রোখসানা চৌধুরী

পেশা অধ্যাপনা ।গবেষণা প্রবন্ধ,অনুবাদ,কবিতাসহ নিরীক্ষাধর্মী যে কোনো বিষয়ে লেখালেখিতে আগ্রহী।

বাংলাদেশের সমাজ ও সাহিত্যে ধর্ষণ-মনস্তত্ত্বের অবয়ব (রিপোস্ট)

 
পৃথিবীর আদিমতম অপরাধ খুন ও ধর্ষণ। কিন্তু খুন আর ধর্ষণের মধ্যেও রয়েছে মনস্তাত্ত্বিক প্রতিক্রিয়াজনিত পার্থক্য। ধর্ষণের মনস্তত্ত্ব নিয়ে এখন চতুর্দিকেই বেশ কথাবার্তা হচ্ছে, এটা আশার কথা। বাংলাদেশের সমাজ ও সাহিত্যে ধর্ষণ মনস্ততত্ত্বের অবয়বঃ 
১. 
শৈশব-কৈশোর থেকেই প্রতিটি নারীর বেড়ে ওঠায় হেরফের থাকলেও একটা জায়গায় অবধারিতভাবে মিল থাকে। তা হচ্ছে যৌন নিগ্রহের ভীতি। আমাদের ছোটবেলাতে মিডিয়া বলতে মূলত দৈনিক পত্রিকা আর সিনেমাকে বুঝতাম। সিনেমায় তখন ধর্ষণের দৃশ্য মানেই ভয়ংকর ভিলেন, আর আমাদের চোখ বুজে সেই দৃশ্য পার করে দেয়া। নিশ্চিতভাবেই ধর্ষণের শিকার নারীটির যে-কোনো উপায়ে মৃত্যু ঘটতো। আমরা জানতাম ধর্ষণের শিকার হওয়াটা মৃত্যুর পথে যাত্রা। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক প্রতিটি চলচ্চিত্রেও বীরাঙ্গনা নারীর একই পরিণতি দেখানো হয়েছে। (অরুনোদয়ের অগ্নিস্বাক্ষী বাদে)
 
বড় হতে হতে আরো জানলাম, ধর্ষণ কেবল লজ্জা আর ঘৃণার বিষয়ই না, উপহাসেরও বিষয়। হিন্দি ছবির নায়ক আমির খানের শুরুর দিককার 'দিল' চলচ্চিত্রে দেখানো হয়েছিলো ধর্ষণ বিষয়টি কলেজ থেকে বের করে দেয়ার মতো সমান অপরাধ! যেভাবে অনেক বিচক্ষণ ব্যক্তিকে বলতে দেখেছি গণপিটুনি আর গণধর্ষণকে এক করে দেখতে। (দুটোই সমান ভয়ংকর অপরাধ বটে, কিন্তু দুটোর মানসিক প্রতিক্রিয়া কোনভাবেই এক হতে পারে না।)
 
আমির খানের বিখ্যাত ছবি 'থ্রি ইডিয়টসে'ও দেখা যায় বলাৎকার আর স্তন শব্দটি নিয়ে উপর্যুপরি বিদ্রুপ করতে। ধর্ষণের পেছনে ভিকটিম ব্লেমিং হিসেবে কাপড়চোপর, চলাফেরার বিষয়গুলো বহুকথিত বলে এখানে আর উল্লেখ করছি না। কিন্তু একটা কথা প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি, বছর দু’য়েক আগে ফেসবুকে কয়েকজন তরুণ  কবি-সাহিত্যিকের সঙ্গে তর্কে জড়িয়ে পড়েছিলাম এজন্য যে, তাদের ভাষ্য ছিলো বৃদ্ধা কিংবা শিশুর ওপর যৌন নিগ্রহ ঘটছে মূলত স্বল্পবসনাদের আয়ত্ত করতে না পারার ক্ষোভ থেকে। ঘুরেফিরে কাপড়চোপরকেই দায়ী করছেন তারা, যে-কোনো দিক থেকে। 
 
