নাৎজি দল এসে আমাকে ধরে নিয়ে যায়। আমি কিছু বুঝে উঠার আগে আমাকে বন্দুকের বাট দিয়ে ধরাশায়ী করে ফেলে। কালো কাপড় দিয়ে চোখ বেধে জিপে উঠিয়ে গোল্ডেন হিল টর্চার সেলে নিয়ে যাওয়া হয়। অন্ধকার একটি কারা প্রকোষ্ঠে চোখ বাধা অবস্থায় দু'দিন ধরে পরে আছি।
আমি বুঝে উঠতে পারি না আমাদের দেশে নাৎজি এলো কী করে, নাৎজিতো জার্মানিতে থাকার কথা, তাও ৭০/৮০ বছর পূর্বের! আমি কী এমন করেছি যে হিটলার তার বাহিনী পাঠিয়ে দিবে আমাকে ধরে আনার জন্য। হিটলারের রোষ ছিলতো ইহুদিদের প্রতি, আমিতো ইহুদি নই যদিও মা আমাকে জেদ করে ইহুদি বলে গালাগালি করে থাকেন ধর্মকর্মে উদাসীন বলে। স্বপ্নের মধ্যে আমি ভাবনায় পরে যাই, আমাকে কী কোনো গ্যাস চেম্বারে ঢোকানো হবে, নাকী এক্সপেরিমেন্ট করবে কতোদিন না খেয়ে থাকতে পারে মানুষ। আমি তো ক্ষুধা সহ্য করতে পারি না, যে কারনে মা'র কড়া অনুশাসনেও কোনোদিন ধর্মুপোস করতে পারিনি।
আমি প্রচন্ড ক্ষুধার যন্ত্রণা অনুভব করি। আমার হাত পিছনে মোড়ানো বাঁধা চোখ কালো কাপড়ে আটকানো। আমি হিটলারের প্রতি কৃতজ্ঞ হই, আমার পা দু'টো মুক্ত করে রেখেছে বলে। আমার মুখের উপর দিয়ে তেলাপোকা হেটে যায়, জোরে শব্দ করে হটিয়ে দেই, পায়ের উপর ইদুর চড়ে বসে লাথি মেরে দূরে ফেলে দেই। একটি চতুর ইদুর আমার প্যান্টালুনের ফাক গলে ভেতরে ঢুকে পরে, আরেক পা দিয়ে চেপে ধরে ইদুরটাকে হত্যা করি। নিজেকে বেশ বীর বীর মনে হতে থাকে। পরক্ষণেই ভয়ে আঁতকে উঠি হিটলারের মানবতাবাদীরা আমার উপর প্রাণী হত্যার অভিযোগ এনে প্রাণ দন্ড দেবেনাতো।
আমি মৃত ইদুরটাকে লুকানোর ব্যর্থচেষ্টা করি, কখনো পিঠের তলে কখনো প্যান্টালুনের ভেতর। ইতিমধ্যে আরেকটি ইদুর আমার পা কামড়াতে কামড়াতে প্যান্টের ভেতর ঢুকে পরে। বিরক্তিকর শুরশুরি দিয়ে আমার শরীর নেচে উঠে। আরেকটি পা দিয়ে ইদুরটাকে পূর্বের ন্যায় হত্যা করতে উদ্যোত হই কিন্তু ইদুরটির সাথে পেরে উঠি না। আমি বুঝতে পারি পা আন্দোলনের জন্য যে বল দরকার সেটা আমি ইতিমধ্যে হারিয়েছি। শরীর নিস্তেজ হয়ে পরছে, ইদুর কামড়াতে কামড়াতে উপর দিকে উঠছে; যন্ত্রণায় আমার শরীর থরথর করে কাঁপছে। ইঁদুরটিকে মনে হচ্ছে বিশেষ প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত। সে আমার স্পর্শকাতর অঙ্গে কামড়াতে শুরু করছে। তীব্র যন্ত্রনায় চিৎকার করে উঠি। চিৎকারে চিৎকারে আমার গলা বসে যায়। আমি বুঝাতে পারি অসংখ্য ইঁদুর প্যান্টালুনের ফাঁক গলে ভেতরে ঢুকে পরছে শত-শত হাজার-হাজার ইদুর। তারা আমাকে কি খুবলে খেয়ে ফেলবে?
