খান আসাদ

সমাজকর্মী

রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস

"প্রাণহানীর ঘটনাকে গুরুত্ব না দিয়ে শুধু ঘরবাড়িতে আগুন দেয়ার ঘটনাকে আমাদের মিডিয়াগুলো প্রচার করে কী প্রমাণ করতে চায়। তারা কি প্রকারান্তরে এটাই প্রমাণ করতে চাইছেনা যে মুসলমানেরা অসহিষ্ণু, সহিংস? ফেবু পোষ্ট দেয়ার পরে এটা ফয়সালা করার জন্য কি প্রশাসন যথেষ্ট সময় পায়নি? এখানে একটা নিয়মতান্ত্রিক সভ্য প্রতিবাদকে সহিংস হয়ে উঠতে বাধ্য করা হয়েছে। নিয়মতান্ত্রিক প্রতিবাদকে গুরুত্ব দিয়ে টিটুকে গ্রেপ্তার করলে সহিংসতার আশংকা কমতো।"

 

উপরের বক্তব্যটি একজনের, যিনি সিপিবি থেকে বিবর্তিত হয়ে বামাতি পথ পরিক্রমা শেষে এখন হেফাজতে ইসলামের পক্ষে এবং ভারতের বিরুদ্ধে (পড়ুন হিন্দুদের বিরুদ্ধে) প্রতিনিয়ত সামাজিক মাধ্যমে লিখছে। এই ধরনের চিন্তা, চুড়ান্ত বিচারে বাংলাদেশে "ইসলামি রাষ্ট্র, শরিয়া আইন ও মসজিদভিত্তিক সমাজের" নামে জামাতে ইসলামির ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠার রাজনীতির পক্ষে কাজ করে। (ইরানেও অনেক বিভিন্ন মতের ইসলামী রাজনীতি ছিল, কিন্তু চুড়ান্ত ভাবে তা মৌলবাদী রাজনীতির একটি দলের নিয়ন্ত্রনে চলে আসে, বাংলাদেশে এটি জামাতের নিয়ন্ত্রনে আসবে, যদি সেক্যুলাররা ব্যর্থ হয়।)

ব্যাক্তি নয়, চিন্তা গুরুত্তপুর্ন। যা আপাতভাবে "যৌক্তিক" মনে হয়, তার ভেতরের "প্রপাগান্ডা" ও "রাজনীতিটা" বুঝতে হবে। কারো যুক্তির পেছনের রাজনীতিটা বুঝতে হলে, তার বক্ত্যব্যকে একটু ভাল ভাবে উন্মোচন করতে হবে। সমাজ বিজ্ঞানের ভাষায় এটাকে বলে "ক্রিটিকাল ডিসকোর্স এনালিসিস" পদ্ধতি।

(১) প্রাণহানীর ঘটনাকে গুরুত্ব না দিয়ে শুধু ঘরবাড়িতে আগুন দেয়ার ঘটনাকে আমাদের মিডিয়াগুলো প্রচার করে কী প্রমাণ করতে চায়। তারা কি প্রকারান্তরে এটাই প্রমাণ করতে চাইছেনা যে মুসলমানেরা অসহিষ্ণু, সহিংস?

উপরের রচনায়, প্রথমে সমান্তরালে আনা হয় দুটো ঘটনা। একটি "প্রানহানী" অপরটি "ঘরবাড়িতে আগুন"। তারপরে, অভিযোগ করা হয়, মিডিয়ার বিরুদ্ধে। কেন মিডিয়া সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনাকে গুরুত্ত দিয়েছে। এখানে কৌশলে সত্য আড়াল করা হচ্ছে। এই দুটি ঘটনাকে সম্পর্কিত ভাবে দেখলে, আমরা কি দেখি? দেখি একটি "সাম্প্রদায়িক অপরাধ" ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর বেআইনি হামলা, অপরটি প্রশাসনের "নাগরিকদের জান মাল রক্ষার চেষ্টা", অপরাধীদের নিরস্ত্র করার জন্য কঠোর অবস্থান, গুলি বর্ষন।

কেন এই সাম্প্রদায়িক হামলা? এই হামলার পেছনে একটি রাজনীতি আছে। এটি মুলত মৌলবাদী রাজনীতির পক্ষে সমাবেশীকরনের উদ্দেশ্য করা হয়েছে। এই ঘটনাটি বাংলাদেশে "মৌলবাদ/ফ্যাসিবাদ" ও "সেক্যুলার গনতন্ত্রের" দন্ধ, যা ১৯৭১ সাল থেকে চলে আসছে, এখনো অমিমাংসিত।

