সৈয়দা সুমাইয়া ইরা

চাকুরীজিবি, নারীবাদী।

মেয়ে হয়ে এতো সাহস কোথা থেকে আসে?

গত একমাস যাবত পারিপার্শ্বিক কারণে ডিপ্রেশনে ভুগছিলাম। মনে হচ্ছিল বেঁচে থাকার কোনো কারণ নাই আমার, আমার জীবনে কোনো এচিভমেন্ট নাই, আমার জন্য পৃথিবীর কারুর কোনো উপকারও হচ্ছে না, এটা পাই নি, সেটা পাই নি এসব হিসাব নিকাশ করতে করতে ডিপ্রেশনে পড়লাম।  

এরই মধ্যে আমার প্রিয় একজন মানুষ পুষ্পিতা অনিন্দিতা দিদির হাজবেন্ড ফেসবুকে পোস্ট দিলেন হাওর ট্যুরের। ট্রলারে থাকতে হবে রাতে, ফাইভস্টার হোটেলের মতন সুবিধা এখানে কেউ পাবে না, কষ্টসহিষ্ণু ব্যক্তিরাই শুধু যেতে পারবে এই ট্যুরে এমন পোস্ট দেখে আগ্রহ হলো আমার। এমনিতে জীবনে কোনো সাসপেন্সন নাই অনেকদিন, এই ম্যাড়ম্যাড়ে জীবনে সাসপেন্সন আনতেই সম্পূর্ণ অপরিচিত ১৩ জন মানুষের সাথে আমার হাওর ট্যুর কনফার্ম করলাম। 
 
অপরিচিত মানুষদের সাথে যাচ্ছি এই কথা শুনে অনেকেই সাবধান করেছে, মেয়ে হয়ে এত সাহস কিভাবে আসে এমন কথাও শুনতে হয়েছে। তবে আমার সাহস বেশি এটা আমি নিজেও খুব ভালো করে জানি, সাঁতার না জেনেও আমি লাইফজ্যাকেট পরে হাওরের মাঝে লঞ্চ থামিয়ে নেমেছি, আমি পানির গভীরতায় ভয় পাই নি আর এটাই ছিলো আমার সবচেয়ে বড় এচিভমেন্ট এই ট্যুরে।
 
তাছাড়া আমার উপরে কেউ ঝাঁপিয়ে পরবে এমন ভয় ডরের কোনো কারণ নাই। আমি ইতিমধ্যে জানতে পেরেছি আমরা যারা যাচ্ছি সবাই ব্যক্তিস্বাধীনতায় বিশ্বাসী রুচিবান, স্বশিক্ষিত মানুষ। ট্রলারের বাবুর্চিদের সাথেও এক পর্যায়ে আমার খাতির হয়ে গেলো। সবার আড়ালে নীচে গিয়ে আড্ডাও দিয়েছি ওদের সাথে, আমি সিগারেট ধরাবো আগুন জ্বালিয়ে দেয় ওরা, আমার মনে হয় নি ওরা কেউ আমাকে মেয়ে মনে করতেছে, ওদের মতনই সাধারণ একজন মানুষ মনে করেছে আমাকে। 
 
যাওয়ার পথেই গঞ্জিকা সেবন আর আগের রাতেও অপর্যাপ্ত ঘুমের ক্লান্তিতে সারাপথ ঝিমুতে ঝিমুতেই গিয়েছি। অবশ্য সত্যটা যদি বলি আমি গোটা দু‘দিন নেশার ঘোরে ছিলাম, মদ, তামাক, গঞ্জিকা। আমার এমন রেকলেস আচরণে কর্পোরেটরা জাজমেন্টাল হবে এটাই নরমাল ব্যাপার। 
 
আমি কোনোদিন কারুর তৈরি করা নিয়ম মানি নি, কেউ আমাকে বাজে মেয়ে বললেও আমার গায়ে লাগাই না বলে আমার চামড়া আর গন্ডারের চামড়ায় কোনো পার্থক্য নেই, এমন কথাও শুনছি।  
না, আমার জীবনের কোনো উদ্দেশ্য নাই, কারুর জীবনেরই উদ্দেশ্য নাই আসলে।  যারা জীবনের উদ্দেশ্য খোঁজে তারা একটা মরিচিকার পেছনে ছোটে, জীবনের শেষ পরিণতি একটাই সেটা হলো মৃত্য। মাঝে আমরা যা করি সেটা বোনাস। তাই জীবনে সম্পদশালী, বিত্তবান, উচ্চশিক্ষিত, বিয়ে, সংসার, বাচ্চা, সামাজিক স্টেটাস থাকতেই হবে বলে আমি মনে করি না। জীবনে কি পেলাম আর কি পেলাম না এসব হিসাব করে সময় নষ্ট না করে আজকের দিনটাতেই বিন্দাস থাকতে হবে এটাই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় মোটিভ। 
 
গত একমাস এই কথাটা আমি ভুলে গিয়েছিলাম, আমি অ্যাবসার্ড জীবনে এচিভমেন্ট খুঁজতে গিয়ে মারাত্মক ডিপ্রেশনে ভুগেছিলাম। 
 
এই হাওর ট্যুর আমাকে রিফ্রেশ করেছে, নতুন নতুন মানুষের সাথে পরিচয় করিয়েছে, সবচেয়ে বড় কথা আমার নিজেকে নিয়ে, জীবনকে নিয়ে ভাবতে শিখিয়েছে,  জীবনকে উপভোগ করতে শিখিয়েছে।  
 
আমার মতন নিহিলিস্ট যারা আছেন, ডিপ্রেশনে ভোগেন, সুইসাইডাল টেন্ডেন্সি আছে তাদের রেকমেন্ড করবো একঘেয়েমি দূর করতে এডভেঞ্চার করুন, সাসপেন্সন আনুন জীবনে, জঙ্গলে গিয়ে থাকুন কিছুদিন, অসভ্যদের মতন জীবন যাপন করুন, সম্পূর্ণ ইন্টারনেট আর আধুনিক সুবিধা কিছুদিন বর্জন করে থেকে দেখুন, বেঁচে থাকাটা জরুরি কেনো সেটা বুঝতে পারবেন। মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসলে যেমন বেঁচে থাকার উদ্দীপনা বেড়ে যায় আপনারও তেমন জীবনে বেঁচে থেকে জীবনকে উপভোগ করার ইচ্ছা বৃদ্ধি পাবে এমন এডভেঞ্চার ট্যুরে।  
 
ছোটছোট বিষয় আমাদের কতোটা হ্যাপিনেস দিতে পারে নিজেই টের পাবেন। খোলা আকাশের নীচে বসে চিৎকার করে কয়েকজন মাতাল গলা মিলিয়ে গান গাওয়ার সময় মস্তিষ্ক থেকে হরহর করে সেরোটোনিন বয়ে যাওয়াতে  এক স্বর্গীয় আনন্দের স্বাদ আপনি পাবেন।     
 
বেঁচে থাকুন, আনন্দে থাকুন, জীবনকে উপভোগ করুন, কারণ আমাদের জন্য পরকালে ফুলের বাগান সাজানো নেই, দুধ আর ঝর্ণার নহর নেই, নেই অপেক্ষায় বাহাত্তরটা যৌনসঙ্গী। আমাদের যা আছে সব এই পৃথিবীতে, এখানেই যা পাওয়ার পাবো, যা করার করবো।
 
    

2911 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।