সৈয়দা সুমাইয়া ইরা

চাকুরীজিবি, নারীবাদী।

নারীর সতীত্ব নামে নিকৃষ্ট ট্যাবু

নারীর সতীত্ব বলতে বোঝায় অক্ষতযোনী। চিকিৎসা বিজ্ঞানে বলে হাইমেন Hymen: হচ্ছে এক ধরনের পর্দা, যা বহিঃযোনী পথকে আংশিকভাবে ঢেকে রাখে। বয়স বাড়ার সাথে সাথে এটার আকৃতিও বাড়তে থাকে। এটাকে সতী-পর্দাও বলা হয়ে থাকে। কথিত আছে যে, মেয়েদের সতীত্ব (Virginity) পরীক্ষা করা হয় এই হাইমেন পর্দার অবিচ্ছেদ্যতার উপর, যদিও এই হাইমেন পর্দাটি শারিরীক পরিশ্রম, মাসিকের সময় ব্যবহৃত প্যাড বা তুলা, দৌড়- ঝাঁপ, সাইকেল চালানোর কারণেও ছিড়ে যেতে পারে। 

কিন্তু মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা এমনকি উপমহাদেশেও নারীর সতীত্ব নামে এই বর্বর প্রথা বিদ্যমান। কিশোরী তরুণীর শরীর নিয়ে উদ্বিগ্ন অনেক সমাজ, ওই সমস্ত সমাজ চায় পুরুষের জন্য প্রস্তুত থাকবে একটি দেহ, কাঁচের পাত্রের মতো যত্নে রাখবে শরীর যাতে তাদের রন্ধ্রের ঝিল্লির একটি তন্ত্রও না ছিঁড়ে। তরূণীকে রক্ষা করতে হবে তার সতীত্ব। পিতৃতন্ত্র পুরুষের সততা নিয়ে উদ্বিগ্ন নয়, পুরুষের সততা ভিন্ন ব্যাপার! নারীর সতীত্ব হচ্ছে তার অক্ষত সতীচ্ছদ। পিতৃতন্ত্রকে সে শ্রেষ্ঠ যে উপহারটি দিতে পারে তা একটি অটুঁট সতীচ্ছদ। মধ্যপ্রাচ্য ও তার আশেপাশের অঞ্চলের মুসলমান পিতৃতন্ত্র এখনো নারীর সতীত্ব সতীচ্ছদের বিভীষিকা জাগানো গুরুত্ব দেয়। যার জন্য প্রতিটা নারী বাস করে দোজখের ভীতির চেয়ে ভয়ানক ভীতির মধ্যে। ভূমধ্যসাগরীয় পুরুষদের সবচেয়ে মুল্যবান সম্পদের একটি হচ্ছে অটুঁট যোনীচ্ছদ সম্পন্ন একটি কুমারী নারী, যাকে এর আগে কোন পুরুষ ছোঁয় নি। সেখানে পুরুষের মর্যাদা অবস্থিত নারীর দু- উরুর মাঝখানে। প্রকৃতিকে বা পর্বত জয় করে তারা পায় না মর্যাদা, তারা নারীদের নিয়ন্ত্রণ করে আয়ত্ত করে মানসম্মান। সেখানে পুরুষ চায় নারীর সতীত্ব, চায় তার অক্ষত যোনী। ওই পুরুষেরা চায় নারীরা হবে সতী কিন্তু তারা নিজেরা লিপ্ত হবে অবৈধ যৌন সম্পর্কে।

শুধু সতীচ্ছদ থাকলেই হবে না সতীচ্ছদকে হতে হবে বিশুদ্ধ, বাসর রাতে ওটাকে প্রচুর রক্তপাত করিয়ে প্রমাণ করতে হবে যে তার অধিকারিণী ছিলো পরম সতী। বিছানার সাদা চাদরে পড়তে হবে রক্তের দাগ। কোনো কোনো মেয়ের পর্দা এতোই পাতলা হয় যে তা হাঁটতে দৌড়াতে ছিঁড়ে যাইতে পারে, সেও প্রমাণ করতে পারবে না সে সতী। কোনো কোনো মেয়ের পর্দাটি নাও থাকতে পারে, সে প্রাকৃতিক ভাবেই অসতী।
চিকিৎসকরা বলেন- সুষ্ঠু যোনীচ্ছদ নিয়া জন্মে মাত্র ৪১.৩২% মেয়ে, ১১.২% মেয়ের কোনো পর্দাই থাকে না, ১৬.১৬% মেয়েদের পর্দা এতোই পাতলা থাকে যে তা ছিঁড়ে যায় খুব সহযে, আর ৩১.৩২% মেয়ে জন্মে মোটা পর্দা নিয়ে ওই পর্দাটি আঙুল বা শিশ্ন দিয়া ঘাটলেও রক্ত বের হয় না। কিন্তু সতীচ্ছদ পাগল পুরুষরা চায় সব বাসরশয্যা হবে যুদ্ধ ক্ষেত্রের মতো রক্তাক্ত। সেখানে স্বামী বিছানায় রক্ত না পেলে স্ত্রীকে নিয়ে আসে চিকিৎসকের কাছে পর্দাটি আছে কিনা পরীক্ষা করার জন্য।

