প্রমা ইসরাত

আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মী

মেটাফোরিক ইনফ্যাবুলেশন

লেসবিয়ান বা নারী-নারীর ভেতর যৌন সম্পর্ক হলে তাকে বাংলাদেশ দন্ডবিধি ১৮৬০ অনুযায়ী কোনো অপরাধ হিসেবে ধরা হয় নাই।
কিন্তু পুরুষ যদি পুরুষের সাথে যৌন সম্পর্ক করে তবে সেটা দন্ডবিধি অনুযায়ী অপরাধ।
কিন্তু কেনো?
এইটা কেমন একটা ডিসক্রিমিনিশন হয়ে গেলো না?
এই ব্যপারে নারীবাদীরা চুপ কেনো?
কোথায় গেলো নারীবাদীরা... লা লা লা ...

বাংলাদেশ দন্ডবিধি ১৮৬০, ১৬০ বছরের পুরনো এই আইনের ৩৭৭ ধারাটা একটু দেখি।
কি লেখা, "Unnatural offences"- বাংলা করলে দাঁড়ায় প্রকৃতিবিরুদ্ধ অপরাধ, অনেক বইয়ে এর অনুবাদ হচ্ছে, অস্বাভাবিক অপরাধ।
Whoever voluntarily has carnal intercourse against the order of nature with any man,woman or animal,shall be punished with imprisonment for life,or with imprisonment of either description for a term which may extend to ten years and shall also be liable to fine.

এখন এই Penetration মানে কি? অনুপ্রবেশ- "ঢোকানো" কি ঢোকানো এই ব্যপারে ধারায় কোনো উল্লেখ নাই, কোথায় ঢোকানো এই ব্যপারেও এই ধারায় কোনো উল্লেখ নাই।

সেই হিসেবে, সেই বস্তু, লাঠি, কাঠি, কাঁঠাল যেকোন কিছু হতে পারে। এবং সেই হিসেবে, নাকের ভেতর, কানের ভেতর আঙ্গুল, কাঠি, ঢুকানোও পেনিট্রেশন। এবং লেখা আছে পুরুষ যদি, অন্য কোনো পুরুষ, নারী বা প্রাণীর সাথে এই অনুপ্রবেশ ঘটায় তাহলে তা অপরাধ। মানে, একজন পুরুষ সঙ্গী কিভাবে তার নারী সঙ্গীর সাথে মিলিত হবে, সেইটা নির্ধারণ করে দিবে আইন এবং আদালত।

যাই হোক, এখন আমার প্রশ্ন হচ্ছে, তবে নারী-নারীর ব্যপারে কেনো কিছু স্পষ্ট উল্লেখ করা নাই। এই অনুপ্রবেশ তো নারীও করতে পারে। একজন নারীও তো আরেকজন নারীর সাথে জোর জবরদস্তি করে তাকে আহত করতে পারে।

একজন নারী যদি আরেকজন নারীর পায়ুপথে লাঠি অনুপ্রবেশ করায় তবে সেটাও তো এই আইনে উল্লেখ করা হওয়ার কথা ছিলো। করলো না কেনো? সাইকোলজি কি? কারণ কি এই না যে, ১৬০ বছর আগের আইন প্রণেতাদের মাথায় আসে নি যে, নারী একজন স্বতন্ত্র মানুষ। ১৬০ বছর আগের আইন প্রণেতারা ভাবে নি, নারী পূর্ণাঙ্গ মানুষ।

ছাগলের অপরাধ যেমন অপরাধ না, এই আইনে নারীর ক্ষেত্রেও তাই ভাবা হয়েছে। দুই নারী তাই ঘষাঘষি করলে আইনত দন্ডনীয় না। কারণ, এতে বাচ্চা উৎপন্ন হয় না, নারীর সতীচ্ছেদ ঘটে না, আর মেইন পয়েন্ট নারীর তো অনুপ্রবেশ করানোর মতো লিঙ্গই নেই। আর যেহেতু তার লিঙ্গ নেই, তো যৌনতার ক্ষেত্রে সে কী অনুপ্রবেশ করাবে? ১৬০ বছরের আগের আইন প্রণেতাদের ধারণা ছিলো, যৌন কর্ম শুধু পুং লিঙ্গ অনুপ্রবেশ কেন্দ্রিক।

৩৭৫ ধারায় ধর্ষণের সংজ্ঞা থাকার পরও ৩৭৭ এ নারীর কথা লেখা হলো কেনো? কারণ ধর্ষণের সংজ্ঞায়, নারীর পায়ু পথে কোনো কিছু অনুপ্রবেশ এর ব্যাপারটিকে ধর্ষণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয় নাই। এটাকে অস্বাভাবিক অপরাধ হিসেবে দেখানো হয়েছে।

কেনো একটা ধর্ষণ, আরেকটা অস্বাভাবিক অপরাধ?
এই মাপামাপিটা তারা করলো কিভাবে?

