আদিকাল থেকে সন্তান হিসেবে কন্যা ছিলো মা-বাবার কাছে অপাঙ্ক্তেয়। কন্যা সন্তান অপছন্দনীয় হওয়ার অন্যতম কারণ ছিলো যুদ্ধ। মেয়েদেরকে মনে করা হয় দুর্বল। বাংলা সাহিত্যে মেয়েদেরকে ‘অবলা’ আখ্যা দেয়া হয়েছে। প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মের বিরুদ্ধে গিয়ে মানুষ যেমন প্রকৃতির সাথে পেরে উঠেনি তেমনিভাবেই কন্যাসন্তান জন্মদান বন্ধ করার চেষ্টা করেও মানুষ তা বন্ধ করতে পারেনি। ভারতের ছোটো-বড়ো সব হাসপাতালে একটি নোটিশ লাগানো থাকে, “গর্ভস্থ সন্তানের লিঙ্গ নির্ধারণ করা আইনত অপরাধ, এই হাসপাতালে ভ্রূণের লিঙ্গ নির্ধারণ করা হয় না”। কেবলমাত্র কন্যাসন্তান পেটে থাকলে বাবা-মায়েরা এবরশন করতে পারে এমন আশঙ্কা থেকেই সরকার এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে, অর্থাৎ আইন করার মাধ্যমে কন্যাসন্তান রক্ষা করা হচ্ছে। মেয়েদেরকে যে কেবল আজকালকার অশিক্ষিত, কুশিক্ষিত (মাদ্রাসা পাশ) বা কথিত শিক্ষিত লোকেরাই অবলা মনে করে তা কিন্তু না, আগেও মনে করা হতো। ইসলামের নবী মোহাম্মদ তার লিখিত গ্রন্থ কোরআনে বলেছেন: তারা রহমান (আল্লাহর) এর জন্যে যে কন্যাসন্তানের উপমা পেশ করে, যখন তাদের কাউকে তার সংবাদ দেয়া হয়, তখন তার মুখমন্ডল কালো হয়ে যায় এবং ভীষণ মনস্তাপ ভোগ করে। তারা কি এমন ব্যক্তিকে আল্লাহর জন্যে বর্ণনা করে, যে অলংকারে লালিত-পালিত হয় এবং তর্কের সময় স্পষ্ট যুক্তিদানে অক্ষম? (৪৩ঃ১৭-১৮)
মেয়েরা অলংকারের মধ্যে বড় হয়, তারা স্পষ্ট করে কথা বলতে পারে না এমনটাই মনে করতেন ইসলামের প্রতিষ্ঠাতা এবং নবী মোহাম্মদ। যে কারণে সন্তান হিসেবে মেয়েদের অপছন্দ করা হয় সেই কারণটাই ঘৃণা এবং নিষ্ঠুরতার উপরে দাঁড়িয়ে আছে, অর্থাৎ যুদ্ধ। কন্যাসন্তান হলে সে যুদ্ধ করতে পারবে না, সে বংশকে রক্ষা করতে পারবে না এই ছিলো আগেকার মানুষের ধারণা। এখন যে এ ধরনের মনোভাব পাল্টে গেছে তা কিন্তু না। এ ধরনের মনোবৃত্তি এখনও আছে। এখন যুদ্ধের অস্ত্র এবং কৌশল পরিবর্তিত হয়েছে। তরবারি চালিয়ে যুদ্ধ করার যুগ আর নেই। এখন মেয়েরাও সামরিক বাহিনীতে যোগ দিচ্ছে, যদিও সে সংখ্যাটা পুরুষদের তুলনায় একেবারেই নগণ্য। দুনিয়ার কোনো দেশের সেনাপ্রধান নারী আছে কিনা আমি জানি না। না থাকারই কথা। যুদ্ধ যেহেতু নিষ্ঠুরতা ছাড়া আর কিছু না তাই নিষ্ঠুরতার দলনেতা হিসেবে নারীর বেমানানই হওয়ার কথা। আমি বলছি না কেউ আগ্রাসী শক্তির প্রতিরোধ করলে সে নিষ্ঠুর। আমি বলছি না কারো উপর যুদ্ধ চাপিয়ে দিলে সে যদি প্রতিরোধ করে তবে সেটাও নিষ্ঠুরতা। আমি বরং প্রত্যেক আগ্রাসী শক্তিকে বা প্রত্যেক হানাদার বাহিনীকে নিষ্ঠুর বলছি। যারা আগে