আমার ফেসবুক বন্ধু মাকসুদা আকতারের এক অসাধারণ প্রফেশন আছে, তিনি একাধারে 'মিস আয়ারল্যান্ড ২০১৫' এবং একজন 'কমার্শিয়াল পাইলট', তাই আগ্রহ নিয়েই নারী পাইলটের ইতিহাস খুঁজেছি, আর তাতে অসাধারন কিছু তথ্য আবিষ্কার করেছি। নিবন্ধটি একজন মাকসুদা আকতার এর ব্যক্তিগত জীবনী হিসেবে নয় বরং একটি চ্যালেঞ্জিং প্রফেশন 'পাইলট' আর বিশ্বের নারীদের অবস্থান নিয়েই লেখা।
প্রথম নারী যিনি বিমান চালনার সাথে জড়িত ছিলেন তিনি ছিলেন মার্কিন নারী লিলিয়ান টড, তিনি ১৯০৬ সালে প্রথম একটি কমার্শিয়াল বিমানের ডিজাইন করেছিলেন। আর বাণিজ্যিক বিমানের প্রথম নারী পাইলট হয়েছিলেন, হেলেন রেচি, ১৯৪২ সালে। ২০ শতকের শেষ দিকে মহাকাশচারী আইলিন কলিন্স প্রথম নারী স্পেস শাটল কমান্ডার হন।
গত তিন দশক ধরে, বিমান শিল্পে জড়িত নারীদের সংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং আজ প্রায় প্রতিটি বিমানের পেশাগুলিতে নারীদের পাওয়া যেতে পারে। তবে, সংখ্যায় তুলনামূলকভাবে কম। উদাহরণস্বরূপ, নারী পাইলট মোট পাইলট জনসংখ্যার মাত্র ছয় শতাংশ প্রতিনিধিত্ব করে।
আজ, বিশ্বব্যাপী বিমান সংস্থাগুলি, শিক্ষার্থী এবং উৎসাহীসহ বিশ্বব্যাপী ১২.০০০ এরও বেশি সদস্য রয়েছে। সাধারণ, কর্পোরেট ও বাণিজ্যিক বিমান, শিক্ষা, সরকার ও সামরিক বাহিনী সহ বিমান শিল্পের সকল বিভাগের নারী ও পুরুষ, ওয়াইএ (WAI) সদস্যপদের জন্য যোগ্য।
মাকসুদা আকতার প্রিয়তী
এবার আরো কিছু প্রাথমিক তথ্য যোগ করি আগ্রহী পাঠকদের জন্যে: ১৭ ই ডিসেম্বর, ১৯০৩ সালে রাইট ব্রাদার্স প্রথম মেশিন চালিত বিমানটি নিয়ে আকাশে ওড়ে একথা আমরা স্কুলে পড়েছি। তবে সেই মহান ইভেন্টে এর ১০০ বছর পুর্তি উপলক্ষে ডিসেম্বর ১৭, ২০০৩ তারিখে শত বছরের বিমান ফ্লাইটের সম্মাননায়, এভিয়েশন ইন্টারন্যাশনাল এ নারীরা একটি অনন্য দিন উদযাপন করেন। তাতে পায়নিয়ার হলের অব ফেমের সাধারণ মহিলা বা গোষ্ঠীগুলিকে অন্তর্ভুক্ত করার উদ্যেশ্য নিয়ে, তাঁরা ১০০ জন নারীকে শ্রদ্ধা জানায় যারা বিমানের প্রথম ১০০ বছরের মধ্যে একটা বিরাট পার্থক্য তৈরি করেছিলেন।
১৯০৩ সালের আগেও মুক্ত আকাশে ওড়ার আকাঙ্ক্ষায় মানুষ সেই ১৭৮৪ সাল থেকেই উষ্ণ বায়ুর বেলুনে চড়ে আকাশ পথে বিচরণ করেছে। আর তাতেও নারীদের ভুমিকা অসাধারন ছিলো।
১৭৮৪ সাল থেকে নারীরা এয়ার এভিয়েশন ও মহাকাশ শিল্পের অগ্রগতিতে অবদান রেখেছে। বিশ্ব স্তরে তাদের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সাফল্যের তালিকা এখানে রয়েছে।
