আরও একটা নারী দিবস। আরও একবার নারীর জন্য 'নারী'র কাছে আশ্রয়। আশ্চর্যের হলেও এটাই সত্যি, এই একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়েও আমাদের সমাজ-মানসে নারী এখনও দাসী, নারী এখনও সম্পত্তি মাত্র। এবং আমার ভারতবর্ষের শীর্ষ আদালতকে মনুষ্যত্ব বিরোধী এই মানসিকতার বিরুদ্ধে রায় দিতে হয়। নারী দাসী নয়, নারী কোনও অস্থাবর সম্পত্তি নয়, তাকে বাধ্য করা যায় না... একটা মামলার প্রক্ষিতে ভারতের শীর্ষ আদালত এই রায় দিয়েছে। সাধুবাদ। স্বাগত।
যার কেউ নেই, যার কিছু নেই, যখন আমাদের আর কোনো উপায় থাকে না, আমরা এই বিচারব্যবস্থার উপরই ভরসা রাখি। সমাজের সেসব আচরণ মনুষ্যত্বের অবমাননা করে, অসহায় মানুষগুলি এই আদালতেই তাকে অপরাধ বলে প্রতিষ্ঠা করার দাবি রাখে। কিন্তু বিচারবিভাগের প্রতি সম্মান জানিয়েও বলতে হচ্ছে, মানুষ তার আস্থার মূল্য সবসময় পায় না। অনেক ক্ষেত্রেই আদালতের বিচারেও আমাদের সমাজ মানসিকতার প্রতিচ্ছবিই পুনঃপ্রতিষ্ঠা লাভ করে।
মেয়েদের অধিকার নিয়ে কিছু বলতে গেলেই তার পোশাক নিয়ে টানাটানি হয়। পোশাক যেন প্রয়োজনের থেকে বেশিই গুরুত্বপূর্ণ, অবশ্যই মেয়েদের ক্ষেত্রে! সেই জন্য বম্বে হাইকোর্ট রায় দিতে পারে, পোশাকের উপর দিয়ে স্পর্শ করলে, অথবা যৌনাঙ্গ প্রদর্শন করলে, তা যৌন নিগ্রহ নয়। শিশুকন্যার প্রতি যৌন নির্যাতনের দুটি মামলায় এই রায়। আরও তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়, এই রায় দিচ্ছেন একজন মহিলা বিচারপতি।
যদিও এই রায় সুপ্রিম কোর্ট স্থগিত করেছে, তবে আমাদের প্রশ্ন শেষ হয়নি। সব নিগ্রহই দেহে চিহ্ন রাখে না। কটূক্তি, কদর্য আচরণ, মনুষ্যত্বের অবমাননা, ব্যক্তিত্বের অমর্যাদা, নারীত্বের অসম্মান দেহে কোনও চিহ্ন রাখে না। অশ্লীল ইঙ্গিত, শারীরিক আকার-ইঙ্গিতে ধর্ষণ-নিগ্রহের ইচ্ছা প্রকাশ শরীরে দাগ না রাখলেও মনে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করে। এগুলো তাহলে অপরাধ নয়?
এবার পরের ধাপ। ধর্ষণ যদি পোশাক খুলেই হয়, শরীরে যদি তার চিহ্নও থাকে, তার শাস্তি কেমন হওয়া উচিত? প্রায়শই দেখা যায়, কেবল খাপ পঞ্চায়েত নয়, আদালতও আবেদন করে, ধর্ষক যদি ধর্ষিতাকে বিয়ে করে তাহলে অপরাধ মাফ হয়ে যাবে। অর্থাৎ, ধরেই নেওয়া হয়, ধর্ষণের একমাত্র ক্ষতি মেয়েটির সতীত্বহানি। এবং যেহেতু মেয়েরা এক প্রকার সম্পত্তি এবং তার একমাত্র মালিক কোনো পুরুষ, তাই ধর্ষক নির্যাতিতার স্বামী হতে রাজি হলেই মেয়েটির সতীত্ব ফিরে আসে। অপরাধেরও আর কোনো অস্তিত্ব থাকে না।
এখানে প্রশ্ন, মেয়েদের কি কোনো ইচ্ছা অনিচ্ছা নেই? ঘেন্না, গা-গোলানো নেই? কোনও নির্যাতিতা তার নির্যাতনকারীকে জীবনসঙ্গী হিসেবে গ্রহণ করবে কেন? নির্যাতনকারীকে বিয়ে করার বিধান, এ কোন বিচারের বাণী! তাও আবার একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে, সভ্য দেশে! কই, গৃহস্থকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নির্দেশ দিয়ে তো চোরের বিচার শেষ হয় না! খুনিকে তো বলা হয় না নিহতের পরিবারের দায়িত্ব নিলে অপরাধ মাফ হয়ে যাবে! তাহলে ধর্ষণ হলে টাকা বা বিয়ের ব্যবস্থাপনায় অপরাধ মাফ হয় কীভাবে? উল্টে কেনো আইন হয় না, ধর্ষক যদি চাকুরীজীবী হয় তাহলে তার চাকরি চলে যাবে। ধর্ষকের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার আইন কেনো তৈরি হয় না? এক্ষেত্রে চাকরি অথবা সম্পত্তি পুরুষের বলেই কি তাতে আদালতও হস্তক্ষেপ করে না? আমাদের সম্মানীয় আদালতও কি পুরুষতন্ত্রের ধ্বজা উড়িয়ে চলে?
নারী কারও সম্পত্তি নয়, কেবল যৌনসামগ্রী নয়, শুধু যৌনতার মাপকাঠিতে তার অস্তিত্ব বিচার করা যায় না, এই কথাটি আমরা আজও বুঝবো না? আর এই কথাটি যদি আদালতও না বোঝে, আমরা তবে কোথায় যাব?