যেহেতু মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকে বিষয়টিকে ভাবার চেষ্টা করেছি, তাই জনতার মনোভাবের আরেকটি পয়েন্ট উল্লেখ না করলেই না। সব ধরনের ধর্ষণ কিন্তু আলোচিত হয় না। বরং অধিকাংশ ক্ষেত্রে সমালোচিত হয়।তনুর ক্ষেত্রে তার থিয়েটার করা, হিজাবের সাথে মুখে মেকাপ দেয়া, চা বাগানে ঘুরতে যাওয়া, তার নাকি একুশটা সিম ছিলো... এসব বিস্রস্ত আলাপে প্রতিবাদী জনগণের দৃষ্টি দিগভ্রান্ত হয়েছিলো। সাধারণত কোনো ঘটনাগুলো আলোচিত হয়? স্বামী/পিতা মাতাকে বেঁধে রেখে স্ত্রী/কন্যাকে ধর্ষণ করলে, ঘটনার সাথে নৃশংসতার সংযোগ থাকলে, অজাচার সম্পর্কিত হলে, ইত্যাদি। 
 
যদি বন্ধু বা প্রেমিকের সাথে ঘুরতে গিয়ে ধর্ষণ হয়, যদি বন্ধু বা প্রেমিকের হাতেই ধর্ষণ কাণ্ডটি ঘটে তাহলে দলমত নির্বিশেষে সবাই এক কাতারে দাঁড়িয়ে যান এবং কনটেক্সটের আলোকে  বিচার কার্য শুরু হয়ে যায়। 
পাঠক/দর্শক /শ্রোতা আগেই অন্তরে ও মগজে একটা বিচারসভা শেষ করে নেয়। তারপর শুধু রায় দেয়া বাকি থাকে। 
 
এতসব বিভ্রান্তির পর কীভাবে আশা করা যায় একটি দেশে ধর্ষণ বিষয়ে সময়োপযোগী যথাযথ আইন প্রণয়ন এবং প্রয়োগ ঘটবে?
 
২.
আইনের ভাষায় ধর্ষণ বলতে বোঝায় নারীর সম্মতি ছাড়া তার সঙ্গে কোনো পুরুষের যৌন সম্পর্ক স্থাপন করা। ধর্ষণের সময় নারী যদি কোনো বাধা না দেয় বা প্রতিরোধ নাও করে, তাহলেও যৌন সম্পর্ক স্থাপনে যে-কোনোভাবে অসম্মতি জানালেই সেটা ধর্ষণ হিসেবে গণ্য হবে। কারণ ধর্ষণের সময় অনেক কারণে নারী বাধা দিতে বা প্রতিরোধ করতে পারে না। যেমন ধর্ষণকারী তাকে অস্ত্র দিয়ে ভয় দেখাতে পারে। নারী মৃত্যু ভয় কিংবা গুরুত্বর আঘাত পাওয়ার ভয় পেতে পারে। আবার মাদকদ্রব্য বা ওষুধ দিয়ে নারীকে জ্ঞানহীন করে ধর্ষণ করা হতে পারে। তবে ১৬ বছরের কম বয়স্ক শিশু যৌন সম্পর্ক স্থাপনে সম্মতি দিক বা না দিক তা ধর্ষণ হবে। কারণ ১৬ বছরের কম বয়স্ক শিশুর সম্মতির কোনো মূল্য নেই।
 
ধর্ষণ একটি মারাত্মক অপরাধ হিসেবে আইনে বিবেচিত। যেসব আইনে ধর্ষণসংক্রান্ত বিধিবিধান রয়েছে সেগুলো হলো:
 
