এবার #metoo -এর তীর নাট্যকার সেলিম আল দীন এর উপর
বৃহস্পতিবার, নভেম্বর ১৫, ২০১৮ ১:৪৬ PM | বিভাগ : সাম্প্রতিক
বাংলাদেশের #metoo আন্দোলনে মুখ খোলা নারীরা একের পর এক যেসব পুরুষদের মুখোশ খুলে দিয়েছেন সেগুলি নিঃসন্দেহে ছিলো চাঞ্চল্যকর। কিন্তু, এবারে নারী অধিকার কর্মী মুশফিকা লাইজু যে ঘটনা বর্ণনা করেছে তা সকল কিছুকেই ছাপিয়ে উঠেছে। লাইজুর অভিযোগ বাংলাদেশের প্রয়াত প্রখ্যাত নাট্যকার সেলিম আল দীন এর বিরুদ্ধে। লাইজুর অভিযোগ সেলিম আল দীন তাঁকে ধর্ষণ করতে চেয়েছিলেন। পাঠকদের জন্য লাইজুর ফেসবুক টাইম লাইনের লেখাটি তুলে ধরা হলো।
মুশফিকা লাইজু:
তিনি ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, নাট্যগুরু, আশ্চার্য। এখনও প্রতি বছর তার ছবিতে মালা ঝুলিয়ে তাকে মহান আখ্যা দেয় হয়। যেন বিষয়টা এমন মানুষ কোনরকমে তার জীবিত অবস্থা কৃত পাপ অনাচার ঢেকেঢুকে মরে গেলেই মহান হয়ে যায়। দিন কতক ধরে আমি যখন ভাবছিলাম যে আমিও আমার প্রতি হওয়া ৩১ বছর আগে যৌনহয়রানির কথা #me_too তে লিখবো অনেকেই আমাকে পরামর্শ দিয়েছে, না লিখতে কারণ তিনি মারা গিয়েছেন, তাকে যেন ক্ষমা করে দেই, এখন আর লিখে কি হবে। আমি থামলাম এবং ভাবলাম ও সিদ্ধান্তে পৌছালাম একজন নিযার্তনকারীকে মৃত্যু এসে মহান করে দিতে পারে না। আর আজ যদি আমি না লিখি তবে আগামী পৃথিবী আজীবন তাকে মহান বানিয়ে রাখবে কি জানি আমার কন্যাও হয়তো তাকে একদিন শ্রদ্ধাভরে মালা দিতে যাবে মহান আচার্য্য হিসাবে! তো এমন একজন শিক্ষকের চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন আমার চিন্তারও অতীত।
একদিন তিনি ক্লাসে ইলিয়াড ওডিসি নিয়ে একটা এসাইনমেন্ট দিলেন এবং জিজ্ঞাসা করলেন কে কে এই টেক্সটবুক পড়েছে? আমরা মোট ১১ জন ছাত্রছাত্রী ছিলাম ২ জন পড়ুয়া হাত তুলেছিল, যত দূর মনে পড়ে তার মধ্যে কামাল উদ্দিন কবির একজন। তো ঐ শিক্ষকই বলেছিলেন তার কাছে টেক্সবুক দুটো আছে আমরা সবাই পযার্য়ক্রমে নিয়ে পড়ে নিতে পারি। আমি ছিলাম নবাব ফয়জুন নেসা হলের আবাসিক ছাত্রী আমার হল ছিল তার বাসার (শিক্ষক কোয়ার্টার) কাছেই। তো তিনিই আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন বিকালে ৫টায় যেন আমি বই দুটো তার বাসা থেকে নিয়ে আসি এবং পড়া শেষ করে একে একে সবাইকে দেই।
সম্ভাবত ১৯৮৭ সালের সেপ্টেম্বর মাস হবে অল্প অল্প শীত পড়েছে। আমি ঘড়ি দেখে তার বাসায় উপস্থিত হলাম তিনি দরোজা খুললেন। আমাকে ভিতরে এসে বসার ঘরে বসতে বললেন, তিনি ভিতর থেকে বই দুটো নিয়ে এসে আমাকে দিলেন, বাসাটা কেমন নিরিবিলি আমি ভাবতেও পারিনি যে তিনি বাসায় একা (হয়তো) কারণ আর কারও সাড়া পাইনি! প্রথমে তিনি আমাকে পড়াশুনার ব্যাপারে ফালতু কিছু জিজ্ঞাসা করলেন গৌড়চন্দ্রিকা দেয়ার জন্য, পড়াশুনায় মনোযোগ দিচ্ছি না বলে ভর্ৎসনা করলেন। সংগে এও জানতে চাইলেন আমার গায়ে যে