হ্যাঁ ইদুর আমাকে খেতে শুরু করেছে, পায়ের আঙ্গুল দিয়ে শুরু করেছে। আমার কিছুই করার নেই, নিজেকে ছেড়ে দিয়েছি নিয়তির উপর। মনে হচ্ছে ইদুরের আঙুল খাওয়া শেষ করে পায়ের পাতা ধরেছে। খুব দ্রুত মাংস খেয়ে হাড় খেতে শুরু করেছে, ককড় মকড় শব্দ শুনতে পাচ্ছি। আমি পা নাড়াতে পারছি না প্রচন্ড ব্যাথা, হাত নাড়াতে পারছি না পিছনে বাধা, মাথা নাড়াতে পারছি না ঘাড় শক্ত হয়ে আছে, পিঠ এপাশ ওপাশ করতে পারছি না শরীর মৃতের মতো বলহীন।
ঝাঁকে ঝাঁকে হাজার হাজার ইদুর আমাকে ঘিরে ধরেছে। তারা আমার চোখের বাঁধন কেটে দিয়েছে, সব কিছু দেখতে পাচ্ছি। বেশ বড়-সর একটি কামরা। একপাশে একটি টেবিল-চেয়ার, টেবিলের উপর ছাদ থেকে নামানো লাইনে একটি লালচে আলোর বাল্ব। হলদে রঙের দেয়াল। মোটা রডের গ্রীলের ছোট একটি জানালা, এটা দিয়ে কখনো আলো আসে বলে মনে হয় না।
জানালার রড ধরে কেউ কেউ ঘোরপ্যাঁচ খেলছে, কেউ কেউ লাফিয়ে আমার শরীরে পরছে, মেঝেতে পরছে আবার উপরে উঠে আবার লাফিয়ে পরছে, কেউবা দাঁত কেলিয়ে হাসছে।
আমি কিছুতেই এই তীব্র যন্ত্রণা সহ্য করতে পারছি না। আমি অদৃষ্টের কাছে প্রার্থনা করছি অতি সত্তর যেনো আমার মৃত্যু ঘটে, মহামান্য হিটলারের কাছে প্রার্থনা করছি মৃত্যু যেনো তরান্বিত হয়, মহা প্রভু ইদুর রাজের কাছে প্রার্থনা করছি তারা যেনো আমাকে নূন্যতম সময়ের মাঝে খেয়ে নেয়।
ইঁদুর আমার পা খেতে খেতে হাটু অব্দি এসে গেছে আর কতোটুকু খেলে আমার মৃত্যু নিশ্চিত হবে? আমি কি এমন করেছি যে ৭০/৮০ বছর আগে মরে যাওয়া হিটলার আজ এসে আমাকে ইদুর দিয়ে খাওয়াবে!