যুদ্ধ শুরু করে, যারা কোনো জনগোষ্ঠী বা রাষ্ট্রের উপরে অস্ত্র প্রয়োগ শুরু করে তাঁরা নিঃসন্দেহে অপরাধী। যেহেতু অপরাধী সুতরাং এই অপরাধী দলের মধ্যে যুদ্ধাপরাধ হওয়াটা খুবই স্বাভাবিক মনে করে লোকেরা। এবং এটাই হয়-হানাদার বাহিনীই যুদ্ধাপরাধ করে। ওরা নির্বিচারে মানুষ খুন করে। ওরা আবাসভূমি, ফসলের ক্ষেত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সবকিছুই ধ্বংস করে এবং এর সাথে নারীদের ধর্ষণও করে। যেহেতু হানাদার বাহিনীর মধ্যে ন্যায়-নীতির বোধ থাকে না, তাই তারা যা ইচ্ছে তাই করতে পারে। যখনই কোনো ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা রাষ্ট্র তার হানাদার বাহিনীকে অন্য কোনো ব্যাক্তি, গোষ্ঠী বা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিয়েছে তখনই সেখানে নারী ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। উদাহরণস্বরূপ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের কথা বলা যায়। ১৯৭১ সালের এই যুদ্ধে পাকিস্তান থেকে প্রায় লাখখানেক পুরুষ যোদ্ধা এসেছিলো এবং তারা প্রায় ২ লক্ষ বাঙালি নারীকে ধর্ষণ করেছিলো। যতোদিন যুদ্ধ চলেছে ততোদিন এই সংখ্যাটা জানা যায়নি। যুদ্ধ যখন শেষ হয়েছে, যখন নতুন রাষ্ট্র গঠিত হয়েছে, তখন কতো মানুষ খুন হলো, কতো মানুষ ধর্ষিত হলো তার পরিসংখ্যান তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু যদি এমন হতো, যুদ্ধে পাকিস্তানের হানাদার বাহিনীর বিজয় হতো! তখন হয়তো পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশের) মুক্তিযোদ্ধাদেরই দেশদ্রোহী ও বিশ্বাসঘাতকের খেতাব জুটতো। তখন পরিসংখ্যান পাওয়ার উপায় কী থাকতো! যুদ্ধে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় নারী এবং শিশুরা। নারীর সাথে শারীরিকভাবে যেমন সহিংসতা হয় একইসাথে তাদেরকে যৌন নিপীড়নও হয়। হানাদার বাহিনী যৌন নিপীড়নকেও এক ধরনের যুদ্ধ মনে করে। শত্রুদের মনোবল ভাঙ্গার একটি উপায় মনে করে।
ইসলামের নবী মোহাম্মদের যুদ্ধনীতি ছিলো অন্যদের চেয়ে আলাদা। শত্রুপক্ষের নারী এবং শিশুদের গনিমতের মাল আখ্যা দিয়েছিলেন তিনি। এই গনিমতের মাল অর্থাৎ যুদ্ধলব্ধ সম্পদের মালিক হবে মুসলিম যোদ্ধারা (জিহাদিরা)। মালের মালিক হওয়ার কারণে যুদ্ধলব্ধ সম্পদ তথা নারী এবং শিশুদেরকে দাসদাসী হিসেবে গ্রহণ করবে ওরা। কোরআনের বহু আয়াতের দ্বারাই দাসীর সাথে সঙ্গমের ইসলামিক বৈধতা পাওয়া যায়। ইসলাম বরাবরই পুরুষের সুবিধার দিকে নজর দিয়েছে। চারটে বউয়ের পাশাপাশি অগনিত যৌনদাসীও রাখতে পারে মুসলিম পুরুষ। ইসলামী বিধিমতে যেখানে স্ত্রীর সাথেই সঙ্গম করতে তাঁর মতামতের প্রয়োজন