সারথি বিশ্বাস

প্রাথমিক স্কুল শিক্ষক, পশ্চিম বঙ্গ।

যুদ্ধের সাজে নারীর সংখ্যা নগণ্য হলেও যুদ্ধের সাজায় নারী অগণ্য

লি ওক-সিয়ন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ১৪ বছরের এক কিশোরী। তাঁকে তুলে নিয়ে গেলো জাপানি সেনা। রাখা হলো কমফোর্ট জোনে, কমফোর্ট উইমেন করে। শুরু হলো যৌন নির্যাতন। মারধরের পাশাপাশি লাঠি, চাকু ও ছুরি দিয়ে চললো শারীরিক নির্যাতন। কমফোর্ট স্টেশনে তাঁর মতো অনেক মেয়েই অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করছে। লি ওক-সিয়ন অপেক্ষা করলেন যুদ্ধ শেষের। একসময় দুঃস্বপ্নের দিনগুলির অবসান হলো, বহু ক্ষয়ক্ষতির চিহ্ন রেখে যুদ্ধ শেষ হলো। কিন্তু যুদ্ধ শেষ হবার আগেই অনেক মেয়ে ঢলে পড়লো মৃত্যুর কোলে। আর, শরীরে ও মনে ভয়াবহ ক্ষত নিয়ে আরও অনেকের মতো বেঁচে রইলেন লি ওক-সিয়ন। বহুদিন তিনি নিজের পায়ে ভর দিয়ে হাঁটতে পারেন নি। সিফিলিসে আক্রান্ত হওয়ায় কেটে বাদ দিতে হয়েছিলো তাঁর জরায়ু। যুদ্ধ তাঁর নারীত্ব ভূলুণ্ঠিত করেছিলো, কেড়েছিলো তাঁর মাতৃত্ব। পর করেছিলো তাঁর আপন দেশ। ষাট বছর বসয় পর্যন্ত তিনি মাতৃভূমিতে ফিরতে পারেন নি, সমাজের সমর্থন পান নি। 

লি ওক-সিয়ন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ক্ষত বহনকারী এক নারী। চাল ঠিকঠাক সেদ্ধ হয়েছে কিনা দেখার জন্য যেমন হাঁড়ির একটা ভাত টিপে দেখলেই চলে, তেমন যুদ্ধের মাটিতে নারী জীবনের বিভীষিকা জানতে, যুদ্ধের পটভূমিতে আলাদা করে নারীর বাড়তি আতঙ্কের কারণ বিশ্লেষণ করতে, যে-কোনও রকম হুট হাঙ্গামাময় পরিস্থিতিতে পুরুষের থেকে নারীর যন্ত্রণা ঠিক কোথায় আলাদা বুঝতে, লি ওক-সিয়ন একাই যথেষ্ট। এবং প্রথম, দ্বিতীয় বলে নয়, বিশ্বযুদ্ধ বলেও নয়, সব যুদ্ধই নারীর দেহ-মনে সৃষ্টি করে ভয়াবহ ক্ষত। কোনও সন্দেহ নেই, পুরুষেরও করে অবশ্যই। শুধু নারী পুরুষ কেনো, শিশু বৃদ্ধ থেকে শুরু করে পশুপাখি, গাছপালা, বাতাস-মাটি থেকে ঘরের ছাদ-পলেস্তারা, ঘটিবাটি পর্যন্ত সবাই বুকে বহন করে যুদ্ধের ক্ষত। তবে, নারী দিবসের কথা স্মরণ করে, এই যুদ্ধের পটভূমিতে নারীর জন্যই ক'টা কথা খরচ করলাম! যুদ্ধের সাজে নারীর সংখ্যা নগণ্য হলেও যুদ্ধের সাজায় নারী অগণ্য।   

বর্তমানে ক্রমশ লম্বা হচ্ছে যুদ্ধের ছায়া। যুদ্ধ প্রাণ নেয়। যুদ্ধ নাগরিককে রাষ্ট্রহীন উদ্বাস্তুু প্রাণীতে রূপান্তরিত করে। যুদ্ধ মনুষ্যত্ব কেড়ে নেয়। যুদ্ধ মানবিকতা হরণ করে। যুদ্ধ নারীকে পরিণত করে প্রান্তিক জনে। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন কোনও যুদ্ধ নেই যেখানে নারীর প্রতি যৌন সহিংসতার ঘটনা ঘটেনি, নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা সমাজের মৌলিক কাঠামো ধ্বংস করেনি। 