ফ্রান্সের দুই ভাই জোসেফ-মাইকেল ও জ্যাকস-ইটিয়েন মন্টগোলিয়ার ফ্রান্সের একটি ছোট্ট শহরে প্রথম একটি গরম বায়ু ভর্তি বেলুন তৈরি করেন এবং সেটি নিয়ে প্রথম ১৭ সেপ্টেম্বর ১৭৮৩ সালে জনসমক্ষে এটি প্রদর্শন করেন, যা দিয়ে তাঁরা ১০ মিনিট আকাশে উড়ে এক রেকর্ড স্থাপন করেছিলেন।
১৭৮৪ -গরম বায়ু ভর্তি বেলুন এর ফ্লাইটের প্রথম নারী সহকারী পাইলট মারি এলিজাবেথ থিবেল, ফ্রান্স।
১৭৯৮ -ফ্রান্সের জেনি ল্যাবরোস প্রথম উষ্ণবায়ু বিমানটি চালানোর জন্য প্রথম নারী।
১৭৯৯ -প্যারাশুট জাম্পের প্রথম মহিলা -ফ্রান্সের জেনি ল্যাবরোস।
১৯০৩ -মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আইডা ডি অ্যাকোস্টা - প্রথম মোটরবাইক প্যাডেল বিমানটি চালায় প্রথম নারী।
১৯১০ -পাইলট লাইসেন্স অর্জনের প্রথম নারী -ফ্রান্সের রেমোন্ড দো লারশ।
১৯১১ - প্রথম এয়ার প্লেন রেস প্রতিযোগিতায় জয়ী হেলেন ডুট্রউ, বেলজিয়াম/ফ্রান্স।
১৯১২ -ইংলিশ চ্যানেলে উড়ে যাওয়ার প্রথম নারী -আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের হ্যারিটি কিম্বি।
১৯১৩ -প্রথম কমিশন নারী বিমানের পাইলট -ক্যাথরিন স্টিনসন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
১৯১৪ -প্রথম নারী একটি বায়ুবেষ্টিত আবর্তক (লুপ) উড়ে -রাশিয়ান, লিডিয়া যোরেভা।
১৯১৫ -প্রথম নারী যুদ্ধ জাহাজ নিয়ে উড়েছেন -মারি মারভিং, ফ্রান্স।
১৯২১ -পাইলট লাইসেন্স পেলেন প্রথম কালোবর্নের নারী -বেসি কোলম্যান, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র।
১৯২৭ -প্রথম নারী বিমান পরিবহন সংস্থায় নিয়োজিত পাইলট -মার্গা ভন এটজডর্ফ, জার্মানি।
১৯২৯ -প্রথম নারী ফিল্ম স্টান্ট পাইলট -ফ্লোরেন্স লোয়ে বার্নস, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র।
১৯৪০ -প্রথম মহিলা পাইলট যিনি ফ্লাইটে একটি উড়ন্ত বিমান থেকে অন্য একটি বিমানে জ্বালানী দেওয়ার রেকর্ড করলেন, এলিনর স্মিথ ও ইভলিন ট্রাউট, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র।
১৯৩৪ -প্রথম নারী সামরিক ফ্লাইট একাডেমির পরিচালক -রাশিয়ার মারিনা মিখাইলভা।
১৯৩৫ -প্রথম প্রশংশিত ফ্লাইট নার্স -মারি মারভিং, ফ্রান্স।
১৯৩৭ -যুদ্ধে একটি যুদ্ধ বিমান (ফাইটার এয়ারক্রাফট) উড়ে যাওয়ার প্রথম মহিলা -সাবিহা গোকেন, তুরস্ক।
১৯৩৭ -হেলিকপ্টার চালানোর প্রথম নারী পাইলট - হানা রাইটস, জার্মানি।
১৯৪৩ -প্রথম ও একমাত্র নারী এস পাইলট। শিরোনাম গ্রহণ করেন -লাদিয়া লিটভিয়াক এবং কাটিয়া বুদানোভা, রাশিয়া
১৯৪৪ -জার্মানির একটি জেট পাইলট -হানা রাইটস, প্রথম নারী