নেই, সেখানে দাসীর সাথে সঙ্গম করতে তো তাঁর মতামত নেয়ার প্রশ্নই ওঠে না। আজকের যুগে কারও মতামত ছাড়া তার সাথে সঙ্গম করাকে ধর্ষণ হিসেবে গণ্য করা হয়, এমনকি তা নিজ স্ত্রীর সাথে হলেও। ২০২১ সালে ভারতের কেরালা রাজ্যের হাইকোর্টের বিচারপতি কওসার এডাপ্পাগাথ এবং বিচারপতি এ মুহাম্মদ মুস্তাক স্ত্রীর সাথে তার মতামত ছাড়া সঙ্গমকে বিবাহিত-ধর্ষণ (ম্যারিটাল রেপ) হিসেবে রায় দিয়েছেন। ইসলামের পয়গম্বর মোহাম্মদের একটি হাদিস আধুনিক বিশ্বের ম্যারিটাল রেপের ধারণাকে সম্পূর্ণভাবে অগ্রহণযোগ্য বলে। মোহাম্মদের সাহাবী আবু হুরায়রার বর্ণনামতে, নবী বলেছেন: “কোনো লোক যদি নিজ স্ত্রীকে নিজ বিছানায় আসতে ডাকে (সহবাস করার জন্য) আর স্ত্রী আসতে অস্বীকার করে, আর সেজন্য সেই ব্যক্তি তাঁর স্ত্রীর উপর দুঃখ নিয়ে রাত্রিযাপন করে, তাহলে ফেরেশতাগণ এমন স্ত্রীর উপর সকাল পর্যন্ত লা‘নত (অভিশাপ) দিতে থাকে।” (সহিহ বুখারী, হাদিস নং ৩২৩৭, হাদিসের মান: সহিহ)
মোহাম্মদের অধিকাংশ যুদ্ধই যেহেতু ছিলো আক্রমণাত্মক সেহেতু তাঁর নারী সাহাবিরা বা পুরুষ সাহাবিদের স্ত্রী-কন্যারা আক্রান্ত হয়নি তেমন। সাধারণত এটাই হয়ে থাকে- হানাদার বাহিনীর নারীরা খুব বেশি সাফার করে না। সাফার করে আক্রান্ত জনগোষ্ঠী বা আক্রান্ত রাষ্ট্রের নারী ও শিশুরা। বনু কুরাইযা গোত্রের লোকদের যখন মোহাম্মদ ধরে ধরে জবাই করছিলেন আর মোহাম্মদের সাহাবিরা জবাইকৃত লোকেদের স্ত্রী, কন্যা, বোন এবং মায়েদেরকে গনিমতের মাল হিসেবে বিছানায় নেওয়ার জন্য উন্মুখ হয়েছিলেন সে সময়ে এই গোত্রের এক ইহুদি নারী অট্টহাসি হাসছিলো। সম্ভবত এই নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ দেখে সে তাঁর মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিলো। বিপদের মধ্যেও ইহুদি নারীর এমন অট্টহাসি দেখে খুবই অবাক হয়েছিলেন মোহাম্মদের শিশু-বউ আয়েশা। নারী কেনো জোরে হাসছে তার ওপর আবার সে কাফের, সুতরাং এটা পছন্দ হয়নি মোহাম্মদের। সুতরাং মোহাম্মদের নির্দেশে ঐ নারীর ঘাড়ে তরবারির আঘাত করে তাঁকে হত্যা করা হয়েছে। আধুনিক বিশ্বে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার সাধারণ সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে আঠারো বছর বয়স, কিন্তু ইসলামের শরিয়া আইনে প্রাপ্তবয়স্ক ধরা হয় ছেলেদের জন্য স্বপ্নদোষ হওয়া কিংবা গুপ্তকেশ হওয়াকে। আর মেয়েদের ক্ষেত্রে প্রাপ্তবয়স্ক ধরা হয় স্বপ্নদোষ হওয়া বা মাসিক শুরু হওয়া থেকে। সুতরাং মোহাম্মদ বনু কুরাইযা গোত্রের যেসব পুরুষদের হত্যা করেছিলেন তাদের মধ্যে কেমন বয়সের কিশোররাও শামিল ছিলো আপনি কেবল তা কল্পনা করুন!