১। দণ্ডবিধি ১৮৬০ 
২। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ (সংশোধন-২০০৩)
৩। ফৌজদারি কার্যবিধি ১৮৯৮
৪। সাক্ষ্য আইন, ১৮৭২
 
ধর্ষণের প্রকারভেদে ধর্ষকের শাস্তি ন্যূনতম পাঁচ বছর কারাদণ্ড থেকে শুরু করে অর্থদণ্ড যাবজ্জীবন কিংবা মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত শাস্তির বিধান রয়েছে।
 
কিন্তু এইসব আইনের সফল প্রয়োগের দৃষ্টান্ত রয়েছে কি? ট্রান্সকম গ্রুপের ক্ষমতাবান সম্পদশালী পিতা লতিফুর রহমান তার কন্যা শাজনীনের জন্য বিচার পান সুদীর্ঘ ১৮ বছর পর। তাহলে বাকিদের কথা ভাবা যায়? 
 
৩.
সেলিনা হোসেনের 'দীপান্বিতা' উপন্যাসের নায়িকা এনজিও কর্মী  সুনীতিকে তার দীর্ঘদিনের সহকর্মী আর স্থানীয় নৌকার মাঝি একসাথে ধর্ষণ করে। পরে মাঝিরই উদ্যোগে সুনীতির বিরুদ্ধে গ্রাম্য সালিশ বসে। স্থানীয় মাওলানা ধর্ষণকে ব্যভিচার গণ্য করে ধর্ষক (সহকর্মী) এবং ধর্ষণের শিকার সুনীতির জন্য শাস্তি ঘোষণা করেন এবং তাদের মধ্যে বিয়ে দেয়ার উদ্যোগ নেন। ফতোয়া দেয়া হয় যে, সুনীতির বেপর্দা চলাফেরার কারণেই সে এই দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে। অর্থাৎ ভিকটিম যথারীতি ব্লেমিংয়ের শিকার। হুমায়ুন আজাদের 'পাক সার জমিন সাদ বাদ' উপন্যাসে দেখা যায় রাজনৈতিক নেতা-কর্মীরা ক্ষমতার বলয়ে থেকে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত নারীদের নির্বিচারে ধর্ষণ করছে, ধর্মীয় নির্দেশনার অজুহাতকে সামনে রেখে। তাই আইনের সংজ্ঞা ‘ধর্ষণ’ বিষয়টিকে সম্পূর্ণভাবে ব্যাখ্যা করতে সক্ষম নয় বলেই ধারণা করা যায়। 
 
ধর্ম এখনো এই অঞ্চলের মানুষের প্রধান একটি নিয়ামক। এখানকার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডও প্রবলভাবে প্রভাবিত হয় নির্দিষ্ট ধর্মকে দিয়ে। শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে বর্ণিত কৃষ্ণের ধর্ষণকর্ম দেবতার লীলা হিসেবে স্বীকৃতি পায়।মহাভারতের দেবতা ইন্দ্র এবং পরাশর বিষয়েও একই কথা বলা চলে। ইসলাম ধর্মে ব্যভিচারের জন্য নারী পুরুষ উভয়কে শাস্তি দেয়া হয়। তবে ধর্ষণের ক্ষেত্রে চারজন চাক্ষুষ স্বাক্ষীর দরকার হয়। আবার যুদ্ধে পরাজিত পক্ষের নারীদের গণিমতের মাল হিসেবে গণ্য করে মুতা বিবাহের মাধ্যমে তা হালাল করে নেয়ার বিধান আছে যা ধর্ষণের নামান্তর।
 
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে এই যুক্তিতেই লক্ষ লক্ষ নারীর জীবন ধ্বংস করা হয়েছিলো। বিবাহিত নারীকেও স্বামীর মনোতুষ্টির জন্য যে কোনো অবস্থায় প্রস্তুত থাকতে বলা হচ্ছে যা ম্যারিটাল রেপকে সমর্থন করে। আমি এখানে ধর্ম নয়, বরং ধর্মের আলোকে জন মনস্তত্ত্বকে তুলে ধরতে চেষ্টা করেছি। আমার এইচএসসি পড়ুয়া আঠারো-না-হওয়া ছাত্র ক্লাসে বলেছিলো, 'বউ পেটানো তো জায়েজ। কোরানেই আছে!'
 