ওভার কোর্ট সেটা কোথায় পেয়েছি, বললাম বাবা বানিয়ে পাঠিয়েছেন, তখনকার সময় ক্যাম্পাসের কেউ এমন ধারার কোর্ট পরেছে বলে দেখিনি। আমি ভেবেছিলাম হয়তো আমাকে সুন্দর লাগছে তাই জানতে চাইছেন। বাস্তবতা ছিল আমার কোর্টে গলা থেকে হাটুর নিচ পযর্ন্ত বোতাম আটকানো ছিল, অতগুলো বোতামের পাহাড়া ভেদ করে আমার স্তন স্পর্শ করা দূরহ হবে সেটাতে তিনি বিরক্ত হয়েছিলেন। সর্বমোট ৫ মিনিট সময় হয়তো আমি সেখানে ছিলাম, আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় আমাকে নিদের্শ পাঠাচ্ছিল কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে, আমি উঠতে যাব এরই মধ্যে তিনি আমাকে ঝাপটে ধরলেন, তার বিচ্ছিরি নোংরা ঠোট আমাকে দংশন করছিল এবং জোর চেষ্টা করছিল আমার কোর্টের বোতাম খোলার জন্য কিন্তু বোতাগুলো বড় ও বিশেষ কায়দায় লাগানো ছিল বলে একটা বোতামও তিনি সেদিন ছিড়তে পারেনি, সৌভাগ্যবশত দুটো দরজাই খোলা (চাপান) ছিল, আমি কোন রকমে ছুটে বই দুটো তার দিকে ছুঁড়ে মারলাম এবং পালিয়ে বাচঁলাম। নিচে নেমে দৌঁড়াতে লাগলাম।
আমি যখন তার বাসার দিকে যাচ্ছিলাম, তখন আমার বন্ধু মুন্নাকে বলে এসেছিলাম যে স্যারের বাসায় যাচ্ছি একটু পরেই ফিরে আসবো। মুন্না আমার জন্য পথেই অপেক্ষা করছিল ওকে পেয়ে গেলাম ওকে ধরে কান্নায় ভেঙে পরলাম। ও বলেছিল তাকে ক্যাম্পাসে মারবে (পরে মুন্না মত বদলেছিল কারন “সেলিম আল দীন” ছিলেন তখনকার সময় ক্যাম্পাসের একজন প্রভাবশালী শিক্ষক), আমি হোস্টেলে ফিরে গেলাম। সারা রাত সেই কোর্টটা পরেই থাকলাম, চিৎকার করে কাদঁলাম, থরথর করে কাপঁছিলাম ঘৃনায় বমি করে ফেললাম, শুধুই বাবার কথা মনে পড়ছিল। ভাবছিলাম আজ বাবার দেয়া এই স্নেহের কোর্টটি আমাকে সম্ভাব্য ধষর্ন থেকে বাঁচিয়েছে। পরে এক সপ্তাহ ক্লাশে গেলাম না, আত্নহত্যার সিদ্ধান্ত নিলাম। বাবাকে দীর্ঘ চিঠি লিখলাম। সহপাঠী কবির, দোলন ও আলমকে জানালাম। ওদের পরামর্শে এক সপ্তাহ পরে স্যারের চেম্বারে গিয়ে তাকে আমার কাছে ক্ষমা চাইতে বললাম। উনি আমাকে উল্টো ধমক দিলেন, উনি এও জানালো যে সে আমার জীবন ধ্বংস করে দিতে পারে আমাকে রাজটিকিট দিয়ে। আমি চিৎকার করলাম, উচ্চস্বরে কাদঁলাম পাশের কক্ষে আফসার স্যার ছিলেন, সে এসে আমাকে শাসনের সুরে বের করে দিলেন, বাইরে এসে আমি কান্নায় ভেঙে পড়লাম। রুমের বাইরে আলম, দোলন, মামুন এবং কবির ভাই দাড়িয়েঁ ছিলেন। আমাকে সবাই সান্ত্বনা দিলেন এই বলে যে এর একটা বিহীত ওরা করবে।
নাট্যকার সেলিম আল দীন
