জাকিয়া সুলতানা মুক্তা

সহকারী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।

'Me too'- এর শাব্দিক অর্থ বাংলাতে 'আমিও'

 #metoo - এর ক্ষেত্রে এই অর্থটি একটি সামাজিক আন্দোলনকে নির্দেশ করে। যার অর্থ সংক্ষেপে দাঁড়ায় 'আমিও যৌন নিগ্রহের শিকার/ আমার জীবনেও যৌন নিপীড়নের ঘটনা বিদ্যমান!'

কথা হলো সারা বিশ্বব্যাপী চলমান খুবই সুনির্দিষ্টভাবে যৌন নিপীড়ন বিরোধী এই আন্দোলন সাড়া ফেললেও, আমাদের দেশ তথা উপমহাদেশীয় সংস্কৃতিতে এই নিপীড়নবিরোধী উচ্চারণ সাড়া ফেলছে না কেনো?

এ প্রশ্নের উত্তর এক কথায় দেয়া সম্ভব নয়। কারণ এর নানাবিধ মাত্রা রয়েছে, আর সেসব বিবেচনাগুলো করার দায়িত্ব সমাজের প্রজ্ঞাবান সমাজবিজ্ঞানী, মনোবিজ্ঞানী, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, রাজনীতিবিজ্ঞানী, ধর্মতাত্ত্বিকগণসহ সর্বস্তরের সচেতন নাগরিক সমাজের।

তাই এই প্রশ্নের উত্তর দেয়ার দিকে আপাতত নাইবা গেলাম।

যে বিষয়টা নিয়ে বলতে চাই, তা হলো -এই 'হ্যাশ ট্যাগ মী টু'(#metoo ) মানে কী? কোন কোন বৈশিষ্ট্য থাকলে তা এই হ্যাশ ট্যাগ মী টু(#metoo)- এর অন্তর্ভূক্ত হবে।

যথাক্রমে - ১. এটি এই ডিজিটাল তথা বিশ্বায়নের যুগে স্যোশাল নেটওয়ার্ক-ভিত্তিক একটি বিশ্বব্যাপী আন্দোলন। যেটি স্যোশাল নেটওয়ার্কে হ্যাশ ট্যাগ(#) সম্বলিত হওয়ায় সুবাদে সারাবিশ্বের এ সংক্রান্ত যাবতীয় পোস্টের সাথে সংযুক্ত হয়ে যাবে।

২. এটি যৌন নিপীড়িত ব্যক্তির নিজ অভিজ্ঞতা এবং তা তার নিজের স্যোশাল আইডি থেকে করা বয়ান। তাই অন্য কারোর অভিজ্ঞতা কেউ লিখে পোস্ট করলে বা করতে চাইলে সেটি কোনভাবেই হ্যাশ ট্যাগ মী টু(#metoo ) এর অধীন আন্দোলনের অংশ হবে না।

৩. হ্যাশ ট্যাগ মী টু(#metoo ) হলো সেই আন্দোলন, যাতে নিপীড়িত ব্যক্তি মূলত তার নিজের ভেতরে রাখা দুর্বিষহ বেদনাকে জনসম্মুখে প্রকাশ করছেন। এখানে মূখ্য উদ্দেশ্যে হলো কষ্টটা শেয়ার করে মনের ভেতরে থাকা কষ্টের পাষাণভার থেকে নিজেকে মুক্ত করা।

৪. এই আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীগণ তাদের সাথে ঘটে যাওয়া নিপীড়নের জন্য নিপীড়ককে সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করছেন। তাই সুনির্দিষ্টভাবে নিপীড়ককে চিহ্নিত না করলে সে লেখা হ্যাশ ট্যাগ মী টু(#metoo )-র মূল মোটিভভূক্ত হয় না।

৫. এই আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীগণ নিজ দায়িত্বে নিজেদের সাথে ঘটে যাওয়া নিপীড়নের বিবরণ লেখেন, যাতে সমাজে বিদ্যমান নানাবিধ ট্যাবু ভাঙ্গার সুস্পষ্ট ও শক্তিশালী ইঙ্গিত থাকে।

৬. বিশ্বব্যাপী এই আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীগণের কেউই প্রাথমিকভাবে তার সাথে ঘটে যাওয়া কোনো নিগ্রহের বিচার চাইতে কোনো আইনের আশ্রয় নিতে যান নি বা কোন সংস্থা অথবা সামাজিক প্রতিষ্ঠানের দারস্থ হতেও প্রাথমিকভাবে গিয়েছেন এমনও দেখা যায় নি।

৭. এই আন্দোলনটি এক অর্থে সমাজে বিদ্যমান অভব্য কিছু অন্যায়ের বিরুদ্ধে সচেতন সমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করার আন্দোলন।

৮. এই আন্দোলন হলো সমাজে বিদ্যমান ভালো মানুষীর মুখোশ পড়া নিপীড়কদের মুখোশ উন্মোচনের আন্দোলন। এই মুখোশ উন্মোচন সমাজের সামনে, রাষ্ট্রের সামনে; বৃহত্তর অর্থে সমাজ মনস্তত্ত্বের সামনে।

৯. এই আন্দোলন সমাজে বিদ্যমান চর্চায় নিপীড়ককে সামাজিক আদালতের মাধ্যমে ফিল্টার করে নেয়ার দ্বারা নিপীড়ককে পরিশুদ্ধ করার সুযোগ দেয়া, সচেতন করার প্রয়াস।

১০. এই আন্দোলন সমাজে বিদ্যমান নিপীড়ন-উৎসাহী রীতিনীতিগুলোকে বাতিল করার এবং সুস্থ চেতনা-প্রদায়ী ও সুন্দর ভাবনা-উৎসারিত দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলার আন্দোলন।

১১. এই আন্দোলন নিপীড়িত ব্যক্তির স্বউদ্যোগে ও স্বউদ্যোমে সমাজে বিদ্যমান যৌন নিপীড়ন-উৎসাহী যাবতীয় অন্যায়চর্চার আগলভেঙে বেরিয়ে আসার আন্দোলন।

১২. এই আন্দোলন হলো নিপীড়িত ব্যক্তি নিপীড়নের শিকার হওয়াকে নিজের অপরাধ বা নিজের সংকোচ ভেবে নিশ্চুপ না থাকার আন্দোলন। বরং এটি সেই আন্দোলন যাতে সুস্পষ্টভাবে নিপীড়ককে চিহ্নিত করে সংকোচ-লজ্জা-অন্যায় সেই নিপীড়কের বলে চিহ্নিত করার আন্দোলন।

মোট কথা, এই হ্যাশ ট্যাগ মী টু (#metoo ) আন্দোলন সুস্থ সুন্দর যৌন-নিপীড়নমুক্ত সমাজ নিশ্চিত করার আন্দোলন।

2696 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।