ইসলামের যুদ্ধনীতিতে অমুসলিমদের সাথে আঁতাতকারী মুসলমানকেও অমুসলিম বা কাফের গণ্য করা হয়, এবং সে হিসেবে অমুসলিমদের পক্ষাবলম্বনকারী বা তাদের সাহায্য নেয়া যোদ্ধাদের নারী এবং শিশুরাও গনিমতের মাল হিসেবে গ্রহণ করার যোগ্য। আর সেজন্যই ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের শীর্ষ আলেম মুফতি মুহাম্মদ শফি ফতোয়া দিয়েছিলেন, বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধারা যেহেতু কাফের ভারতের পক্ষ নিয়েছে সুতরাং তাঁরাও কাফের হয়ে গেছে। তাদের নারীরা গনিমতের মাল হিসেবে ব্যবহারের যোগ্য। তৎকালীন সময়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী অধিকাংশ ইসলামপন্থী দলগুলো- বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামীও – একই ফতোয়া দিয়েছিলো। এই একটি ফতোয়া পাকিস্তানের এক লক্ষ সৈনিককে সৈন্যকে উদ্বুদ্ধ করেছে বাংলাদেশের ২ লক্ষ নারীকে ধর্ষণ করতে। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, এই ১৯৭১ এর সেই মুফতি মুহাম্মদ শফীর বই বাংলাদেশে খুবই জনপ্রিয়। এখনো তার লেখা বই “তাফসীরে মাআরেফুল কোরআন” বাংলাদেশের অধিকাংশ মুসলমানের ঘরে ঘরে। তাঁর লেখা বিভিন্ন ইসলামিক বই আজও মানুষের ঘরে ঘরে। আর কওমি মাদ্রাসার তো কথাই নেই– সেখানে মুফতি মুহাম্মদ শফি এবং তাঁর পুত্র তকী উসমানী যেনো আসমানি খোদার অবতার!
দুনিয়াতে যখনই কোথাও যুদ্ধ শুরু হয় তখনই মুসলিমরা তাদের নবীর হাদিস খোঁজা শুরু করে, কারণ নবীর হাদিসে প্রচুর পরিমাণ যুদ্ধের কথা এবং ভবিষ্যদ্বাণী রয়েছে। মুসলিমরা যেকোনো মূল্যে সেই ভবিষ্যদ্বাণীকে জোড়াতালি দিয়ে সমসাময়িক যুদ্ধের সাথে মিলিয়ে ফেলে, এবং ‘এই যে দাজ্জাল চলে এলো! এই যে হযরত ঈসা নেমে এলো! এই তো নবীর কথা ফলে গেলো!’ এ সমস্ত কথা তারা বলতে থাকে। অবশ্য কারণও আছে, ইসলামের নবী মোহাম্মদ এমন একজন ব্যক্তি যিনি কোনো রাখঢাক ছাড়াই ঘোষণা দিয়েছিলেন আমি যুদ্ধের নবী (أنا نبي الملحمة)। তিনি যুদ্ধের নবী বটেই। তিনি তাঁর শেষ জীবনের মাত্র দশ বছরে অর্ধ শতাধিক যুদ্ধ করেছেন, এর মধ্যে তিনি নিজে উনিশটি (মতান্তরে, একুশটি) যুদ্ধে তিনি নিজে সশরীরে অংশগ্রহণ করেছেন। আর পঁয়ত্রিশটি যুদ্ধে তিনি নিজে না গিয়ে তার জিহাদি বাহিনীকে পাঠিয়েছেন।
বর্তমান সময়ের সবচেয়ে আলোচিত রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধেও ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে। রাশিয়ান সৈন্যদের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ এনেছে ইউক্রেনের সরকার। তবে রাশিয়ার সৈন্যরা মুসলিম না হওয়ার কারণে খুব সম্ভবত ধর্ষণ তাদের মধ্যে উৎসাহিত নয়। খুব সম্ভবত রাশিয়ান সৈন্যরা গণধর্ষণ করছে না, যদিও যুদ্ধের পরেই প্রকৃত সত্য আমরা জানতে পারবো।
