মল্লিকা সেনগুপ্ত ভারতের পশ্চিমবঙ্গের একজন প্রখ্যাত কবি ও লেখক। ১৯৬০ সালের ২৭ মার্চ জন্মগ্রহণ করেন। তিনি তার লেখায় ঋজু, দৃঢ় ও স্পষ্ট। বিশেষ করে মেয়েদের দুঃখ, দুর্দশা, হতাশা, লাঞ্ছনা, উপেক্ষা, সামাজিক শোষণ ও বঞ্চনা নিয়ে বারবার সরব হয়েছে তার কলম । নারীর প্রতি পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার কঠিন ভয়াল রূপকে তুলে ধরেছেন কবিতা ও গদ্যে। জন্ম দিয়েছেন নারীবাদী ও সংবেদনশীল, সমসাময়িক ও ইতিহাস মুখী কবিতা। তার কবিতা আপোষহীন রাজনৈতিক ও নারীবাদী হিসেবে পরিচিত। লিখেছেন, কুড়িটি বই। যার ১১টি কবিতা, দুইটি উপন্যাস এবং নানারকম প্রবন্ধ। অর্জন করেছেন পুরস্কার ও সম্মাননা। ৯০-এর দশকে তিনি ‘সানন্দা’ পত্রিকার কবিতা বিভাগের সম্পাদনা করছেন। পেশাগতভাবে সমাজতত্ত্বের অধ্যাপিকা, রাজনীতিতে সাম্যবাদী। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি কবি সুবোধ সরকারের স্ত্রী এবং এক পুত্র সন্তানের মা।
কবি মল্লিকা সেনগুপ্ত দুরারোগ্য ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ২০১১’র ২৮ মে মাত্র ৫১ বছরে চলে যান। নারী পত্রিকার পক্ষ থেকে, এই সাহসী ও শক্তিশালী কবির দুইটি নারীবাদী কবিতা পুনঃপ্রকাশের মধ্য দিয়ে, তার একাদশ তম মৃত্যু বার্ষিকীতে জানাই অকৃত্রিম সম্মান ও শ্রদ্ধাঞ্জলি।
কবি মল্লিকা সেনগুপ্তের দুটি কবিতা
ফ্রয়েডকে খোলা চিঠি
পুরুষের দেহে এক বাড়তি প্রত্যঙ্গ
দিয়েছে শাশ্বত শক্তি, পৃথিবীর মালিকানা তাকে
ফ্রয়েডবাবুর মতে ওটি নেই বলে নারী হীনমন্য থাকে
পায়ের তলায় থেকে ঈর্ষা করে পৌরুষের প্রতি
প্রকৃতি সদয় নয়
পুরুষ সদয় নয়
সন্তান সদয় নয়
মেয়েদের প্রতি শুধু ফ্রয়েড সদয়!
এই দয়া কে চেয়েছে! চিত্রাঙ্গদা! জোন অব্ আর্ক!
সিমোন দ্য বোভোয়া না শ্যামল দ্রৌপদী!
"পেনিস-এনভি" বলে একটি শব্দ
পৃথিবীতে এনেছেন ফ্রয়েড সাহেব
ওই যে বাড়তি শুধু পুরুষের থাকে
ওই নাকি মেয়েদের কমতি বানায়
তাই তারা শিশুকালে টলমল করে
বালিকা বয়সে তাই শিবলিঙ্গ আকন্দে সাজায়
খেলাঘর ভরে ওঠে পুতুলে ও বাসনকোসনে
কারণ সে নাকি তার মায়ের প্রতিভূ|
অন্যদিকে রোহিতের জন্য থাকে শৌর্যপ্রস্তুতি
জংলাসবুজ উর্দি মার্কিন সেনারা তার ঘরে
ছোটায় মেশিনগান, ট্রা রা রা রা শব্দে সুগঠিত
হয়ে ওঠে পুরুষের আক্রমণ
শাণিত নখরে যদি গাল চিরে দেয়
দিদিমারা খুশি হয় বাড়তি বীরত্বে|
ওই যে বাড়তিটুকু শরীরের, ওই ছাড়পত্র
ওই তাকে পৃথিবীর মালিক বানাবে
রোহিত মালিক হবে কোন পৃথিবীর?
যেখানে রোহিতা তার সহকারী! অধম লিঙ্গ!
ছুটন্ত ঘোড়ার পিঠে খোলা তলোয়ার
বিশ্ববিজয়ে যাবে সম্রাট রোহিত
আর তাকে যুদ্ধ সাজ পরাবে তার মা বোন বউ
এই শুধু চেয়েছেন আপনি ফ্রয়েড!
উল্টোদিক থেকে যদি ঘোটকীর পিঠে কোনও নারী যোদ্ধা আসে
সে কী অস্ত্র ফেলে দেবে ভীষ্মের মতন….
"নারীর বিরুদ্ধে আমি অস্ত্র ধরবো না"
অর্থাৎ নারীকে আমি দেব না অস্ত্রের অধিকার….
এই লিঙ্গরাজনীতি আদি পুরুষের
ফ্রয়েড আপনি নিজে বাড়তির দলে বলে ধরেই নিলেন
মেয়েরা কমতি, তাই পুরুষের প্রতি তারা ঈর্ষাকাতর!
আমার শৈশবে কোনও লিঙ্গঈর্ষা কখনও ছিল না
আত্মপরিচয়ে আমি সম্পূর্ণ ছিলাম
আজও আমি দ্বিধাহীন সম্পূর্ণ মানুষী
তৃতীয় বিশ্বের এক স্পর্শকাতর কালো মেয়ে
আজ থেকে আপনার বিরুদ্ধে দাঁড়াবে
কে অধম কে উত্তম বাড়তি কে কমতি কোনটা….
এই কূট তর্কের মিমাংসা করবার ভার
আপনাকে কে দিয়েছে ফ্রয়েড সাহেব!
আপনি বলুন, মার্কস
ছড়া যে বানিয়েছিল, কাঁথা বুনেছিল
দ্রাবিড় যে মেয়ে এসে গমবোনা শুরু
করেছিল
আর্যপুরুষের ক্ষেতে, যে লালন
করেছিল শিশু
সে যদি শ্রমিক নয়, শ্রম কাকে বলে?
আপনি বলুন মার্কস, কে শ্রমিক,
কে শ্রমিক নয়
নতুন যন্ত্রের যারা মাস মাইনের
কারিগর
শুধু তারা শ্রম করে!
শিল্পযুগ যাকে বস্তি উপহার দিল
সেই শ্রমিকগৃহিণী
প্রতিদিন জল তোলে, ঘর মোছে,
খাবার বানায়
হাড়ভাঙ্গা খাটুনির শেষে রাত হলে
ছেলেকে পিট্টি দিয়ে বসে বসে কাঁদে
সেও কি শ্রমিক নয়!
আপনি বলুন মার্কস, শ্রম কাকে বলে!
গৃহশ্রমে মজুরী হয় না বলে মেয়েগুলি শুধু
ঘরে বসে বিপ্লবীর ভাত রেঁধে দেবে
আর কমরেড শুধু যার
হাতে কাস্তে হাতুড়ি!
আপনাকে মানায় না এই অবিচার
কখনো বিপ্লব হলে
পৃথিবীর স্বর্গরাজ্য হবে
শ্রেণীহীন রাস্ট্রহীন আলো পৃথিবীর
সেই দেশে
আপনি বলুন মার্কস,
মেয়েরা কি বিপ্লবের সেবাদাসী
হবে?