পিতামাতা চায় তাদের মেয়ের জন্য একটি যোনীচ্ছদ সার্টিফিকেট! আরব সমাজে সমাজে নারীর দেহের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রত্যঙ্গ তার যোনীচ্ছদ, তা তার চোখ, হাত বা পায়ের থেকেও অনেক মুল্যবান। মেয়ের একটি চোখ বা হাত নষ্ট যতোটা না কষ্ট পায় তারচেয়ে বেশী কষ্ট পায় পিতামাতা তার মেয়ের সতীচ্ছদ নষ্ট হলে। বাসর রাতে যে মেয়ে প্রচুর রক্তক্ষরণ ঘটিয়ে প্রমাণ না করতে পারে সে সতী, সে তালাক পায়, মৃত্যুও তার অবধারিত। ও নিয়া তৈরি হয় বড় কেলেঙ্কারি, নষ্ট হয় বংশের মর্যাদা। পরিবারটা ডুবে যায় ডুবে যায় অপমানে যা শুধু মোছা সম্ভব রক্ত দিয়ে। তারা বিশ্বাস করে আল্লা মেয়েদের যোনীচ্ছদ দেয় সতীত্ব রক্ষা করার জন্য, মেয়েদের দায়িত্ব ওই পর্দাটি পুরুষকে উপহার দেয়া।

বাসররাতে সেখানে প্রতিটি বধুকে দিতে হয় রক্তাক্ত সতীত্বের পরীক্ষা। স্বামীটি নিজের শিশ্ন বা আঙুল দিয়ে যোনী খুঁড়ে দেখতে পারে, কিন্তু অনভ্যস্ত যুবকেরা সবসময় ঠিক মতো কাজটা করতে পারে না তাই মিশরে আছে 'দায়া' বা 'নারী হাজাম', যাদের কাজ মেয়েদের খৎনা করানো এবং বাসর রাতে সতীচ্ছেদ ছেঁড়া। তারা দেখতে কুৎসিত, হাতে রাখে বড় বড় নখ যা তাদের পেশার জন্য দরকার। দায়াকে পারিশ্রমিক ঘুষ দেয় মেয়ের বাবা মা, যাতে সে নখ দিয়া গভীর করে খুঁড়ে যোনীর দেয়াল ছিন্নভিন্ন করে রক্ত বের করে প্রমাণ করে দেয় তাদের মেয়ে সতী। বাসর ঘরে ঢোকে দায়া, বাইরে উদ্বিগ্ন হয়ে অপেক্ষা করে মেয়ের বাবা মা আত্নীয়স্বজন। মেয়ের সতীত্বের বা অসতীত্বে দেয়াতে কোনো কিছু যায় আসে না, সে জানে সতী প্রমাণ হলে তার মিলবে প্রচুর টাকা, তাই সে তার নোংরা আঙুল ঢুকায় মেয়ের যোনীতে, মেয়েটার ভাগ্য ভালো হলে অল্পতেই বেরিয়ে আসে রক্ত, দায়া সেই রক্তে ভেজায় সাদা রুমাল। যদি সহজে না বেরোয় সে তার দীর্ঘ নখ ঢুকায়া দেয় মেয়ের যোনীর দেয়ালে, খুঁড়ে ফেলে দেয়াল, ফিনকি দিয়ে বের হয় রক্ত আর ওই রক্তভেজা রুমাল তুলে দেয় মেয়ের পিতার হাতে। পিতা মেয়ের যোনীর রক্তে ভেজা রুমাল পতাকার মতো উড়িয়ে ঘোষণা করে মেয়ের সতীত্ব, হর্ষধ্বনি দিয়ে উঠে আত্মীয়রা। মেয়েটি বিছানায় কাতরাতে থাকে, রক্তে তার মহাজগত ভিজে যায়। কিন্তু পুরুষতন্ত্রকে সে একটি সতীত্ব দিয়ে পেরে সে ধন্যবোধ করে। এমনই বর্বর এই পুরুষতন্ত্র সমাজের সতীত্ব নামক ট্যাবু। 

এই ট্যাবু ভেঙে ফেলতে হবে।

2978 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।