নারী জীবন নিয়ে জন্ম নেয়া ও বেড়ে ওঠা আর নারী জীবন যাপন করার মাধ্যমে জানি যে, এই সমাজ-এই সমাজ নীতির অধীনে এ জীবন কতটা অসহায় হতে পারে; কতটা অমানবিকতার শিকার হতে পারে। এরপর আবার ব্যক্তিগত জীবন-সিদ্ধান্ত নেয়ার দৃঢ়তা দেখানো এবং হ্যাশ ট্যাগ মিটু লেখা আর তার পরবর্তী ঘটনা পরম্পরায়ের অভিজ্ঞতা থেকে আরও জানি যে- সমাজে প্রতিষ্ঠিত এবং সামাজিকভাবে সুনামের সাথে অধিষ্ঠিত থাকা সত্ত্বেও একজন নারীকে ঠিক কী কী ধরনের অবিচারের মধ্য দিয়ে যেতে হতে পারে।
এক্ষেত্রে উল্লেখ্য যে- আমি ভীষণ ভাগ্যবতী ছিলাম, কারণ আমার পরিবার-বন্ধু-বান্ধব-প্রিয়জন-শুভাকাঙ্ক্ষী-সহকর্মী-শিক্ষার্থীদের একটা বিশাল অংশ আমাকে যারপরনাই সমর্থন দিয়েছেন এবং মানসিকভাবে শক্ত থেকে অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে সবাই কম বেশি যার যার সামর্থ্য অনুযায়ী ভালোবেসে ও সম্মানের সাথে উৎসাহ যুগিয়েছেন। এজন্য ব্যক্তিগতভাবে উনাদের সবার কাছে আমি আন্তরিকভাবে কৃতজ্ঞ। কিন্তু আমার মতন ভাগ্যবতী সবাই যে নন, তা প্রায় প্রতিদিনই সংবাদপত্র খুললেই জানতে পারি। আর শিক্ষক হওয়ার কারণে নিত্যই মেয়ে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকেও আরও গভীরভাবে জানতে পারি। এছাড়া বিভিন্ন অনলাইন-অফলাইন মিডিয়া, আশেপাশের পরিবেশ-পরিস্থিতি থেকেও জানি।
কথা হলো আমাদের সমাজবাস্তবতায় একজন নারী যদি অপ্রতিষ্ঠিত-অশিক্ষিত-কূপমুন্ডুক হয়ে থাকেন, তাহলে তাদের জীবন কী পরিমাণ যন্ত্রণাময় হয় তা তো একেবারেই ভাষাতে প্রকাশযোগ্য নয়। এটা জানা কথা, যদিও মানার বিষয় নয় কিছুতেই। কিন্তু প্রতিষ্ঠিত-শিক্ষিত-সচেতন-স্বাধীনচেতা নারীর ক্ষেত্রে কি এই পরিস্থিতি আসলে পালটে যায়? আদতে পাল্টায় না খুব একটা। আর এটাই হলো নারী জীবন যাপনের এক বীভৎস পরিহাস। কেনো এরকম হয়? সমাজটা পুরুষতান্ত্রিক বলে? হ্যাঁ! নিশ্চয়ই এবং তা অবধারিতভাবেই। তবে এখানে কথা থেকে যায় আরও একটু। আর তা হলো-নারীর বোকা হওয়ার ভূমিকাও এই ফলাফলে অনেকখানি মালমসলা যোগান দেয়। কারণ, এ সমাজের নারীদের যে বোকা হলে একেবারেই চলে না।
কে যেন একবার বলেছিলেন- বোকা মানুষের শত্রু নেই এ কথা নিতান্তই অসত্য, বরং বোকার শত্রুই বেশি। আর যদি সেই বেকুব হয় কোনো নারী, তবে ত আর কোনো কথাই নেই...সে নারীর জীবন নিশ্চিতভাবেই বিভীষিকাময়। তো স্বাধীনচেতা-প্রতিষ্ঠিত-শিক্ষিত একজন নারী বোকা হবে না, এটাই তো সাধারণ্যের ভাবনা। আর তা স্বাভাবিকভাবেই। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকা রোমানা মঞ্জুর কি হতে পেরেছিলেন তেমন চালাক-চতুর, যাকে তার স্বামী পরকীয়ার অভিযোগ এনে দু'চোখ গেলে দিয়ে অন্ধ করে দিয়েছিলেন! না, এত শিক্ষা-সচেতনতা তাকে পারে নি চালাক-চতুর, ব্যক্তিস্বার্থ বিবেচনা করা শেখাতে! দুর্ভাগ্যজনক বৈকি, তাই না? কিন্তু এটাই সত্য। আজকে সকালে (২২ মার্চ, ২০১৯) এরকম আরও একজন বোকা নারীর উপাখ্যান শোনার দুর্ভাগ্য হলো আমার।
ডাঃ অহিদা, যিনি ২০০৩ সালে চিকিৎসাশাস্ত্র নিয়ে পড়াশোনা শেষে চিকিৎসাব্রতকেই একমাত্র ধ্যানজ্ঞান করে নিজের জীবন চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। ২০১৩ তে এমফিল ডিগ্রি শেষে যখন ডাক্তার হিসেবে প্র্যাক্টিস করছিলেন, সেসময় পরিচয় হয় এক মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভের সাথে। সেই ব্যক্তির অবিরত প্রেম-ভালোবাসার আবেদন-নিবেদনের প্রেক্ষিতে বছরখানেক পর এই বোকা নারী এক পর্যায়ে তাকে সম্মতিও দিয়ে ফেলেন ভালোবাসার। সিদ্ধান্ত হয় বিয়ে করবেন দু'জন। পারিবারিক অসম্মতি সত্ত্বেও ২০১৪ তে তারা দু'জন তাদের ভালোবাসাকে পরিণতি দিতে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। চলতে থাকে তাদের দু'জনের সংসার। একজন ডাক্তার নারীর মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভ স্বামী! ভীষণ বিচিত্র মনোভাবের এই সমাজে ঘটা এরকমটাতো কোনো ভাবেই গ্রহণযোগ্য ব্যাপার নয়। সমাজের চোখে এটা অত্যন্ত অসংবেদনশীল ব্যাপার! তাই সিদ্ধান্ত হলো- স্বামীটি চাকরি ছেড়ে ব্যবসা করবেন। সেই ব্যবসার টাকা যোগান কে দেবে? অবশ্যই নারীটি, যেহেতু সে প্রতিষ্ঠিত। হলোও তাই। কিছুদিন ডিস্ট্রিবিউশনের ব্যবসা করলেন স্বামীটি। ইতিমধ্যেই এক মেয়ে সন্তানের বাবা-মা হলেন দু'জনে।
নারীটি যদিও শিক্ষিত একটি পরিবার থেকে উঠে এসেছেন। কিন্তু ব্যক্তিগত জীবনের এই সিদ্ধান্তের জন্য, পরিবার আর তার সাথে কোনো স্বাভাবিক যোগাযোগ রাখেনি বহুদিন, এমনকি কোনো ধরনের সমর্থনের বিষয়ে আগ্রহীও হয় নি।
তারা দু'জন মেয়েকে নিয়ে তাই একেবারেই নিজেদের মতন জীবন যাপন করছিলেন। এই পর্যায়ে স্বামীটির ইচ্ছে হলো সে সাংবাদিকতা করবেন। কিছুদিন তাই করলেনও। এর মাঝে দু'জনে মিলে সিদ্ধান্ত নিলেন, নারীটির একটা গোপন স্বপ্নকে বাস্তবায়নের কাজ শুরু করবেন। কী সেই একান্ত স্বপ্ন? একটা হাসপাতাল গড়া আর একটা আশ্রম করা। পরিবার বিচ্ছিন্ন, ছন্নছাড়া অপ্রতিষ্ঠিত স্বামী-সন্তান নিয়ে জীবনসংগ্রামে লড়া এই নারীটি কীভাবে এই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দান করবেন?