ইসলামিক যুদ্ধের সাথে অন্যদের যুদ্ধের মৌলিক পার্থক্য হচ্ছে, অন্যদের যুদ্ধেও ধর্ষণ হয়, মানবতাবিরোধী অপরাধ হয় কিন্তু তার বিরুদ্ধাচরণ করা বা তার বিপক্ষে কথা বলার সুযোগ আছে। ইসলামে এই সুযোগটা নেই। যা কিছু আপনি ভাবছেন মানবতাবিরোধী কিংবা ধর্ষণ ইসলামে তো তাই-ই আল্লাহ কর্তৃক নির্দেশিত! জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী যা কিছু নিষিদ্ধ তার অধিকাংশই ইসলামের যুদ্ধনীতিতে বৈধ। কাফেরদের নারীদের গনিমতের মাল বানানো এবং তাদেরকে ধর্ষণ করা আল্লাহর পক্ষ থেকে দেয়া বিশেষ নেয়ামত (অনুগ্রহ) যা জিহাদিদের মন ভালো রাখতে সহায়ক। ইসলামের নবী অনেকগুলো বিয়ে করেছেন, ঐ যুদ্ধবন্দিদের মধ্য থেকে সুন্দরীদের বাছাই করে গ্রহণ করতে গিয়েই। উল্লেখ করা যেতে পারে জুয়াইরিয়া এবং সাফিয়ার কথা। এ দু’জনই দু’টি ইহুদি গোত্র প্রধানের মেয়ে ছিলেন। তাদের দু’জনেরই বংশের পুরুষদের মোহাম্মদ হত্যা করে মেয়েদেরকে এবং শিশুদেরকে গনিমতের মাল বানিয়েছিলেন। ইসলাম রক্ষার জিহাদে গিয়ে কাফের পুরুষদের মেরে ফেললে তাদের স্ত্রী-কন্যাদের কি হবে তা নিয়ে বেশ ভাবিত ছিলেন মোহাম্মদ। আর তাই এমন ভাবনা থেকেই তিনি মুসলিম পুরুষদের জন্য চারটে করে বউ রাখা এবং সাথে যৌনদাসী রাখার বন্দোবস্ত করেছিলেন।
আধুনিক বিশ্বে যত যুদ্ধ হয়েছে যেসব যুদ্ধে ধর্ষণের ঘটনা ব্যাপকহারে ঘটেছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের কথা তো বললামই, এছাড়াও আরো কিছু যুদ্ধে ঘটা ধর্ষণের পরিসংখ্যান তুলে ধরছি:
বসনিয়া-হার্জেগোভিনার যুদ্ধ। এখানে ধর্ষণের ঘটনা ঘটে প্রায় ৪০,০০০।
১৯৯৯-২০০৩ সালে লাইবেরিয়ার গৃহযুদ্ধে প্রায় আড়াই লাখ নাগরিকের মৃত্যু হয়, স্থানীয় নারীদের ৫৫%-ই যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছেন।
১৯৯১ থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত চলা সিয়েরালিওনের গৃহযুদ্ধের সময়েও সিয়েরালিওনের প্রায় ২,৫৭,০০০ নারী যৌন ধর্ষণের শিকার হন।
প্রতিটি যুদ্ধেই ধর্ষণ যেনো মহামারী পর্যায়ের। ১৭৫৭ সালে আফগান সম্রাট আহমদ শাহ আবদালী মুঘল-শাসিত ভারত আক্রমণ করে হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে বহু নারীকে ধর্ষণ করে। ১৯০৪-১৯০৫ সালের রুশ জাপান যুদ্ধে অনেক ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। রাশিয়ান সৈন্যরা চীনের মাঞ্চুরিয়াতে এসব ধর্ষণের ঘটনা ঘটায়। ১৯৩৯ সালে জার্মানি কর্তৃক পোল্যান্ড দখল করার সময়েও জার্মান সৈন্যরা পোল্যান্ডের ইহুদি নারীদের ধর্ষণ করে। হিটলারের সেনাবাহিনীর একটি বৈশিষ্ট্য ছিলো, তাঁরা কাউকে ধর্ষণ করলে ধর্ষণের পরেই তাঁকে গুলি করে হত্যা করতো। ১৯৪১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নে জার্মান বাহিনী আক্রমণ করলে সেখানেও হিটলারের সৈনিকরা রাশিয়ান নারীদের ধর্ষণ করেছিলো। ১৯৪৫ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন হাঙ্গেরি দখল করলে প্রায় ২ লাখ হাঙ্গেরীয় নারী ধর্ষণের শিকার হন সোভিয়েত সৈন্যদের দ্বারা। ১৯৭৪ সালে তুরস্ক কর্তৃক সাইপ্রাস আক্রান্ত হলে তুর্কি সৈন্যরা এবং তুর্কি সাইপ্রিয়ট পুরুষেরা বহু গ্রিক-সাইপ্রিয়ট নারীকে ধর্ষণ করেছিলো। এছাড়া ১৯৫৫ সাল থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত চলা ভিয়েতনাম যুদ্ধে মার্কিন সৈন্যদের দ্বারা বহু ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। আর বাংলাদেশের সেনাবাহিনী এবং সেটেলার বাঙালি কর্তৃক পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের ধর্ষণ করার ব্যাপারটা তো সবাই জানে। কেবলমাত্র ১৯৮১ সাল থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত সময়ের মধ্যে বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর সদস্যদের দ্বারা আড়াই হাজারের বেশি আদিবাসী নারীকে ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। ১৯৯০ সালে ইরাক কর্তৃক কুয়েত দখল করার পর ইরাকি সৈন্যরা কুয়েতের প্রায় পাঁচ হাজার নারীকে ধর্ষণ করেছিলো। ২০১৬ সাল থেকে শুরু হওয়া মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে সরকারি বাহিনীর কথিত শুদ্ধি অভিযানের সময় থেকে এখন পর্যন্ত হাজার হাজার রোহিঙ্গা মুসলিম নারীর ধর্ষণ ও গণধর্ষণের শিকার হতে হয়েছে। যেখানে যুদ্ধ হয় সেখানেই যৌন নিপীড়ন হয়। কারণ, যুদ্ধ মানেই বর্বরতা। বাংলাদেশের কওমি মাদ্রাসায় প্রতিদিন লাখ লাখ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়, বিশেষ করে ছেলে শিশুরাই ধর্ষণের শিকার হয়। মাদ্রাসায় কি তাহলে যুদ্ধ চলছে? এর উত্তর হচ্ছে, হ্যাঁ, যুদ্ধ চলছে। অবশ্য কওমি মাদ্রাসায় যুদ্ধ চলছে না বলে বরং যুদ্ধের প্রশিক্ষণ চলছে বলাটাই অধিক সঙ্গত। সেখানের পাঠ্যপুস্তকের ছত্রে ছত্রে রয়েছে জিহাদের নির্দেশনা। সেখানে কাগজে-কলমে জিহাদ এবং ধর্ষণ শিক্ষাদান করা হয়। যেখানে যুদ্ধ (জিহাদ) এবং ধর্ষণ শেখানো হয় সেখানে স্বাভাবিকভাবেই যুদ্ধের অন্যতম অনুষঙ্গ ধর্ষণ এসে যায়। আর তাই, কথিত প্রগতিশীল মুসলিমদের আদরে গড়া প্রতিষ্ঠান কওমি মাদ্রাসাগুলিতে প্রতিদিন লাখ লাখ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়। দুনিয়াতে এতো বড়ো ইন্সটিটিউশনালাইজড রেপ ইন্ডাস্ট্রি (Institutionalized rape industry) দ্বিতীয়টি আর নেই।
বহুদিন আগে আবদুল গাফফার চৌধুরীর কলামে আফগানিস্তানের একটি ঘটনা পড়েছিলাম। ঘটনাটা এমন: আফগানিস্তানের তালেবানি শাসনামলে একজন পশ্চিমা দেশের নারী সাংবাদিক তালেবানের হাতে আটক হয়েছে। কাফের মেয়ে পেয়ে একজন তালেবান সদস্য তার পাজামা খোলার শুরু করেছে, ধর্ষণ করবে এখনই! ধর্ষণ থেকে বাঁচা সম্ভব না বুঝতে পেরে সাংবাদিক তাঁর ব্যাগে থাকা কনডম এগিয়ে দিয়ে তালেবান সদস্যকে কনডম ব্যবহার করতে বললেন। তালেবান সদস্যটি তাৎক্ষণিক বলেছে, লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ… ইহুদি-নাসারার আবিষ্কৃত কনডম আমি পররো? না, এটা হতে পারে না!
যুদ্ধ সবসময়ই বীভৎস। যুদ্ধ কখনোই সমাধান নিয়ে আসে না। যুদ্ধ শুরু করে পুরুষতান্ত্রিক শাসকেরা। যুদ্ধ সবসময়ই নারীর বিপক্ষে যায়। যুদ্ধ সবসময়ই নারী, পুরুষ, শিশু সবার জন্য ক্ষতিকারক হয়। যে হানাদার বাহিনীর পুরুষ সদস্যরা অন্য দেশে গিয়ে খুন-ধর্ষণ করে এবং নিজেরাও শেষমেষ নিহত হয় তাদের পরিবারও কিন্তু অরক্ষিত হয়ে পড়ে। দেখা যায়, সেইসব সৈনিকদের বিধবা স্ত্রীরা পরবর্তীতে সিনিয়র অফিসারদের সাথে যৌনসঙ্গম করতে বাধ্য হয়। সুতরাং