সারা পৃথিবীতে মহামারী লেগেছে। ভয়ঙ্কর এক ভাইরাস পুরো পৃথিবীটাকে উলটপালট করে দিচ্ছে, তার ঝাপটা আমাদের দেশেও লেগেছে। মানুষ মরে পরে আছে এখানে সেখানে, বাসে ট্রেনে নৌকায় ড্রেনে নর্দমায় বাসাবাড়িতে রিক্সায় চৌরাস্তায় তেমাথায়.....। সরকারী সমস্ত পরিষেবা ভেঙ্গে পড়েছে - বিদ্যুৎ গ্যাস পানি নগরপরিচ্ছন্নতা....।
মানুষ প্রথম প্রথম ঘরের দরজা জানালা বন্ধ করে দিয়ে চুপমেরে বসে ছিল।মজুদ কৃত খাদ্য ফুরুতেই লোকেরা সব রকমের সরকারি নিষেধাজ্ঞা এমন কী জারিকৃত কার্ফু ভেঙে ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে এলো।
পঙ্গপালের মতো ঝাক বেধে মানুষ ছুটে যাচ্ছিলো শহর অভিমুখে, তাদের খাদ্য চাই। বিশালাকার নগর ফটক লাখ লাখ মানুষের আন্দোলনের চাপে ভেঙ্গে পড়তেই গোলা এলো সড়ক দ্বীপে বসানো ট্যাংঙ্ক থেকে, আকাশ থেকে বৃষ্টির মতো ঝরে পড়লো মেশিন গানের ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি, মাটি ফুরে আকাশ বাতাস প্রকম্পিত করে বেড়িয়ে এলো পুঁতে রাখা ল্যান্ড মাইন।
পরদিন টিভিতে প্রসিদ্ধ বুদ্ধিজীবীরা বলতে লাগলো সরকার চমৎকার করে কিছু দুষ্কৃতকারীর ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করে দিয়েছে। এঁদের মধ্যে একটি আমার চেনাজানা বন্ধুগোছের। ওকে আমারা চেতনা কবির বলে থাকি। ছাগলটা বেশ্যার দালালী করে টাকা কামিয়ে জাতে উঠে বুদ্ধিজীবী সেজেছে। আমি এ নিয়ে ফেসবুক নামের এক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হেয়ালি করে আনমনে স্লিপ অব পেন টাইপের ভুল করে দু'লাইন লিখেছিলাম। তারা এসেছিলো আলোর অভিমুখে প্রতঙ্গের মতো, মরে গেলো প্রতঙ্গেরই মতো।
এ স্ট্যাটাসই কী আমার কাল হয়ে দাড়ালো! একদলা ইদুর জানালার উপর থেকে লাফিয়ে আমার মাথার উপর বসে পরে। আর্মি ছাট চুল মাথার একটি বড়সড় সাদা বিলাতী ইদুর আমার নাকে বসে তর্জনী নেড়ে কী যেনো বলে, চমৎকার ঝুটি বাঁধা চুলগুলো সমস্বরে দল-বল নিয়ে কাটতে কাটতে আমার মাথাটা বাটি ছাঁট করে দেয়। তাদের দেখে মনে হয় আমার চুলের উপর অনেক দিনের পুষে রাখা ক্ষোভ আজ সুযোগ পেয়ে ঝেড়ে নিলো।
ইদুর টাকে আমার চেনা চেনা মনে হয় বা আমার চেনা একজন আছে তার মুখাবয়ব এ ইঁদুরটার মতো। প্রায়শই বলে লোকটা, তুমি কি কাজি নজরুল যে তোমার মাথার চুল বাবরি দোলানো হবে? বোধকরি লোকটার এই কাজি নজরুল ছাড়া আর কারো নাম জানা নেই। প্রথম প্রথম ভাবতাম লোকটা হয়তো আমাকে ভালোবাসে তাই আমার স্বাস্থ্য নিয়ে উদ্বিগ্ন। কিছু দিন যেতে বুঝতে পারি তার বা তাদের অস্বস্তিটা কোথায়। তারা মিলিটারিকে প্রভু জ্ঞান করে থাকে।
দেশের কোনো ক্রান্তিকালের সুযোগে মিলিটারী শাসনে নামলে তারা পিছন চাপর মেরে লম্ফ দিয়ে ফুলমালা নিয়ে বের হয়ে মিলিটারির পায়ে পরে বড় একটি প্রণাম ঠুকে এসে বলে - মেজর সিনহা আমার বন্ধু মানুষ এইযে দেখেন স্যারের সাথে আমার ফটো।