অবধারিতভাবেই স্বামী বলে পরিচিত সঙ্গীই হলেন তার এই স্বপ্ন বাস্তবায়নের একমাত্র একনিষ্ঠ সমর্থক। সেই অনুযায়ী এক-দুই জায়গায় জমিও কেনা হলো। সবটাই দেখভাল করছেন স্বামীটি। অন্ধবিশ্বাসে স্বামীর কাছেই সবকিছু করার দায়িত্ব দিয়ে রেখে নিজের পেশা আর পরিবার নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন চিকিৎসক এই নারী। যে কিনা এক সময় ভাবত- বিয়ে না করলে কী হবে একটা মেয়ের? বিয়েটা কি খুব জরুরি কিছু এই এক জীবনের জন্য? একা এই নারী জীবন নিয়েও কি বাঁচা যায় না? স্বাধীনভাবে নিজের স্বপ্ন আর পেশার ব্রত নিয়ে যে বাঁচতে চেয়েছিলো বরাবর, সেই মেয়েটির বর্তমান অবস্থা হলো এই।
যাই হোক। পেশাগত আর পারিবারিক ব্যস্ততায় চোখ এড়িয়ে যাওয়া সত্যটা একদিন ধরা পড়লো। সে জানতে পারলো জমিগুলোর একটা তার নামে লেখা হলেও, অন্যটি এবং বড় মাপের জমিটি কেনা হয়েছে স্বামীর নামে। যদিও টাকা তার। আর স্বামীটি এসব তাকে জানানোর প্রয়োজনবোধও করেন নি, অনুমতি নেয়ার তো তোয়াক্কাই করেন নি। এর মাঝে সে আরও জানতে পারলেন- এই পুরুষটির এর আগেও একটি বিয়ে ছিলো। আর সেই বিয়েও বিবাহবিচ্ছেদে গড়িয়েছিলো, আর তা নারী নির্যাতনের অভিযোগ ও মামলার পরম্পরাতে। এতসব সামনে আসলেও ডাঃ অহিদা স্বামীর মিষ্টি চাতুর্যপূর্ণ বক্তব্যের দ্বারা বিভ্রান্ত হয়েই আসছিলেন।
এরপর ২০১৬ তে স্বামী তাকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে তার নামে একটি একাউন্ট খুলে দিলেন। পাসওয়ার্ড থেকে শুরু করে সেটিংস, সবই স্বামীর হাতে সেট করে দেয়া। এখন যখনই ডাঃ অহিদা কারো সাথে ইনবক্সে কোনো কথা বলেন না কেনো, হোক তা কোনো স্বাভাবিক আলোচনাও; স্বামী যেহেতু পাসওয়ার্ড জানার কারণে ইনবক্স চেক করতে পারেন; তাই এসবের সূত্র ধরে স্বামীটি নানান অভিযোগ আর সন্দেহ করে ডাঃ অহিদার সাথে ঝগড়া বাঁধানোর চেষ্টায় থাকেন। ডাঃ অহিদার ভাষ্যমতে- এরকম ক্ষেত্রে তিনি বরাবর সংসারে শান্তি বজায় রাখার স্বার্থে চুপ করে যেতেন এবং কারোর সাথে যোগাযোগ করাও বন্ধ রাখতেন। এক পর্যায়ে দু'জনের সম্মতিতে সন্তান পালনের স্বার্থ বিবেচনায় আর ডাঃ অহিদার সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে কাজে লাগতে পারে চিন্তা করে, ডাঃ অহিদার স্বামী আইন শাস্ত্রে পড়াশোনা করবে এমনটাই সিদ্ধান্ত নেয়া হলো। স্বামীর পড়াশোনা চলছে।
এই পর্যায়ে এসে ডাঃ অহিদার কাছে স্বামী আবদার করে বসলেন, জমি-জমা সংক্রান্ত ব্যবসা করতে চান তিনি। তাই ব্যাংক থেকে অনেক টাকা ঋণ করার দরকার। কে তুলবে সেই ব্যাংক ঋণ? কার নামে? অবশ্যই ডাঃ অহিদা। কারণ, সেই সামর্থ্য তারই আছে। স্বামীটির নেই। ঋণ নেয়া হলো। কিন্তু এর আগে জমি কেনা সংক্রান্ত স্বামীর হটকারি সিদ্ধান্তগুলোর প্রেক্ষিতে কিছুটা আশংকা থেকেই, এবার ব্যাংক থেকে ঋণ তুললেও ব্যাংককে জানিয়ে রেখেছিলেন যাতে ওনার অনুমতি ব্যতীত কোন টাকা অন্য কারোর একাউন্টে না দেয়া হয়। কিন্তু বোকা মেয়ে এটাও জানেন না যে, অনেক কাগজপত্রের মাঝে স্বামীর কারসাজিতে কোনটাতে যে সে কী হিসেবে স্বাক্ষর করে রেখেছেন এবং কোন বিশ্বাসে এসব করেছিলেন আর ঘটলো কী তা অনুধাবনও করতে পারেন নি বাস্তবটুকু জানার আগে। কারণ তার সেই টাকাও আর তার একাউন্টে থাকলো না শেষপর্যন্ত। চলে গেলো স্বামীর একাউন্টে। কীভাবে গেলো তা সে এখনও আন্দাজ করতে পারেন না নাকি!