তার মানে কি এই না যে ধর্ষণের ফলে নারীর ইজ্জত চলে যায়, কারণ এতে সতীত্ব নষ্ট হয়, এবং বাচ্চা হওয়ার সম্ভাবনা থাকে?
আর পায়ুপথে কোনো কিছু অনুপ্রবেশ করালে সেটা ধর্ষণ না, কারণ তার ফলে বাচ্চা হবে না তাই নয় কি?
তাহলে সেখানে নারীর মর্যাদা কি ইম্পোর্টেন্ট? নাকি ইম্পর্টেন্ট নারীর সতীত্ব, কিংবা বাচ্চা হওয়া? লেসবিয়ান নারী দুইজন যৌন সম্পর্ক করলে তবে কেনো অপরাধ না? কারণ কি এই না যে, তাতে সতী পর্দা ছেড়ার চান্স নাই, এবং বাচ্চা হওয়ার কোনো চান্স নাই।

মানে ধর্ষণ হলে কী ক্ষতি হয়? নারীর "সতীত্ব" নষ্ট হয়, আর ধর্ষনের ফলে বাচ্চা হওয়ার চান্স থাকে, তাই না? তার মানে এই সতীত্ব নষ্ট হলে কার লস?

আচ্ছা একটা গাড়ি নষ্ট হলে কার লস? গাড়ির মালিকের না?
তাহলে নারীর সতীত্ব নষ্ট হলে কার লস? নারীর মালিকের?
নারীর মালিক কে? তার পিতা, ভাই, স্বামী, এই সমাজ?

একজন পুরুষ যদি কোনো প্রাণীর সাথে অনুপ্রবেশ ঘটায়, তবে সেটা অস্বাভাবিক অপরাধ।
একজন প্রাণী যদি আরেকটি প্রাণীর সাথে অনুপ্রবেশ ঘটায়, তবে তা অপরাধ নয়।
ঠিক তেমনি একজন পুরুষ যদি নারীর সাথে অনুপ্রবেশ ঘটায় সেটা অস্বাভাবিক অপরাধ, কিন্তু কোনো নারী যদি নারীর সাথে অনুপ্রবেশ ঘটায় তাহলে তা অপরাধ নয়।
হেহে। নারী ইজ ইকুয়েল টু অ্যানিম্যাল।

আর অ্যানিম্যাল তো মানুষ কে অনুপ্রবেশ করতেই পারে না, না? তো নারীর কথা বিশেষ করে কেনো উল্লেখ থাকবে সংজ্ঞায়। তাই ১৬০ বছর আগে এই আইনটি তৈরির সময় এই কথাটি আইন প্রণেতারা উল্লেখ করার প্রয়োজনই মনে করে নাই। কারণ নারীর কনসেপ্ট তাদের কাছে লেস দেন এ ম্যান, আর লেস দ্যান এ ম্যান মানে অবমানব, সম্পূর্ণ মানুষ না।

ধর্ষণের ক্ষেত্রে নারীর মর্যাদা এখানে শুধু নারীর মর্যাদা না, তার পরিবারের এবং সমাজের মর্যাদা। কারণ পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় নারীর সম্মান তার যৌনাঙ্গে বিদ্যমান, তাই আফ্রিকায় নারীর যোনীপথ সেলাই করে রাখার প্রচলন আছে যাকে ইনফেবুলেশন বলে।

আর আমাদের দেশের ইনিফেবুলেশন কি জানেন? এইসব ১৬০ বছরের পুরনো আইন।

এখন কি খুশি হবো এই ভেবে যে আমাদের সত্যি সত্যি ইনফেবুলেশন করায় না মেটফোরিক্যালি করায়?

1836 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।