আসুন যুদ্ধের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলি, ঘৃণা এবং হিংসার বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলি, অন্ধবিশ্বাসের বিরুদ্ধে কথা বলি। বিশ্বাসীরা মনের মধ্যে ধারণ করেন “আমার ওস্তাদকে আরও বেশি দিতে হবে, আমার ওস্তাদের টাকা আরো বেশি থাকতে হবে, আমার ওস্তাদের রাষ্ট্রের সীমানা আরো প্রসারিত করতে হবে”। বিশ্বাসীরা বিশ্বাস করেন, ধ্বংসের মাধ্যমেই তৈরি হবে নতুন কিছু, ধ্বংসই বয়ে আনবে নতুন সকাল।
ইসলামের নবী মোহাম্মদ তাঁর কোরআনের মধ্যে বলেছেন, “আর তাদের সাথে যুদ্ধ করতে থাকো যতোক্ষণ না ভ্রান্তি শেষ হয়ে যায়; এবং আল্লাহর সমস্ত হুকুম প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়” (আল আনফাল – ৩৯)। অর্থাৎ, সারা দুনিয়ায় ইসলাম জয়যুক্ত না হওয়া পর্যন্ত বা আল্লাহর হুকুমের বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত মুসলিমদেরকে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন ইসলামের নবী মোহাম্মদ, যার আরেক নাম আল্লাহ। সুতরাং যারা মোহাম্মদকে বিশ্বাস করে তারা মোহাম্মদের এই বাণীটিকেও বিশ্বাস করে। যারা এমন বাণীতে বিশ্বাস করে তারা কতোটা ভয়ঙ্কর হতে পারে বলে আপনি মনে করেন? শুধু মোহাম্মদে বিশ্বাসী কেনো, যেকোনো মতের বিশ্বাসীই এরকম ভয়ঙ্কর হতে পারে। নির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তির প্রতি, মতাদর্শের প্রতি বা রাষ্ট্রের প্রতি অন্ধবিশ্বাস আপনাকে জিহাদিদের মতই বর্বর ও নিষ্ঠুর হতে সাহায্য করবে। এমনকি কাউকে ‘নাস্তিকতার মহাগুরু’ মানলেও আপনি জিহাদির মতো খতরনাক হয়ে যাবেন। অন্ধবিশ্বাসী ব্যক্তি মনে করে তাঁর মহাগুরুর কোনো দোষ থাকতে পারে না। কিন্তু তাঁর মহাগুরু প্রতিপক্ষ যারা তারা সবাই অত্যন্ত খারাপ, তাদের দ্বারা ভালো কিছু কখনো হয় না, হতে পারে না।
দুনিয়াতে আদিকাল থেকে পেশীশক্তির জোরে কারো ভূমি, সহায়-সম্পদ বা কোনো দেশ দখল করে নেয়ার চল আগেও ছিলো, আজও আছে। সভ্যতার এতো বিকাশের পরও আদিকালের সেই অসভ্যতা মানুষের মধ্যে রয়ে গেছে। এখনো পেশীশক্তির জোরে অন্যের ভূমি দখল করা অন্যের দেশ দখল করার অসভ্যতা চলছে। এখনো শক্তিশালী দল বা সংখ্যাগরিষ্ঠ দল দুর্বল দল বা সংখ্যালঘুদের উপর সামাজিক এবং যৌন নিপীড়ন করছে। সার্বভৌম বাংলাদেশের কথাই ধরুন না, বাংলাদেশে যুদ্ধ চলছে না তবুও বাংলাদেশে প্রতিবছর হাজার হাজার নারী ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে। যে নিপীড়ন ও ধর্ষণ আগে হতো রাজত্বের জন্য, রাজার হুকুমে আজ সেই নিপীড়ন ও ধর্ষণ চলছে গণতন্ত্রের নামে, রাজনীতিবিদদের হুকুমে। বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমদের মেয়েরা ধর্ষণের শিকার হয় না তা বলছি না, কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ আর সংখ্যালঘু ধর্ষণের মধ্যে পার্থক্য আছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের কেউ ধর্ষিত হলে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষেরা প্রতিবাদ করে, কিন্তু সংখ্যালঘুদের মধ্যে কেউ ধর্ষণের শিকার হলে সংখ্যালঘুরাই তার প্রতিবাদ করে, সংখ্যাগরিষ্ঠরা এগিয়ে আসে না। তারা বরং পরোক্ষভাবে ধর্ষণের পক্ষেই সাফাই গায়। আসলে যুদ্ধ এবং রাজনীতি এই দুটো ক্ষেত্রেই নারীরা সবচেয়ে বেশি নিপীড়নের শিকার হয়। আমি সুস্থ রাজনীতির কথা বলছি না, আমি বলছি রুগ্ন রাজনীতির কথা। যে সমাজে বা রাষ্ট্রে রুগ্ন রাজনীতি থাকে সেখানেই নারীদের প্রতি সহিংসতা বেশি।