তার পরে টা আরো ভয়ঙ্কর, যথারীতি আমি ক্লাশে যেতে লাগলাম কিন্তু উনি ক্লাশে ঢুকেই প্রথমে আমাকে ক্লাশ থেকে বের করে দিতেন, এবং যতগুলি এ্যসাইনমেন্ট জমা দেয়া ছিল সবটিতে ২০ এর মধ্যে ০ এবং ৯ নম্বর দিয়ে মুখের উপর ছুঁড়ে দিতে থাকলো। তারপরও এক মাস আমি যথারীতি ক্লাশে উপস্থিতি এবং পড়াশুনা চালিয়ে যেতে থাকলাম। সহপাঠিরা আমার প্রতি হওয়া অবিচার দেখে (যদিও মাত্র ১১ জন) চুপচাপ থাকতো, কারণ সবাইকেই প্রথম শ্রেনীর প্রলোভন দেখিয়ে রেখেছিলেন, যদি প্রথম ব্যাচে কেউ প্রথম শ্রেনী পায় র্নিঘাৎ শিক্ষক হওয়ার সূর্বণ সুযোগ পাবে! এই প্রলোভন তাদের দিয়ে রেখেছিল। নিজের নার্ভের সাথে যুদ্ধটা আমি চালিয়ে যেতে পারছিলাম না, দিনে দিনে আমি ক্লান্ত হতে থাকলাম, বিষন্নতা, হতাশা আমাকে ঘিরে ধরল। অবশেষে কাউকে না বলে হলে আমার সব কিছু রেখে এক বস্ত্রে আমার স্বপ্নের জাহাঙ্গীরনগর ক্যাম্পাস ত্যাগ করলাম! তারপরের বৃত্তান্ত অনেক বিশাল, আজ আর না লিখলাম। যদি কোন দিন আমার প্রতি হওয়া এই যৌন হয়রানীর বিষয় একটা আস্ত বই লিখতে পারি সেদিন সবাই জানতে পারবে। আমি যখন পুরোপুরি ক্যাম্পাস ছেড়ে দিয়েছি তার এক বছর (সময়টা ঠিক মনে পড়ছে না) পর কামাল উদ্দিন কবির ভাই (আমার সহপাঠী) এসেছিলেন প্রস্তাব নিয়ে যে এই বিষয়টি নিয়ে আমি আইনি লড়াই করতে চাই কিনা? তিনি সব কাগজপত্র তৈরী করে নিয়ে এসেছিলেন, আমিও রাজি ছিলাম, কারণ আমার বুকের মধ্যে সব সময়ই দহন হতে থাকতো যা আজো অব্যাহত আছে।
কিন্তু আমার তখনকার প্রেমিক আমার সাথে একমত হতে পারলেন না, তিনি স্পষ্ট বলে দিলেন এ যুদ্ধে তিনি আমার সাথে নেই। যখন আমার শিক্ষা জীবন এভাবে থমকে গেলো, ঠিক তখন আমি আমার প্রেমকে হারাতে চাইছিলাম না। তাছাড়া আমি মফস্বলের ১৯ বছরের একটি মেয়ে ঢাকায় কিছু চিনি না, বাড়িতে এ ব্যাপারে সাহায্য করার কেউ ছিল না। সব প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার মতো মনোবল আমার ছিল না। তখন এও উপলব্ধি করেছি যারা আমাকে আইনি লড়াই করতে বলেছে, তারা আসলে সত্যিকারের আমার অসম্মানের প্রতিকারের জন্য আসেনি, এসেছিল আমার ঘটনাটাকে ইস্যু করে ঐ শিক্ষকের প্রতি একটা চাপ সৃষ্টি করা, যাতে তাদের প্রথম শ্রেণী পাওয়া সহজ হয়। যেহেতু আমি ঐ দিন ধষির্ত হইনি, শুধুমাত্র আমাকে চুমো খাওয়া ও শরীর স্পর্শ করাকে কোনভাবে প্রমাণও করতে পারতাম না। সুতরাং আইনের কাছে যাওয়ার আশা ছেড়ে দিলাম। শুধু মনে মনে ভিতরের আগুণটা জ্বালিয়ে রেখেছিলাম, সময়ের অপেক্ষা করেছিলাম জীবনকে একটু গুছিয়ে নিয়ে জনসন্মুখে একটা থাপ্পড় মেরে বলবো এই আমি সেদিনের শোধ নিলাম। কিন্তু হায় এরই মধ্যে মরণ এসে তাকে রেহাই দিয়ে গেল। তবে আমি থেমে থাকিনি, এর পরবর্তীতে উনার যে ছাত্রছাত্রী ও ভক্তকে পেয়েছি, তাকেই বলেছি মাথা উঁচু করে যে আমিই সেই মেয়ে, যে কিনা যৌন হয়রানীর প্রতিবাদে নীরবে বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে দিয়েছি। বড়ই বেদনা যে সেই সময় ঐ বিভাগের শিক্ষক, ছাত্র আরো অনেকে এই ঘটনা জানতেন। কিন্তু কেউ আমার পাশে এসে দাঁড়ায়নি। ধিক সেই সব জ্ঞানপাপীদের, যারা মেনেই নিয়েছিল উনার একটু মদ ও নারী আসক্তি আছে, সেটা তেমন কোন ব্যাপার নয়, এ মেনে নিয়েই উনি মহান নাট্যকার, জাতীয় আচার্য্য!