এই প্রধান ও মৌলিক দন্ধকে আড়াল করার কৌশল, উপরের দিতীয় লাইনঃ তারা কি প্রকারান্তরে এটাই প্রমাণ করতে চাইছেনা যে মুসলমানেরা অসহিষ্ণু, সহিংস? এখানে খেয়াল করুন, "মুসলমানেরা" শব্দের ব্যাবহার। বাস্তবে কারা এই সাম্প্রদায়িক হামলায় অংশ নিয়েছে? সকল মুসলমান নয়, সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী রাজনীতি প্রভাবিত ক্যাডার সমর্থকেরা। এরা মুলত "মৌলবাদী"। এখানে সকল মুসলমান, সেক্যুলার, সুফি, অসাম্প্রদায়িক - সবাইকে "মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক" হিসেবে উপস্থাপনের একটি ধুর্ত চেস্টা রয়েছে।

(২) এখানে একটা নিয়মতান্ত্রিক সভ্য প্রতিবাদকে সহিংস হয়ে উঠতে বাধ্য করা হয়েছে। নিয়মতান্ত্রিক প্রতিবাদকে গুরুত্ব দিয়ে টিটুকে গ্রেপ্তার করলে সহিংসতার আশংকা কমতো। এই অংশটি খেয়াল করুন।

ক) সাম্প্রদায়িক হামলার উস্কানি কি "সভ্য" প্রতিবাদ? আপনার কারো লেখা পছন্দ হচ্ছেনা, সভ্য আচরন কি? আপনি ইগনোর করবেন। আপনি আপনার অপছন্দের লেখার সমালোচনা করবেন। আপনি বিকল্প লিখবেন। সহিংসতার হুমকি কি সভ্য, না অসভ্য? এই অসভ্যতাকে "সভ্য" হিসেবে শব্দচয়ন কিন্তু দক্ষতার ব্যাপার। নৈতিক উচ্চতা লাভের কৌশল। কেন? কারন মৌলবাদী রাজনীতির বৈধতা বাড়ানো।

খ) প্রশাসনের উপর প্রধান দায় চাপানোর চেষ্টা, আসলে মূল অপরাধীদের আড়াল করার কৌশল। শিশু ধর্ষকেরাও যেমন অপরাধীকে নয়, মেয়েদের পোশাককে দায়ী করে, এখানেও অপরাধীকে নয়, ঘুড়িয়ে পেচিয়া অপরাধী করা হচ্ছে, মিডিয়া ও প্রশাসনকে। মুল প্রশ্নটি সাম্প্রদায়িক অপরাধের, এই অপরাধের পেছনের রাজনীতির। পরবর্তি প্রশ্ন প্রশাসনের এই অপরাধ দমনের সক্ষমতার, যা অপরাধ নিয়ন্ত্রনের, সেটা নিয়ে আলাদা আলোচনা হতে পারে। কিন্তু এখানে প্রশাসনের ভুমিকা নিয়ে সমালোচনা কেন? কারন, মৌলবাদি সাম্প্রদায়িক হামলাকারিদের অপরাধকে আড়াল করা।

পরিশেষে, আপনারা যারা বাংলাদেশকে সভ্য, মানবিক, সেক্যুলার, গনতান্ত্রিক, প্রগতিশীল, শান্তিপুর্ণ দেশ হিসেবে দেখতে চান, অনুগ্রহ করে, সাম্প্রদায়িকতা-মৌলবাদ-জংগিবাদ তথা ধর্মীয় ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে দাড়ান, বুদ্ধিবৃত্তিক উপায়ে। মুক্তি্যুদ্ধের চেতনা; সেক্যুলার, সমাজতান্ত্রিক ও জাতিয় সংস্কৃতি বিকাশের বিরুদ্ধে আজকে নানা চেহারার লোকেরা রয়েছে। জামাতে ইসলামিকে চেনা সহজ, কিন্তু এদের রাজনীতির পক্ষের বহুরূপিদের চিনতে হলে, এদের চিন্তাকে উন্মোচিত করতে হবে।

1622 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।