নিশ্চয়ই আমি কিছু করেছি নইলে নাৎজি এতটা ক্ষেপে যাবে কেনো। আমার মনে পড়ছে না হিটলারকে নিয়ে কখনো বাজে কিছু বলেছি, নাকী কোনো চায়ের দোকানে বা বন্ধু আড্ডায়? বলবোই বা কেনো সেই সাত সমুদ্র তের নদীর পর জার্মান দেশ তা ও ৭০ /৮০ বছর পূর্বে কোথায় কি করেছে না করেছে বলতে আমার বয়েই গেলো।
তুমুল মহামারীতে আমাদের জাতীয় মানবিক পার্টির সরকার মানবতায় বিগলিত হয়ে তিন মাসের জন্য বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ জনগনের জন্য স্থগিতের নির্দেশ দেন এবং তিন মাস পর মহামারী কেটে গেলে বকেয়া বিলম্ব মাসুল মৌকুফ করে তিন মাসের বিদুৎ বিল পরিশোধে সরকার নতুন করে নির্দেশ জারি করে। আমরা আধমরা আমজনতা খুশিতে সরকারকে ধন্য ধন্য করি। অবহেলায় রেখে দেয়া আমার বিদ্যুৎ বিলগুলো খুঁজে নিয়ে চোখের সামনে ধরতেই চোখ ছানাবড়া হয়ে উঠে। প্রথম দু-মাসে যে বিল তৃতীয় মাসে তার শতগুণ বেশি! নিজেকে শান্তনা দেই নিশ্চয়ই ছাপানোয় ভুল, এ আর এমন কী।
আমি বিদ্যুৎ অফিসে গিয়ে বিল গ্রহীতাকে বাড়ির বিদ্যুৎ বিল সবিনয়ে দেখিয়ে বলি, মহাশয় মনে হচ্ছে আমাকে দেয়া করপত্রটির টাকার অংকটি ছাপানোয় ভুল উঠেছে, দয়াকরে যদি সংশোধন করে দেন কৃতার্থ হবো। কর গ্রহীতা আমার দিকে কী যেনো একটা পেয়েছি বা আবিষ্কার বা ধরে ফেলেছি রকমের দৃষ্টি দিয়ে জিগ্যেস করে, এই যে জনাব আপনি কি কবি বা স্বদেশী করেন?
আমি এরকম কিছুর জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে তাকে জানাই, না মোটেও সে-রকম কিছু নই। আমি কখনো কবিতা লিখিনি এমন কি পড়িওনি। আমি পাঠ্য বইয়ে কোনো কবিতা ছিলো না যুগের ছাত্র ছিলাম। জাতীয় মানবতা পার্টি ক্ষমতায় আসার পর ঐ রকম বাজে বিষয়গুলো তুলে দেয়া হয়।
লোকটা বলে, গপ্পো ফাঁদবেন না জনাব, আপনাকে দেখেই আমার কেমন কেমন ঠেকেছিল, তা না হলে ও রকম জামা কেনো? প্যান্টালুন ওরকম কেনো? মাথার চুল আমাদের মতো বাটি ছাট নয় কেনো? মুখের কথা ও রকম চমৎকার মায়ের কথার মতো কেনো?
আমি বলি, জনাব না তা নয় আপনি ভুল ভাবছেন, আচ্ছা আমি সব বিল যথা সময়ের মধ্যে শোধ করে দিচ্ছি।
গ্রহীতাগন দাঁত কেলিয়ে হেসে উঠে আমাকে যথেষ্ট তিরস্কারের পর বলে, আচ্ছা জনাব আপনি যে পাঠ্য বইয়ে কবিতা না থাকা যুগের ছাত্র ছিলেন আমরা কী করে বুঝবো? আরেকজন বলে, আচ্ছা ঠিক আছে আপনি স্বরবর্ণ ব্যাঞ্জণ বর্ণ যোগে গুটিকয়েক শব্দ বলে বিদায় হোন।
আমি এক নিঃশ্বাসে বলতে থাকি,
অ- তে - অজু
ট-তে- টুপি
ও- তে -ওড়না
টেবিলে পা ঝুলিয়ে বসা অনেক ইঁদুরের মাঝে দুটি ইদুরকে আমার বেশ চেনা চেনা লাগছে। তাদের দিকে ইঁদুর দেখার দৃষ্টিতে তাকালে ইঁদুর ইঁদুরই লাগছে আবার মানুষ দেখার দৃষ্টিতে তাকালে মানুষ মানুষই মনে হচ্ছে। বড়টা আমাদের চীরচেনা প্রতিবেশী বড় ভাই। বছর বছর ফেল করে এক সময় আমাদের সহপাঠী হয়ে গিয়েছিলেন। তিনিতো ব্যাস্তলোক। এখানে কী করছেন?
