মাস কয়েক আগে আমাদের রেলমন্ত্রী যমজ সন্তানের পিতা হয়েছেন। এবং এ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনাও তৈরি হয়েছে। এটা বাংলাদেশের ক্ষেত্রে খুবই স্বাভাবিক যেহেতু আমাদের সংস্কৃতি(!) হচ্ছে অন্যের ব্যক্তিগত ব্যাপারে নাক গলানো। আর তিনি যদি পাবলিক ফিগার হন তাহলে তো কথাই নেই। অনধিকার চর্চা বলে একটা বাগধারা রয়েছে তা এদেশের অধিকাংশ জনগণ জানে বলে মনে হয় না। কেননা আমাদের দেশের মতো আমাদের সংস্কৃতিও যে দরিদ্র। তো মন্ত্রী মহোদয়ের এরূপ কাণ্ডের(!) পক্ষে-বিপক্ষে দুইটি দলের আবির্ভাব পরিলক্ষিত হয়েছে। বিপক্ষ দল বুঝাতে চেয়েছেন যে, ঊনসত্তর বছর বয়সে বাবা হওয়াটা 'লজ্জাজনক'। অনেকে আবার উপহাসচ্ছলে ছেলে দুটো আদৌ মন্ত্রীর কী না তা নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। অপরদিকে, পক্ষের দলটি বিপরীত দলকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে বলেছেন, তারাও যেন ঐ বয়সে সন্তান জন্ম দানে নিজের 'সক্ষমতা' প্রমাণ করেন। মুজিবুল হক যৌবনদীপ্ত বলেই তা পেরেছেন ইত্যাদি ইত্যাদি...।
লক্ষ্যণীয় যে, উভয় পক্ষই পিতৃত্বকে কৃতিত্ব হিসাবে দেখেছেন। কারণ এর সাথে যৌনতা, কামনা ইত্যকার ব্যাপার-স্যাপার সম্পৃক্ত বিধায় এত উক্তি আর কটূক্তি। তাছাড়া পুরুষতান্ত্রিক সমাজে 'পৌরষ' প্রমাণের অন্যতম নির্দেশক হচ্ছে যৌনতা। আর তাই যে ব্যক্তির যত বেশি সন্তান তিনি তত বেশি গর্ববোধ করেন। বাংলাদেশে জনসংখ্যা বিস্ফোরণের কারণে সরকার কম সন্তান নিতে উৎসাহ প্রদান করছেন। আবার বর্তমান সময়ে সন্তান লালন-পালন কষ্টের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে বিধায় দম্পতিরা কম সংখ্যক সন্তানের জন্ম দিচ্ছেন। আমি হলফ করে বলতে পারি, এসব না থাকলে পুরুষরা বাবা হবার প্রতিযোগিতায় আঁটসাঁট বেঁধে নামতেন (আমাদের নানা-দাদাদের আমলের মতো)।
অন্যদিকে, কোন দম্পতি যদি সন্তান উৎপাদন করতে না পারেন বা কেবল একটি সন্তান জন্ম দেন তাহলে সব দায় পড়ে নারীটির ঘাড়ে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নারীদের অবদমিত করার জন্য এই চাল চালে। আর তাই এসকল নারীকে বন্ধ্যা, কাকবন্ধ্যা ইত্যাদি বিশেষণে বিশেষিত করা হয়, যেখানে পুরুষদের বেলায় এরূপ বিশেষণ আদৌ আছে কী না আমি জ্ঞাত নই। এমনকি কন্যা সন্তান জন্ম দিলেও দোষী সাব্যস্ত করা হয় তার জননীকে। তবে হ্যাঁ, একটা ব্যাপারে পুরুষদের অবজ্ঞা করা হয়, আর তা হলো 'যৌনতা'। তাই যে পুরুষের তা নেই তাকে তাচ্ছিল্যের সুরে 'নপুংসক' আখ্যা দেয়া হয়। কটাক্ষ করে অনেকে 'হিজড়া'-ও বলে থাকেন। আর দশ জন মানুষের মতো যতই তাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ স্বাভাবিক থাকুক; অস্বাভাবিক যৌনাঙ্গ হেতু সমাজে হিজড়াদের স্থান নেই । আর এজন্যই তাদেরকে বলা হয় সামাজিক প্রতিবন্ধী। বাংলাদেশের মানুষ যেখানে শারীরিক বা মানসিক প্রতিবন্ধীদের প্রতি সদয় আচরণ দেখাতে জানে না (যদিও ইদানীং অবস্থার কিছুটা ব্যতিক্রম পরিলক্ষিত হয়) সেখানে 'সামাজিক প্রতিবন্ধী'দের সাথে কিরূপ ব্যবহার দেখায় তা বলাই বাহুল্য। উল্টো বলা যায়, এরূপ নামকরণ করাই হয়েছে হিজড়াদের প্রতি সমাজের চরম নিষ্ঠুরতার কারণে যেহেতু সমাজ তাদেরকে যৌন প্রতিবন্ধী গণ্য করে। অপরদিকে, নারীদের যৌনতা অনুপস্থিত থাকলে তাদের জন্য এ ধরণের কোনো বিশেষ নামের উপস্থিতি পরিগ্রহ করে নি পুরুষতান্ত্রিক সমাজ। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, সন্তান জন্ম দেবার ব্যর্থতা(!?) নারীর আর যৌন ব্যর্থতা(!?) পুরুষের। অর্থাৎ 'যৌনতা' পুরুষদের থাকা বাঞ্ছনীয়, নারীদের থাকতে নেই। কারণ যৌনতাকে ক্ষমতা, শক্তি, অহম ইত্যাদি হিসাবে দেখা হয়। তত্রাচ ধর্মে কামনাকে নিয়ন্ত্রণ বা লুকিয়ে রাখার কথা বলা হয়েছে। এমনকি এরূপ চিন্তা থেকেও দূরে থাকতে বলা হয়েছে। তাই তা প্রকাশে কোনো কৃতিত্ব থাকতে পারে না, বরং অন্তঃশীলতাতেই কৃতিত্ব। আর যারা ধর্মকে এক্ষেত্রে মানতে নারাজ তারা তাহলে যৌনকর্ম জনসম্মুখে না সেরে অগোচরে কেনো সারেন?