এর মাঝে স্বামীর পরামর্শেই একটা সেকেন্ডহ্যান্ড গাড়িও কেনা হয়েছিলো, অবশ্য সেটা ডাঃ অহিদার কর্মস্থলে যাতায়াতের সুবিধার্থে। যদিও সেটিও স্বামীটি কৌশলে ধাপ্পাবাজি করে নিজের নামে লিখিয়ে নিয়েছিলেন। অবশ্য গাড়ির ড্রাইভার রাখা হয়েছে, সেই বেতনও ডাঃ অহিদার টাকা থেকেই যাচ্ছে বরাবরের মতন। এভাবেই চলছিলো। এদিকে বছর দেড়েক আগে, নিজ পরিবারের সাথে ডাঃ অহিদার আবার যোগাযোগ হয়। কারণ, ততদিনে তার চিকিৎসক ছোট ভাই বাবা-মাকে আর বাসাতে একত্রে রাখবেন না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তিনি কেবল বাবা-মায়ের ব্যয়ভার সর্বোচ্চ বহন করতে পারেন। এর বেশি কিছু না। আর তার বড় বোন নিজের দুই মেয়ে নিয়ে আগেই বিধবার মানবেতর জীবন যাপন করছিলেন। যাদেরকে একটা পর্যায় পর্যন্ত অবশ্য ডাঃ অহিদাই দেখাভাল করে আসছিলেন। এখন জানা গেলো- বাবা-মায়ের প্রতি ভাইয়ের এমন ব্যবহার। আরও জানা গেলো তার মা চোখে দেখছেন না, চিকিৎসা করাতে হবে। চিকিৎসক মেয়ে সবকিছু বিবেচনায় বাবা-মাকে নিজের কাছে এনে রাখার সিদ্ধান্ত নিলেন। চিকিৎসা করানোর ব্যবস্থা করলেন। কিন্তু নিজের বাস্তবতায় সে এতটাই টালমাটাল যে, বড় বোনকে আর টানতে পারছিলেন না। এ নিয়ে বড় বোন আর বাবা মায়ের সাথে শুরু হলো আরেক টানাপোড়েন।
জীবনের কী নির্মম উপহাস! এতকিছুর মাঝে নানানভাবে চিকিৎসক এই নারীটি যে বিভিন্ন ষড়যন্ত্রে জড়িয়ে পড়ছিলেন, এতটা তিনি আন্দাজও করতে পারছিলেন না। অনেক কিছুতে প্রতারিত হচ্ছিলেন এটা বুঝতে পারছিলেন বিভিন্ন ঘটনার প্রেক্ষিতে, যা উল্লেখ করা হয়েছে আগেই; তবে ততটা তখনও চাক্ষুষ হয়ে তার কাছে ধরা পড়ে নি।
বিষয়টা সামনে আসলো, যখন তার নিয়মিত ড্রাইভারের ক্যান্সার আক্রান্ত হওয়ার অজুহাতে, স্বামীটি তার এক দূর সম্পর্কের কিংবা পরিচিত ছোট ভাইকে ড্রাইভার হিসেবে নিয়োগ দেয়ার জন্য তাকে রাজি করালেন।
প্রথম দিকে ড্রাইভার ছোটভাইটিকে তার স্বামীই লাই দিয়ে পরিবারের একজন করার চেষ্টা করছিলেন এবং ডাঃ অহিদার ব্যক্তিগত ড্রাইভার হিসেবে তাকে বিশ্বস্ত করে তোলার ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে, নানান ঘটনার অবতারণা করাতেও বিশাল ভূমিকা এই স্বামী ব্যক্তিটিই করেছিলেন। এরপর যখন ড্রাইভারকে ছোট ভাই বিবেচনায় ডাঃ অহিদা স্নেহ করা শুরু করলেন, তখন থেকেই এই দু'জনকে নিয়ে স্বামীটি শুরু করলেন নানান কুৎসা রটানো।
এর আগেও নানান অভিযোগ করে তো আগে থেকেই ঝগড়া বাঁধাতেন এই স্বামী, উপরন্তু বিনা উস্কানিতে ব্যাপকভাবে মারধর করার ঘটনাও গত ছয়-সাত মাসের মাঝে স্বামীটি ঘটিয়েছিলো। সেই মারধরের প্রেক্ষিতে ডাঃ অহিদা স্বামীর সাথে স্বাভাবিক স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক বজায় রাখায় মানসিকভাবে সম্মতি দিতে পারছিলেন না অধিকাংশক্ষেত্রে। আর এতে স্বামী দিনকে দিন ক্ষিপ্ত হচ্ছিলেন।