বর্ণাঢ্য জীবন তার। জাতীয় মানবিক পার্টির অঙ্গ সংগঠন জামাত ইউনিয়ন দিয়ে তিনি রাজনীতি শুরু করেন। বর্তমানে তিনিঁ শান্তি কমিটির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, কতো কাজ তার। কর্নেল সাহেব, মেজর সাহেব, ক্যাপ্টেন সাহেব নিয়ে তার রাতদিন ছুটাছুটি। এত ব্যাস্ততার মাঝেও তিনি গজল লিখেন -মেরে স্তান মেরে ভরতস্তান, আয় হায় হায় আয় হায় হায় ভরতস্তান।
গেয়েও শুনান। অফিসারগন শুনে একেবারে মুগ্ধ। তার পাশে বসা ভাইটু তারই অনুজ প্রতিম। তিনিও মেধায় মগজে প্রতিভায় টগবগে। শরীরে থোকায় থোকায় গোস্ত ভাপা পিঠার মতো ফুলে রয়েছে। তিনি জাতীয় মানবতা পার্টির যুব শাখার আল-বদর বাহিনীর নেতাজি। তিনি জায়গাটি বাগিয়েছেন তার গন্ডারের মতো শক্ত পোক্ত শরীর প্রদর্শন খেলায় অফিসারদের মুগ্ধ করে। তিনিও গজলে অ.সা.ধা.র.ণ।
বড়ভাইটি ছোটভাইটিকে কানের কাছে মুখ নিয়ে চিঁচিঁচিঁচিঁচিঁ স্বরে কী যেনো বললেন।
ছোট ভাইটি সূচালো মুখটা উপরে তুলে চিঁউচিঁউ শব্দ করে, বাহুর গোস্তগুলো ফুলিয়ে পিছনের লেজটি মাথার উপর ঘুরপাক খেলিয়ে এক লম্ফতে শূন্যে উঠে আমার মাথার উপর আছড়ে পরে মুষ্টিবদ্ধ দু'হাতে আমার নাকে মুখে দুমাদুম কিল-ঘুষি। নাকটি খসে পড়ে, ঠোঁট দু'খানা থেঁতলে মিশে যায়, দাঁত কপাটি মুখগহ্বরে ঢুকে যায়। আমি নিশ্চিত, লোকালয়ের কেউ আর আমাকে চিনতে পারবে না বা সকলেই আমাকে দেখে ভয়ে মুখ লোকাবে।
আমি কিছুটা আশ্চর্য হই ভাইটুর এত ক্রোধ আমার উপর! একদিন পাড়ার চায়ের দোকানে নানান কথার মাঝে আমার একটি মন্তব্য ভাইটুর জাতীয় মানবিক পার্টির বিপক্ষে চলে যায়। তিনি প্রচন্ড ক্রোধে আমার মাথায় ঘোল ঢেলে দিয়ে তার রাগমোচন করেন। সেই ক্রোধ এখনো পুষে রেখে আমার দুঃস্বপ্নে এসে হামলে পরলেন!
আমি তো বিদ্যুৎ বিল অথবা জিজিয়া কর যাই বলেন না কেনো পরিশোধ করে দিয়েছি। যদিও এর জন্য আমার সংগ্রহের সবগুলো দুস্পাপ্য বই ও প্রপিতামহের স্মৃতি বিজড়িত দূর্লভ ঝর্ণা কলমটি এবং অতি প্রিয় কথা বলা ময়না পাখিটা নিলামে তুলতে হয়েছে। তারপরেও কেনো এই নিষ্ঠুরতা? আমি বা আমার সম্প্রদায় সংখ্যায় লগু বলে?