৪.
সাম্প্রতিক সময়ে ভিকটিম ব্লেমিং আরো জোরালো হয়েছে কয়েকটি পয়েন্টে। তার মধ্যে একটি হলো "বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে ধর্ষণ"। প্রশ্ন উঠেছে মেয়েরা যদি বিয়ে নামক প্রতিষ্ঠানে এখনো প্রলুব্ধ হয় তাহলে ধর্ষণকেও মেনে নেয়া উচিত, কারণ দু’জনের সম্মতিতে সহবাসকে কোনো অর্থেই ধর্ষণ বলা চলে না। আমার যতদূর মনে পড়ে, আমাদের সময় প্রলোভন শব্দটা ছিলো না, ছিলো প্রতিশ্রুতি। সাংবাদিকের যাদুমন্ত্রে অধিক পাঠকানুভূতি পাওয়ার আশায় শব্দের চেহারা বদলে গেছে। বিয়ের প্রতিশ্রুতিও আদতে প্রেমের প্রতিশ্রুতি বা আজীবন ভালোবাসার। কিন্তু প্রেম ভালবাসা শব্দগুলো আমাদের সমাজে নিগৃহীত, অসামাজিক কার্যকলাপ হিসেবে পরিচিত, এটা আমরা ভুলে যাই। শুধু এই অজুহাতেই এমসি কলেজের মতো শত শত ঘটনা ঘটে চলেছে, কারণ লোকলজ্জায় প্রেমিক জুটি মুখ খোলে না।
 
আর বিয়ে, যাকে আমি ভাবি পছন্দের কারো সঙ্গে একসাথে থাকার ইচ্ছা সেই প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করাটা ব্যক্তিগত অপরাধ বটে, নারী-পুরুষ উভয়ের জন্যই। কঙ্গনা রানাওয়াতের 'কুইন' ছবিতে আকস্মিক বিয়ে ভেঙে দেয় প্রেমিক। মেয়েটি মানসিক চাপ সহ্য করতে না পেরে একাই প্যারিস রওনা দেয় যেখানে তাদের হানিমুন হওয়ার কথা ছিলো। আমাদের দেশে বিয়ে/প্রেম ভাঙার পর কুইনের মতো পারিবারিক সহানুভূতিটুকুও পায় না সাধারণত। তবুও, সকল প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে আইফেল টাওয়ার পর্যন্ত একা যেতে পারার বাস্তবতায় পৌঁছোতে পারাটাই গন্তব্য হওয়া উচিত, সময়সাপেক্ষ হলেও। 
 
৫.
 অধ্যাপক আনু মুহাম্মদের ব্যাখ্যায় ধর্ষণের সংজ্ঞা:
 
'ধর্ষণ কী? এটা কি কেবলই যৌনক্রীড়া? তা যদি হয়, তাহলে সব যৌনক্রীড়াই কি ধর্ষণ? না।...যৌন সম্পর্ক পারস্পরিক ভালোবাসার ব্যাপার। পারস্পরিক সম্মতি এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।...যে-কেউ কথা তুলতে পারেন তাহলে পতিতাবৃত্তি কী? তাহলে ভালোবাসাহীন দাম্পত্য জীবন কী? এগুলো ধর্ষণেরই বিভিন্ন লুকানো রূপ। আর এই বীভৎসতা সকল মাত্রা অতিক্রম করে নারকীয় উল্লাসে নারীর ওপর একক বা দলগতভাবে যৌন আক্রমণ।...এখানে ধর্ষণকারীর যে আনন্দ তা কীসের আনন্দ? এটা কি যৌনক্ষুধা পূরণের আনন্দ? না।এটা হলো ক্ষমতা প্রদর্শনের দমন-পীড়নের কর্তৃত্বের কুৎসিত আনন্দ। এই ক্ষমতা প্রশাসনিক, সামাজিক ক্ষমতার। আরেকজন মানুষের কান্না-যন্ত্রণা-কষ্ট-হাহাকার দেখে যে আনন্দ হয় তার থেকে পৈশাচিক জিনিস আর কী হতে পারে? এগুলো বীভৎস খুন কিংবা তার চেয়ে বেশি। 
 