নারীর মর্যাদা ও অধিকার রক্ষার জন্য যে নারী দিবস, এবছর তা পালিত হবে যুদ্ধের আতঙ্কের মধ্যে। যুদ্ধরত রাশিয়া ও ইউক্রেন সহ ১৫ টি দেশে ৮ই মার্চ নারী দিবসে সরকারি ছুটি থাকে। এবারের নারী দিবসের থিম  Break The Bias। লিঙ্গবৈষম্য দূর করে পক্ষপাতিত্ব ভেঙে নারী-পুরুষের সমান অধিকারের বার্তা সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়াই এবারের নারী দিবসের লক্ষ্য। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের লাভ-ক্ষতি ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কী তা বিশেষজ্ঞরা বলবেন, আমাদের প্রার্থনা একজন নারীকেও যেন নির্যাতিতা হতে না হয় এই যুদ্ধে ! এবং অনাহূত সেই আগামী যুদ্ধেও। 

মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধের অংশ হিসেবে শত্রুকে অপমানিত করতে ধর্ষণকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়, সেই প্রাচীন কাল থেকে আজ পর্যন্ত। প্রাচীন গোষ্ঠীপ্রধান জীবনে এক গোষ্ঠী আর এক গোষ্ঠীকে দমন করতে তাদের শস্য আর পালিত পশু লুঠ করতো, আর সেই গোষ্ঠীর মেয়েদের ধর্ষণ করতো। সেই গোষ্ঠীজীবন থেকে আজ পর্যন্ত গোটা পৃথিবীর ইতিহাসে বহু যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে, বহু দেশ পরাধীন হয়েছে, স্বাধীন হয়েছে। কিন্তু, কী অধীনতার যুদ্ধ, কী স্বাধীনতার যুদ্ধ, কোথাও নারীর প্রতি যৌন সহিংসতা এড়ানো সম্ভব হয়নি। যুদ্ধকালীন যৌন সহিংসতায় গণধর্ষণ এবং বস্তুর সাহায্যে ধর্ষণও অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। দখলদার শক্তি দখলকৃত ভূখন্ডের নারীদের পতিতাবৃত্তি বা যৌন দাসত্বে বাধ্য করেছে। 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে এবং বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন জাপানি সেনাবাহিনীর দ্বারা শাসিত অঞ্চলগুলিতে যৌন দাসত্ব করার জন্য জোরপূর্বক বহু নারীকে নিয়োজিত করা হয়েছিলো। এবং তার গালভরা নাম দেওয়া হয়েছিলো কমফোর্ট উইমেন, যার সংখ্যা কম করে ২০,০০০ (জাপানি ইতিহাসবিদ ইকুহিকো হাটা) থেকে সর্বোচ্চ ৩৬০,০০০ থেকে ৪১০,০০০ (একজন চীনা পণ্ডিত) পর্যন্ত হতে পারে। যদিও সঠিক সংখ্যা নিয়ে এখনও গবেষণা এবং বিতর্ক হচ্ছে। এর মধ্যে বিরাট সংখ্যক মেয়ে ছিলেন অপ্রাপ্তবয়স্ক,  ১১ থেকে ১৪ বছরের মধ্যে। এঁরা কেউ-ই নিশ্চয় মাটি ফুঁড়ে বা আকাশ থেকে পড়েননি! এঁরা সবাই নিশ্চয় আমার আপনার মতো কারও কন্যা, কারও বোন, কারও স্ত্রী, কারও মা। সংখ্যা যা-ই হোক, তথ্য যা-ই বলুক, নারীর যন্ত্রণার ইতিহাস কিছুমাত্র মিথ্যে হয় না তাতে।

অথচ, আমাদের অভিজ্ঞতা বলে পুরুষ হাতে অস্ত্র ধরে, যুদ্ধ করে, আঘাত হানে, আর নারী হাতড়ায় আত্মরক্ষার উপায়। পুরুষকৃত যুদ্ধের ক্ষতে নারী লাগায় সেবার মলম। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যেমন আমেরিকান সেনাবাহিনী ও নৌবাহিনীতে প্রায় ৭৪০০০ নারী কর্মরত ছিলেন নার্স হিসেবে। 

যুদ্ধ ব্যাপারটা যতই পুরুষালি হোক, পুরুষ কেবল পুরুষের বিরুদ্ধেই যুদ্ধ করে না, যুদ্ধে পুরুষ নারীর বিরুদ্ধেও সহিংসতার বার্তা ছাড়ে। পুরুষেরা যুদ্ধ চায়, যৌনতাও চায়, হোক না সে-যৌনতা জোরপূর্বক! অন্য  জীবনের মতো যুদ্ধজীবনেও আমরা চাইবো, একজন নারীও যেন তাঁর সম্ভ্রম না হারান। আমরা নারী, আমরা সম্মান চাই, স্বস্তি চাই। আমরা যুদ্ধ নয়, শান্তি চাই।

1571 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।