১৯৪৮ -প্রথম নারী কৃষি খামারে চালিত প্লেন পাইলট -ব্রাজিলের অ্যাডা রাগাতো
১৯৫৩ -সাউন্ড বাধা ভেঙে (super sonic speed) প্রথম মহিলা -আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের জ্যাকলিন কোচরান।
১৯৫৫ -ফ্রান্সের জ্যাকলিন অরিওল -প্রশিক্ষণ ও পরীক্ষার পাইলট লাইসেন্স দানকারী প্রথম নারী পাইলট।
১৯৬৩ -প্রথম নারী মহাকাশে উড়ে গেলেন -ভ্যালেন্টিনা তেরশকোভা, রাশিয়া।
ভুলে যাওয়া অবদানকারীদের মধ্যে একজনের নাম উল্লেখযোগ্য তিনি হলেন প্রথম মোটর চালিত এয়ার ক্রাফট এর রাইট ব্রাদার্স দের একমাত্র বোন ক্যাথরিন রাইট।
ক্যাথরিন রাইট প্রথমে তার ভাইদের সাথে ১৯০৯ সালে ফ্রান্সে প্রথম কমার্শিয়াল যাত্রা করেছিলেন। ক্যাথরিন ফ্রান্সের ব্যারোনেস রেমোন্ড দো লোরাখ এর অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন, যিনি ১৯০৯ সালে একাকী এবং বিশ্বজুড়ে প্রথম নারী পাইলট ছিলেন। ১৯১০ সালে তার পাইলট লাইসেন্স পেয়েছিলেন।
বিমান শিল্পে নারীদের উন্নয়নে দৃঢ় অঙ্গীকারের কারণে, ওয়াইআই ব্যাপক স্বীকৃতি অর্জন করেছে। এই স্বীকৃতি NASA, FAA, ESA এবং অন্যান্য সংস্থার সাথে অংশীদারির সাথে যুক্ত ছিলো।
বিমানের পাইলটের ক্ষেত্রে নারী অংশগ্রহণ বছর বছর বৃদ্ধি পেয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, ১৯৩০ সালে প্রায় ২০০ নারী পাইলট ছিলো, কিন্তু পাঁচ বছরে ৭০০ এর বেশি হয়েছেন। বিশ্বব্যাপী বিমানের নারী পাইলটের সংখা বৃদ্ধিতে 'এয়ার নিউজ' রিপোর্ট করেছে যে ১৯৮০ সালের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নারী পাইলটের জন্য লিঙ্গ সমতা বৃদ্ধির বিষয়টি আলোচিত হয়েছে। ভারতে বাণিজ্যিক বিমান সংস্থা উড়ন্ত সব পাইলট এর সংখ্যা এখন ১১.৫% আর ইউরোপে তা ১০% নারী বিমান সংস্থাগুলির বিশ্বব্যাপী সংখ্যা ৫%।
ফারিয়া হোসেন লারা বাংলাদেশের একজন নারী প্রশিক্ষক বৈমানিক ছিলেন। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রশিক্ষক বৈমানিক। কিন্তু তিনি ১৯৯৮ সালের ২৭শে সেপ্টেম্বর প্রশিক্ষণ উড্ডয়নের সময় নিহত হন। ১৭ ডিসেম্বর ২০১৪ সালে প্রথম দু’জন নারী বৈমানিক প্রথমবারের মতো যুদ্ধবিমান নিয়ে আকাশে উড়েছেন তাদের নাম নাইমা হক এবং তামান্না-ই লুতফী।
মাকসুদা আকতার বাংলাদেশ বংশদ্ভূত আইরিশ নাগরিক, ২০১২ সালে প্রাইভেট পাইলট লাইসেন্স এবং ২০১৪ সালে কমার্শিয়াল পাইলট লাইসেন্স অর্জন করেন।
এই নিবন্ধটি পাইলট মাকসুদা আকতারকে উৎসর্গ করে, আর শুভেচ্ছা কামনা করে, প্রাণঢালা অভিনন্দন জানাই।