পড়ে আছি আমার ক্ষয়িষ্ণু দেহটাকে নিয়ে। চারপাশে কিলবিল করছে হিংস্র ইঁদুরেরা, কেউ মস্তিষ্ক গিলে নিচ্ছে কেউ চোখ দুটো খুবলে খাচ্ছে কেউ বা পেট চিরে আমার নাড়িভুড়ি টেনে নিয়ে ছুটে বেড়াচ্ছে। আমি শুনতে পাই বুটের আওয়াজ, কাকে যেনো ধরে নিয়ে আসছে। ধপাস করে কেউ একজন আমার পায়ের কাছে আছড়ে পড়ে। তাকে চিনতে পারি কন্ঠস্বরে। বিবস্ত্র শরীর, উৎপাটিত কেশ, সাড়া গায়ে নিপীড়নের বিভৎস দাগ, তিঁনি যে আমাদের গায়ের সেই বুড়ি মা, ঠাহর পাওয়া সহজ নয়।
আমাদের গ্রামের দক্ষিণ কোলে তার বাস। গায়ের ছোতো বড় সকলেই তাকে বুড়ি মা বলে সম্মোধন করে থাকে। আমরা কখনো তার বাড়ি গিয়ে খালি মুখে ফিরে আসিনি, মোয়া মুড়কী বা বাতাসা কিছু একটা খেতে হয়েছে। কী করেছে বুড়ী'মা? এই বৃদ্ধাকেও হিটলারের ভয়! আমি বলি, কী হয়েছে বুড়ি মা?
তুমি আমার দুঃস্বপ্নে কী করে প্রবেশ করলে, ওরা তোমাকে ধরে এনেছে কেনো? এখানে ইঁদুরেরা তোমাকে খেয়ে নিবে কিন্তু তুমি মরবে না।
বুড়ি মা যন্ত্রনায় ককিয়ে উঠে,আহ্ কী কষ্ট আর পারছি না, আটচল্লিশ বছর হয়ে চল্ল শুকরেরা আমাকে প্রতিনিয়ত খুবলে খাচ্ছে। বৃথাই আমার মাতৃ জঠর।
রোগা হেংলা ক্ষুধার্ত ইদুরগুলো আমার বাম কান দিয়ে মাথার ভেতর মগজে ঢুকে হামলে পরে, যেনো জন্মের পর আজই খেতে পেলো। খেয়ে খেয়ে মোটাসোটা হয়ে আমার মাথা বিদীর্ণ করে ডান কান দিয়ে বের হয়ে ছুটে বেড়িয়ে যায়। গলগল করে আমার দু'কান দিয়ে রক্তের ধারা বয়ে যায়। প্রচন্ড যন্ত্রণা আহ! কী যে নারকীয় কষ্ট আর সহ্য করতে পারছি না। এরকম কষ্ট কেবল দুঃস্বপ্নেই ঘটতে পারে জাগরণে নয়!
আমি গায়ের যতো শক্তি আছে হাতের নখে সঞ্চিত করে চিমটি কেটে পিঠের মাংস ছিড়ে ফেলে পরখ করি আমি কী সত্যি সত্যিই কোনো দুঃস্বপ্নে আছি। হ্যাঁ আমি দুঃস্বপ্ন কাটাচ্ছি।
আমি জোরে চিৎকার করে বলি কেউ কী আছ আমার ঘরের দরজায় লাথি মেরে বলবে,
উঠ্ অকালকুষ্মাণ্ড সকাল গড়িয়ে দুপুর।
মা তুমি কোথায়, ঝাড়ু পেটা করে বলছো না কেনো বাঁদর ছেলে এখনো ঘুমিয়ে তুমি...
কেউ কী নেই, বাড়িতে ডাকাত পরেছে বলে হাঁক দিয়ে বলবে, কোনঠে সবাই জাগো বাহে......