তবে ঐ ঘটনা আমার জীবন দর্শনকে পুরোপুরি বদলে দিয়েছে। আজ আমি একজন নারীবান্ধব মানুষ, সকল বাধা অতিক্রম করে আমি পোড় খাওয়া জীবন যুদ্ধে হেরে যাওয়া নারীদের পাশে আমার ক্ষুদ্র সামর্থ্য নিয়ে দাঁড়াই, এমনকি আমি আমার পেশার পূর্ব পরিকল্পনা বদলে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছি, নারী অধিকারকর্মী হিসাবে আমি লিঙ্গবৈষম্য বিলুপ্তি নিয়ে কাজ করি।
সেদিন যদি ঐ শিক্ষকরুপী হায়েনা তার ক্ষুদ্র-তুচ্ছ-যৌনক্ষুধা ত্যাগ করে কন্যাসম ছাত্রীকে হয়রানী না করতো, তবে আজ হয়তো আমার জীবন অন্যরকম হতো, হতে পারতাম একজন প্রতিভাময়ী অভিনয় শিল্পী, একজন র্নিমাতা, অথবা সৃজনশীল প্রজ্ঞাবান শিক্ষক। শুধুমাত্র ঐ একটা অসুন্দর পাশবিক সন্ধ্যা আমার জীবনকে এনে দিয়েছে বিভৎস অসংখ্য দিন রাত মাস বছর। ৩১ বছর ধরে আমি জ্বলন্ত আগুন বুকে নিয়ে বসে আছি। ভেবেছিলাম জনসভা করে মাইকে সবাইকে আমার জীবনের গ্লানির কথা বলবো। আমার মনে হয় আমি আজও হয়তো আজকের এই দিনটির জন্য বেচেঁ ছিলাম যখন #Me_too মুভমেন্টের মাধ্যমে জানিয়ে দিতে পেরেছি আমার প্রতি হওয়া সেই অন্যায়ের কথা। আমার কন্যাও আগামী দিনের নৃত্যশিল্পী হয়ে উঠছে, হয়তো পড়তে যাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে। আমি আশা করি তাকে কোন শিক্ষকের অথবা ভদ্রবেশী পুরুষের যৌন লালসার শিকার হতে হবে না। আমি আমার বাকি জীবন প্রানপণে এই পৃথিবীর জঞ্জাল সরাতে সোচ্চার থাকবো, আমি আমার কন্যার এবং সকল আগামী দিনের কন্যাদের জন্য যৌন হয়রানীমু্ক্ত পৃথিবী রেখে যেতে চাই। আর অনুরোধ সেই সুধী সমাজের কাছে; একজন কুৎসিত নিকৃষ্ট মানুষ যেন আপনাদের কাছে থেকে বরন্যের বরমাল্য না পায়।
বিঃদ্রঃ আমি কোন বিচার চাই না, শুধু এইটুকু প্রত্যাশা করি যিনি বা যারা এখনও এই ধরনের নিপীড়নের সাথে যুক্ত আছেন, তাদের বলছি, দিন বদলে গেছে। আগামী পৃাথবীর কাছে সব পাপের, অন্যায়ের হিসাব বুঝিয়ে দিতে হবে।
- ১০৫৪ বার পড়া হয়েছে
পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা
বিঃদ্রঃ নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।