খুনে নিহত ব্যক্তির যন্ত্রণা শেষ হয়। ধর্ষণে আক্রান্ত ব্যক্তির যন্ত্রণার শেষ নেই, ধর্ষণ দিয়ে তার যাত্রা শুরু হয়। এই যন্ত্রণা দিয়ে যারা আনন্দ পায় তাদের সঙ্গে পেশাদার খুনির কোনো তফাত নেই। তারা মানুষ থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করেছে অনেক আগেই। এই দুর্বৃত্তদের পক্ষে যারা যুক্তি দাঁড় করাতে চায়, এদের যারা রক্ষা করতে চায় এবং এগুলো করতে গিয়ে যারা নারীর স্বাভাবিক চলাফেরা জীবন যাপনকেই আক্রমণ করতে চায় বা নিপীড়িতাকেই আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে চায় তাদেরকেও মানুষ বলে বিবেচনা করা কঠিন।' (নারী পুরুষ ও সমাজ/আনু মুহাম্মদ) 
 
মানবাধিকার কর্মী আয়েশা খানমের মতে, ধর্ষণ যৌন নিগ্রহের মধ্যে সবচেয়ে বর্বরতম পদ্ধতি। ধর্ষণের শিকার নারীটি দীর্ঘ ট্রমায় আক্রান্ত হতে পারে, এমনকি শারীরিক  ও মানসিকভাবে বিকল হয়ে যেতে পারে। 
 
হুমায়ুন আজাদও ধর্ষণকে মৃত্যুর অধিক ভয়ংকর বলে মতামত দিয়েছেন। তাঁর 'নারী' গ্রন্থে এই বিষয়ে পৃথক একটি অধ্যায় রয়েছে এর গুরুত্ব অনুধাবন করে। আজাদের 'রাজনীতিবিদগণ' উপন্যাসে সৌদিতে গৃহকর্মীর কাজে যোগ দিতে গিয়ে সুফিয়া ধর্ষণ-গর্ভধারণ-গর্ভপাত পুনর্ধর্ষণের উপর্যুপরি নারকীয় তাণ্ডবলীলা শেষে আত্মহত্যা করে।
 
'১০,০০০ এবং আরো একটি ধর্ষণ' উপন্যাসের নামই বলে দেয় বাংলাদেশে এই ঘৃণিত ঘটনাটি ঘটে চলেছে অনিঃশেষ ধারাবাহিকতায়। এই উপন্যাসের প্রধান চরিত্র ময়নার ক্ষেত্রে সুফিয়া যে ট্রমাটিক পরিস্থিতিতে আত্মহত্যা করে সেই অবস্থাকে বিশদভাবে অবলোকন করা যায়। ধর্ষণমুহূর্ত, ধর্ষণ-পরবর্তী সময়, গর্ভাবস্থা এবং সবশেষে ধর্ষণজাত সন্তান জন্মমাত্র তাকে হত্যা করার ভেতর দিয়ে ময়না তার জীবনের একটি ভয়ংকর সময় পার করে। এই সময়টিতে পাড়া-প্রতিবেশী তাকে অপমান করলেও তার পরিবার তাকে পূর্ণ সহযোগিতা দেওয়ার জন্যই হয়তো সে আত্মহত্যা পর্যন্ত ধাবিত হয় না। কিন্তু ধর্ষণের কারণে আসা গর্ভস্থ সন্তানকে সে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় হত্যা করে, সন্তানের মুখদর্শনে সব বেদনা ভুলে যাবার মিথকে মিথ্যা প্রমাণ করে দিয়ে। এই হত্যার কারণে তার জেল হয়। জেলখানায় দুর্ভাগ্যবশত সে আবারও গণধর্ষণের শিকার হয়। বিচারকের সামনে সে তীব্র ক্ষোভ ব্যক্ত করে কিন্তু তা প্রতিবাদ নয়। বরং হিস্টিরিয়াগ্রস্ত প্রলাপ বলে প্রতিভাত হয়। অর্থাৎ আত্মহত্যা না করেও ময়নার সম্পূর্ণ জীবনটাই মৃত্যুর চেয়ে শোকাবহ হয়ে পড়েছিলো।
 