ইসলামের নবী মোহাম্মদ যখন অমুসলিম মেয়েদের ধর্ষণ করতেন তখন তিনি এটিকে ‘কাফেরদের শক্তিক্ষয়’ (كسر شوكة الكفار) করার অন্যতম একটি মাধ্যম হিসেবে চিহ্নিত করতেন। শুধু তাই-ই না, তিনি মসলিম পুরুষ কর্তৃক ধর্ষণ করার মাধ্যমে কাফের নারীদের পেটে মুসলমান সন্তান জন্ম দেয়ার একটি প্রক্রিয়া চালু করেছিলেন, সেই প্রক্রিয়া আজও বিশ্বাসগতভাবে চলমান। যে ইসলামী শরিয়া কাগজে-কলমে আজও টিকে রয়েছে সেই শরিয়া যারা পড়বে এবং বিশ্বাস করবে তারা নিঃসন্দেহে পটেনশিয়াল রেপিস্ট হতে বাধ্য। আমার মনে আছে আমি যখন মাদ্রাসায় ফতোয়ার কিতাব পড়ি তখন আমার শিক্ষককে প্রশ্ন করেছিলাম, এখন তো দাসপ্রথা নেই তবে এখনও কেনো দাস-দাসীর মাসআলা-মাসায়েল (বিধি-বিধান) আমরা পড়ি? শিক্ষক উত্তর দিয়েছিলেন, “ধরো কোনো সময় ভারতের সাথে আমাদের জিহাদ হলো তখন ভারতের নায়িকা এবং হিন্দু মেয়েরা তো গনিমতের মাল হবে। তখন তারা দাসী হয়ে যাবে। সেসময় ওদেরকে কিভাবে ব্যবহার (ধর্ষণ) করতে হবে সেসব নিয়মকানুন এখন থেকেই জেনে রাখা ভালো। উল্লেখ্য, যে ফতোয়ার বই আমরা পড়তাম বা যেখান থেকে অমুসলিমদের মেয়েদের ধর্ষণ করার (ইসলামিক মতে ভোগ করার) বিধি-বিধান আমরা পড়তাম সেসব বই ভারতের দেওবন্দ মাদ্রাসার পাঠ্যপুস্তকেরই অন্তর্ভুক্ত। ভারতের দেওবন্দ মাদ্রাসার হুজুরদের দ্বারাই সেসব বই রচিত। ভারতের দেওবন্দ মাদ্রাসার হুজুররা ভারতের হিন্দুদের সাথে জিহাদ করছেন না বা জিহাদ করতে পারছেন না ঠিক, কিন্তু তাদের মনের মধ্যে কি জিহাদের আকাঙ্ক্ষা নেই? যাদের লেখা বই পড়ে বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফগানিস্তানের মাদ্রাসার ছাত্ররা জিহাদি হয়েছে এবং হচ্ছে তাঁরা কি জিহাদি নন?
যুদ্ধের ময়দানে কিংবা মাদ্রাসায় নারী কিংবা ছেলেশিশু যখন ধর্ষিত হয় এবং এরপর সে বেঁচে থাকে বাকি জীবন ওই ধর্ষণের স্মৃতি তাঁকে কুরে কুরে খায়। যে শিশুর হাসি-আনন্দের মধ্য দিয়ে বেড়ে ওঠার কথা ছিলো সে যখন মায়ের আর্তনাদ আর বাবার রক্ত দেখে তখন তার আনন্দ চিরকালের মতো স্তব্ধ হয়ে যায়। আর যে পুরুষটি তার-স্ত্রী সন্তান নিয়ে আনন্দে দিন কাটানোর কথা ছিলো সে যখন গুলিবিদ্ধ হয়ে বা বোমার আঘাতে নিহত হয় তখন তো সব শেষ! এই ধ্বংস দিয়ে আপনাদের ওস্তাদ কি সৃষ্টি করেছেন হে বিশ্বাসী সম্প্রদায়? মাদ্রাসায় ছেলেদের ধ্বংস ও ধর্ষণের শিক্ষা দিতে গিয়ে যে সেই ছেলেদেরকেই প্রথমে ধর্ষণ করে দিচ্ছেন তা কি জানেন হে মহান প্রগতিশীল?
যুদ্ধ বন্ধ হোক। যুদ্ধের শিক্ষা বন্ধ হোক। বন্দি নারীর বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়ন বন্ধ হোক। মাদ্রাসায় ছেলেদের উপর আয়োজিত ধর্ষণ বন্ধ হোক।