আরেকটি অদ্ভুত ধারণাও এ সমাজে বিরাজমান, যমজ সন্তানের পিতার নাকি যৌন ক্ষমতা(!?) বেশী। প্রকৃতপক্ষে একই সাথে একাধিক শিশুর জন্ম হয় তখনই যখন একই সময়ে ভিন্ন ভিন্ন শুক্রাণু ভিন্ন ভিন্ন ডিম্বাণুর সাথে মিলিত হয় বা একটি শুক্রাণু দ্বারা একটি ডিম্বাণু নিষিক্ত হবার পর বিভক্ত হয়ে যায়। একটু চিন্তা করলে আস্তিকরা দেখতে পাবেন যে ঈশ্বরই জন্মদাতা, তাই সকল কৃতিত্ব তার। তার অনিচ্ছায় কেউ মা-বাবা হতে পারবেন না যতই যৌন ক্ষমতা(?) সম্পন্ন হোন। নাস্তিকরা মগজ খাটালে বুঝবেন তারাও প্রকৃতির খেয়াল মেনে নিতে বাধ্য। বরং আমি মনে করি জন্মদানে কোনো বাহাদুরি থাকতে পারে না। কেননা মানুষ পিতা-মাতা হতে চায় নিজের স্বার্থে। কেউ বংশের নাম সমুজ্জ্বল রাখতে, কেউবা বৃদ্ধকালে দেখ ভালের খাতিরে, আবার কেউ নিজের সন্তুষ্টির জন্য পৃথিবীতে মানুষ আনে। আদতে মানুষ খেলনা জ্ঞান করে অপর মানুষকে কঠিন এই ধরণীর বুকে বিচরণ করায়। সক্রেটিস বলেছিলেন, "কত বেশী জিনিস ছাড়া আমি চলতে পারি।" অর্থাৎ, একজন মানুষ কত কম জিনিসের উপর নির্ভরশীল থেকে জীবন অতিবাহিত করতে পারে সেটাই তিনি দেখতে চেয়েছেন। এক্ষেত্রে বাক্যটি উদ্বৃত্ত করেছিলেন মূলত কৃতিত্ব বা স্বয়ংসম্পূর্ণতার মর্মার্থ বুঝাতে। তার এই বাণীটি আমলে নিলে বলা যেতে পারে যে, সন্তান জন্ম দেওয়া কীর্তি নয়; কমতির পর্যায়েই পড়ে।
যদি কেউ কীর্তিমান থেকেই থাকে, সে হলো 'নারী'। কারণ গর্ভধারণ করতে, গর্ভকালীন সময়, জন্মদানের সময়, এর পরবর্তী সময়সহ মোটামুটিভাবে সারা জীবন তাকে তার সন্তানের জন্য পুরুষের চেয়ে অধিক কষ্ট করতে হয়। বলা যেতে পারে প্রতিটি শিশুর জন্মক্ষণে একবার করে তার জনয়িত্রী মৃত্যুদ্বার পরিদর্শন করে আসেন। পরন্তু তার এই মাতৃত্বের স্বাদ নেওয়ার পেছনে অন্যতম স্বার্থ হচ্ছে জীবনের 'পূর্ণতা' পাওয়া। পুরুষতান্ত্রিকতা নারীদের পূর্ণতার লেবাস সেঁটে দেয় তাদের মাতৃত্বের মাঝে। শিক্ষা-দীক্ষা, জ্ঞান-গবেষণা, ঐশ্বর্য, স্বনির্ভরতায় নারীরা যতই পরিপূর্ণ হোক না কেনো প্রসূতি হতে না পারলে তারা যেন অপূর্ণই থেকে যায়। পুরুষদের অভিলাষে নারীরা হয় সম্পূর্ণ আর অসম্পূর্ণ! আমার প্রিয় লেখক হূমায়ুন আজাদের সুরে সুর মিলিয়ে বলতে চাই, "আমি তাদেরকে হিংসা করি যারা এখনো জন্মলাভ করে নি।" আমি তাই পূর্ণতা খুঁজি পুরুষতান্ত্রিক সমাজের 'অপূর্ণতা'র মাঝে।