তবে তাঁর উপন্যাসে পুরুষের শৈশবে ধর্ষকামী হয়ে বেড়ে ওঠার যুক্তিযুক্ত বিবরণ থাকলেও নেই ধর্ষণ-পরবর্তী ধর্ষকের প্রতিক্রিয়া। ধর্ষিতার পাশাপাশি এই প্রতিক্রিয়াটি পুরুষ লেখক হিসেবে তার কাছেই অধিক কাম্য ছিলো। বরং কিছু প্রশ্নের জন্ম হয়। তিনি কি ধর্ষণের শিকার নারীটির পালস ধরতে ব্যর্থ হয়েছিলেন, যখন ধর্ষণ কর্মটি যথেষ্ট নৃশংস হয়ে ওঠে না?
 
হুমায়ুন আজাদের 'পাক সার জমিন সাদ বাদ'-এ অগণিত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নারীকে নির্বিচারে ধর্ষণের শিকার হতে দেখা যায়। নেতা জানায়, তার কাছে যারা আসে তারা নাকি বারবার আসতে চায়। এজন্য সে এই কর্মটিকে ‘ধর্ষণ’ বলতে নারাজ। তাহলে কি কবির ভাষায় বলা যায়, ব্যবহৃত হতে হতে সেই নারীগণ শুয়োরের মাংস হয়ে গেছে? মানুষ কখনো শুয়োরের মাংসের মতো নিকৃষ্ট জড়বৎ হয়ে উঠতে পারে কি না, সেই মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তনের চিত্রলেখ আমাদের সামনে তুলে ধরে পারেন নি বলে সেই নারীদের মনোজগৎ আমাদের কাছে অবিশ্বাস্য এবং অনুন্মোচিতই থেকে যায়। একইভাবে 'সবকিছু ভেঙে পড়ে' উপন্যাসে দেখা যায় গ্রামের দরিদ্র প্রতিবন্ধী কিশোরীকে ধর্ষণ করে গ্রামেরই কিছু ছেলে। তাদের বন্ধু মাহবুব দেখতে পায় মেয়েটি, জঙ্গল থেকে হাসিমুখে বের হয়ে আসে আর তাকেও আহ্বান করে। প্রতিবন্ধী কিশোরীর কি শারীরিক ব্যথা বোঝার মতো অনুভব শক্তিরও অভাব থাকে? কিংবা 'সবকিছু ভেঙে পড়ে' উপন্যাসের বহুগামী নায়ক  মাহবুব তার স্ত্রীকে অকারণ  সন্দেহবশত ঈর্ষান্বিত হয়ে রাতের বেলা ধর্ষণ করে। স্বগতোক্তিতেই ধরা পড়ে সে নির্মমভাবে সংযুক্ত হতে হতে এই 'প্রভু-দাসী' হয়ে ওঠাকে উপভোগ করে। অথচ স্ত্রী ডলি যথেষ্ট বিস্মিত হলেও (কারণ বহুদিন হয় সে স্বামীসঙ্গ বঞ্চিত) সানন্দচিত্তে মুহূর্তগুলো উপভোগ করতে থাকে সেও। অর্থাৎ নৃশংস ধর্ষণকাণ্ড ঘটলে আর তারপরও ধর্ষিতা বেঁচে থাকলে তাকে আত্মহত্যা করতে হবে, নয়তো উন্মাদ হয়ে যেতে হবে এটা প্রমাণ করতে যে, ধর্ষণ একবার ঘটলে জীবন শেষ, যেভাবে আমরা শৈশব-কৈশোরে জেনে বেড়ে উঠেছি? আর বিপরীতে, যে ধর্ষণের ঘটনা যথেষ্ট যন্ত্রণাদায়ক নয় সেটি ধর্ষণ নয় ভেবে উপভোগ করে যেতে হবে? ধর্ষণ হওয়া আর না-হওয়ার এই অস্পষ্ট গ্রে লাইনগুলো কবে পরিষ্কার হয়ে উঠবে আমাদের মনস্তত্ত্বে? কবে আমরা সত্যিকার অর্থে প্রাপ্তমনস্ক হবো?
 