সমাধান হিসেবে ডাঃ অহিদা দু'জন আলাদা থাকা কিংবা বিবাহবিচ্ছেদ করার ব্যাপারেও, স্বামীকে অনেকবার অনুরোধ করেছিলেন। এরকম অনুরোধ আসলেই স্বামীর ব্যবহার মুহুর্তেই আবার পরিবর্তিত হয়ে যেত। তিনি বলতে চাইতেন, যেকোনো কিছুর বিনিময়েই সে ডাঃ অহিদাকে হারাতে চায় না। কিন্তু এদিকে অব্যাহতভাবে চলছিলো- ছয় মাস আগের মারধরের ওই ঘটনার পর থেকে স্বামীটির তার বিরুদ্ধে পরকীয়ার অভিযোগ তোলে, যদিও সেসব অভিযোগের প্রমাণস্বরূপ সেভাবে কোনো তথ্য উপস্থাপন স্বামীটি করতেও পারছিলেন না। তবে অভিযোগ প্রমাণ করার নিরন্তর চেষ্টার অংশ হিসেবে, স্বামীটি ডাঃ অহিদার মোবাইল ট্র্যাক করা থেকে শুরু করে আরও নানান চেষ্টাই অব্যাহত রাখছিলেন।
এই পর্যায়ে এসে তিনি যখন এই ড্রাইভার ছোট ভাইকে জড়িয়ে আজেবাজে কথা বলতে শুরু করলেন এবং চূড়ান্ত অশোভন ধারায় অভিযোগ এনে ড্রাইভারকে ছাঁটাই করার জন্য জোর করতে লাগলেন, তখন ডাঃ অহিদা এবার আর এসব শারীরিক ও মানসিক অত্যাচার মেনে নিতে অপারগতা প্রকাশ করলেন এবং এসবের তীব্র প্রতিবাদ করলে, গত ১৯ মার্চ তার উপর বর্বরতম উপায়ে শারীরিক ও মানসিক অত্যাচার করে এই স্বামী নামক পুরুষ মানুষটি।
মারধরের ফলাফলে, ডাঃ অহিদার হাত ভেঙ্গে গেছে। কনুই ডিসপ্লেসড হয়ে গেছে এতে।
সব চাইতে জঘন্যতম ব্যাপার হলো- ডাঃ অহিদাকে শারীরিক নির্যাতনের এক পর্যায়ে নিষ্ঠুর উপায়ে স্বামীটি তার আঙ্গুল দিয়ে, জোর করে তার মলদ্বারের রাস্তা ছিঁড়ে ক্ষতবিক্ষত করে ফেলে। কেনো এবং কী ধরনের পাশবিক ধারণা লালনের প্রেক্ষিতে আর কেমন মনমানসিকতা থেকে এটা করতে পারে, তা ভাবনারও অতীত।
যাই হোক। এরপর যা হলো-ডাঃ অহিদা এই সময় বাঁচার জন্য চিৎকার করলেও, পাশের রুম থেকে তার নিজের বাবা-মা'ই তার সাহায্যে এগিয়ে তো আসেনই নি; উলটো ওনারা বিস্ময়করভাবে কিছুই নাকি টের পাননি বলে অভিমত দিয়েছেন। কারণ, ওনারা মেয়ের স্বামীর বানানো নানান বানোয়াট অভিযোগ বিশ্বাস করেন এবং নিজের মেয়েকেই চরিত্রহীন ভাবেন। আর এমন মেয়েকে এভাবে বীভৎস উপায়ে শারীরিক নির্যাতনেও তাই তাদের কোনো আপত্তি নেই।
পর দিন মেডিক্যাল রিপোর্টসহ থানাতে মামলা করলে গেলে ডাঃ অহিদা জানতে পারেন যে, তার আসার আগেই তার স্বামী তার বিরুদ্ধেই মনগড়া বক্তব্যে থানার সবাইকে ম্যানেজ করে রেখে এসেছেন। এই অবস্থাতে ডাঃ অহিদাকে দুপুর থেকে রাত পর্যন্ত থানায় বসিয়ে রেখেও মামলা নিতে সংশ্লিষ্টরা বিভিন্ন ভাবে গড়মসি করেছেন।
ডাঃ অহিদা তারপরেও নারী নির্যাতনের বিভিন্ন স্বাক্ষ্যসহ মামলা করে আসেন, কিন্তু এরপরদিনই জানতে পারেন যে ওই মামলাতে নাকি তার স্বামী এক রাতের মাঝেই জামিন পেয়ে গেছেন।
আজকে বাসায় স্বামীর অনুপস্থিতিতে ঢুকে দেখেন যে, তার এতদিনের অর্জিত শিক্ষা সার্টিফিকেটগুলো একটাও বাড়িতে নেই। সেগুলোর কোন সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না। আরও জানতে পারেন তার মায়ের জামিনদারিতেই তার এই স্বামীর জামিন হয়েছে।
এই হলো এক বোকা নারীর বর্তমান পরিস্থিতি। তিনি জানেন না ঠিক কীভাবে এইসব ষড়যন্ত্র থেকে তিনি বের হতে পারেন। কীভাবে তিনি এই পরিস্থিতি সামাল দেবেন!
