদের একটি অংশের পিতার ঠিক নেই

মোল্লারা আজ ঘোষণা দেয় গান-বাজনা হারাম, ছবি তোলা হারাম, পহেলা বৈশাখ হারাম, মঙ্গল শোভাযাত্রা নিষিদ্ধ, নারীর ঘরের বাইরে যাওয়া হারাম, চাকরি করা হারাম, বোরকা-হিজাব পরা বাধ্যতামূলক, নারীর ভাস্কর্য রাখা যাবে না, ধর্মীয় বইয়ে যা লেখা আছে অক্ষরে অক্ষরে সেটা মানতে হবে এবং সবার উপর ধর্মীয় বিধি চাপিয়ে দেয়ার পাঁয়তারা করছে তারা। আজকের দিনে দেড় হাজার বছর আগেকার সংস্কৃতি টিকিয়ে রাখার কথা বলছে মৌলবিরা! বছরের পর বছর ওয়াজ-মাহফিল, জুম্মার খুতবায়, আলোচনা অনুষ্ঠানেহিন্দুয়ানিনাম দিয়ে বাঙালি সংস্কৃতির বিরুদ্ধে কথা বলে গলা ফাটিয়েছে ধর্মান্ধ-মৌলবাদীরা। বাধা দেয় নি কেউ। সরকার পা চেটেছে এইসব ধর্মান্ধ, স্বার্থবাদীদের। ওদের পায়ের কাছে বসে মিঁউমিঁউ করেছে।

ব্যাপারটি এমন যে, কেউ মুসলিম হলে সে আর বাঙালি হতে পাররে না, আর বাঙালি সংস্কৃতি চর্চাকারী কখনো সহিহ্ মুসলিম হতে পারবে না। এসব প্রচারণার ফল এখন ফলতে শুরু করেছে চোখের সামনেই। এথনকার প্রজন্ম না হতে পারছে আরব মুসলিম, না হতে পারছে বাঙালি।

2345 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।