এর বিপরীতে সেলিনা হোসেনকে লক্ষ্য করা যাক। তিনি নিজেকে নারীবাদী লেখক বলে কখনো স্বীকার করেন না। প্রচলিত নারীবাদকে তিনি উগ্রতার স্মারক বলে বিবেচনা করেন। কিন্তু তাঁর হাতেই কি কাঙ্ক্ষিত জীবনবাদকে খুঁজে পাওয়া যায়? তাঁর উপন্যাসে কখনোই ধর্ষণের শিকার নারীকে আত্মহত্যায় জীবনের সমাপ্তি ঘটতে দেখা যায় না। 'যুদ্ধ' উপন্যাসের সুনন্দা মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে গণধর্ষণের শিকার হয়, তারপর ঘটনাক্রমে নিখোঁজ হয়ে যায়। তার ট্রমাটিক অবস্থার দীর্ঘ বর্ণনা রয়েছে উপন্যাসে কিন্তু সঙ্গে এ-ও দেখানো হয়েছে যে শরণার্থী শিবিরের আশ্রিত নারী-পুরুষ সকলেই তাকে ধর্ষণ-পরবর্তী বিপর্যস্ত অবস্থা কাটিয়ে উঠতে যথাসাধ্য চেষ্টা করে যাচ্ছে। তাকে ভর্ৎসনা করা হচ্ছে মৃদুভাবে যে তার এমন কী হয়েছে যে তাকে কারো কাঁধে ভর দিয়ে হাঁটতে হবে। অথবা স্নান করা হয়ে গেছে তারপর আর কান্নার কী আছে। অর্থাৎ ‘ধর্ষণের’ বিপর্যয় কেবলই শারীরিক দুর্ঘটনার চেয়ে বেশি কিছু নয় বলে লেখক একে সহজ আঘাতরূপে তুলে ধরতে চেয়েছেন। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বক্তব্যটি ধরা পড়েছে 'যুদ্ধ' উপন্যাসেরই আরেকটি চরিত্র বেণুর মাধ্যমে। সে তার প্রেমিক মাখনের যুদ্ধে হারিয়ে ফেলা পায়ের সঙ্গে তুলনা করেছে নিজের ধর্ষণজাত গর্ভাবস্থাকে অর্থাৎ একটি যুদ্ধাহত খোঁড়া পা যেমন শারীরিক দুঃখের অধিক কিছু নয়, ধর্ষণের ঘটনাকে লেখক সেলিনা সেভাবেই দেখতে চান। ধর্ষণ এমন একটি আদিম অপরাধ, যা কিনা কোনো দেশে নানা উপায় অবলম্বনের মাধ্যমে আনুপাতিক হার কমিয়ে আনা সম্ভব হলেও পুরোপুরি নির্মূল করা অসম্ভব। যেভাবে অ্যাসিড-সন্ত্রাসের ঘটনা আইন প্রয়োগ এবং জনসচেতনতার মাধ্যমে প্রায় নির্মূল করা সম্ভব হয়েছে। তাই সেলিনা হোসেনের মনোভাবের ব্যাখ্যা হয়তো এভাবে দেওয়া যায় যে, নারীর অগ্রগতির পথে এ ধরনের শক্ত প্রতিবন্ধকতাকে অনেক সময় উপেক্ষার মাধ্যমে মোকাবিলা করতে হবে। না হলে তৃতীয় বিশ্বের রক্ষণশীল সমাজকাঠামোতে নারীর অগ্রযাত্রা কঠিনতর হতে থাকবে। 
 