অথৈ সাগরে পড়ে এই বোকা মেয়েটি 'নারী' পত্রিকার সম্পাদক চৈতী আহমেদের শরণাপন্ন হন গতকাল রাতে। আজকে সকালে আমি জানতে পারি তার এই করুণ অবস্থা। এত কিছু জানার পর অসুস্থবোধ করছি ভীষণ।
আমি ঠিক বুঝতে পারি না-একজন নারী যদি তার সঙ্গীর সাথে সৎ না হন, তাতে কি ঐ নারীর প্রতি এমন ধারার বা কোন ধারারই শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন বৈধ হয়ে যায়? সুস্থ কোনো উপায়ে এই দেশের পুরুষরা (সবাইকে ইঙ্গিত করছি না) এধরনের সমস্যার সমাধান করতে জানেন না? কেনো নারীদেরকে শারীরিকভাবে বীভৎসতম উপায়ে আঘাত করতে হবে? দেশে কি কোনো সুস্থ উপায়ে বিচ্ছেদের সমাধান বিদ্যমান নেই?
যদি ডাঃ অহিদার বক্তব্য সঠিক হয়, তবে এই প্রতারক, ষড়যন্ত্রকারী এবং নির্যাতক স্বামীটির বিচারে কি আমরা সচেতন সভ্য মানুষ হিসেবে নিজেদের দাবি করে থাকি, সেসব লোকেরা সোচ্চার হবো না? কারণ, এতই যখন অভিযোগ তো গেলো না কেনো মেয়েটিকে ছেড়ে? কেনো কোনো সুস্থ উপায় বের করতে পারলেন না? কেনো এই বর্বরতা? কেনো এই নিষ্ঠুর আচরণ করা? আর কতদিন এমন চলতেই থাকবে?
মূলত ভাবনার বিষয় এটাই যে- যদি স্বামীটির অভিযোগ অনুযায়ী ডাঃ অহিদার বহুগামিতার বিষয়টি সত্যও হয়ে থাকে, তাতে কি এই পুরুষটির করা শারীরিক নির্যাতনকে সমর্থন করা যায়? এই নির্যাতনের বিরুদ্ধে দেশে আইন আছে। কিন্তু যখন আইনের প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো এক পাক্ষিক জাজমেন্টাল হয়ে নারীর প্রতি হওয়া সহিংসতাকেই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সমর্থন দিয়ে যায়, তখনও কি আমরা চুপ করে তা দেখেই যেতে থাকবো? কেউ এগিয়ে আসবো না? কেউ দাঁড়াবো না এই সব অন্যায়ের বিরুদ্ধে? জানি না কী হবে? কিন্তু এতটুকু বুঝতে পারছি- আর দশটা ঘটনার মতনই এই বোকা মেয়েটাকেও ভুগতেই হবে এবং এটাই তো বাস্তবতা। এটা হলো নারী জীবনের অসহ্য নিয়তি! আমরা যেন কেবল দেখেই যাবো, দেখেই যাবো। কিছু করতে পারবো না কখনো কোনো নির্যাতিতের শুভর পক্ষে।
"নির্যাতিতের বক্তব্যের ভিত্তিতে লেখাটি লেখা হয়েছে।"