তিনি বরং আরো এক ধাপ অগ্রসর হয়ে ধর্ষণজাত সন্তানকেও সহজভাবে গ্রহণের পথ দেখান। 'যুদ্ধ' উপন্যাসের সোনামিথিকে দেখা যায় নিজ গ্রাম বাঁচাতে পাকিস্তানি বাহিনীকে স্বয়ং ধর্ষণের জন্য আহ্বান জানাতে। পরবর্তী সময়ে ধর্ষণজাত সেই সন্তানকে গ্রহণের জন্য তাকে প্রস্তুত হতে দেখা যায়। কেননা সে নিজে নিঃসন্তান ছিলো। 
'দীপান্বিতা' উপন্যাসের সুনীতি ধর্ষণের ফলে গর্ভধারণ করলে ঘোষণা দেয়, ‘শেষ পর্যন্ত শিশুরাই তো পৃথিবীকে ধরে রাখে।’ অর্থাৎ যতই অযাচিত হোক লেখক সেলিনার কাছে গণহত্যা ধর্ষণের চেয়ে শতগুণ বেশি অপরাধ আর তা ক্ষমার অযোগ্য। 
 
৬.
কাজেই ‘ধর্ষণ’ প্রসঙ্গে নারীর ট্রমা-আক্রান্ত হওয়াটাই শেষ কথা হতে পারে না। এমনকি দ্বিমত রয়েছে ‘ধর্ষণ’ ঘটনায় পুরুষের শাস্তি প্রসঙ্গেও। বিশ্বে নারীবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টির জন্য পুরুষকে সর্বোচ্চ দায়িত্বশীল হওয়ার দাবি জানানো হচ্ছে নারীদের পক্ষ থেকে। আবার অ্যাসিড সন্ত্রাসের মতো এই অপরাধ সম্পূর্ণ নির্মূলযোগ্য নয় বলে অনেকেই ধর্ষণের শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ডের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তা ছাড়া হুমায়ুন আজাদের উপন্যাসে আমরা দেখেছি কীভাবে একজন পুরুষ তার পরিবেশ-প্রতিবেশের সহায়তায় ক্রমশ একজন ধর্ষকামী ব্যক্তিতে রূপান্তরিত হয়। যে-কিনা জীবনে একবারও ধর্ষণ করতে না পারে, সে মনে-মনে হলেও করে। রাস্তাঘাটে, যানবাহনে, অফিসে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, টিভি-সিনেমায় দেখা যে-কোনো নারীকে।
 
ধর্ষণ বন্ধে প্রয়োজন আইনের যথাযথ প্রয়োগ, দ্রুত বিচার, স্কুল পর্যায় থেকে ছেলে-মেয়ে এবং বিশেষত অভিভাবকদের জন্য মনোবৈজ্ঞানিক কাউন্সেলিং। ‘ধর্ষণ’ সমস্যা কমিয়ে আনার জন্য এই পারিপার্শ্বিক শর্তগুলো পূরণ করা এখন সময়ের দাবি।
 

1982 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।