নারীর ওপর দমন পীড়ন চালাবার উদ্দেশ্যে ধর্মান্ধ মৌলবাদীদের প্রোপাগান্ডার একটি প্রধান বক্তব্য হচ্ছে, নারীরা তাদের অধিকার পেলে ন্যাংটা হয়ে রাস্তায় ঘুরবে! নারীদের বেশি শিক্ষাদীক্ষার প্রয়োজন নেই! বেশি শিক্ষিত হয়ে গেলে তারা সবার সাথে সেক্স শুরু করবে! ঠিক যেমনটা পর্নগ্রাফিতে আমরা দেখি। একজন নারীর সম্পর্কে অবাস্তব এবং উৎকট কিছু ধারণা! যে নারী মাত্রই যৌনবস্তু, যৌনতার জন্য পাগল, যাকে সামনে পাচ্ছে তার সাথেই শুয়ে যাচ্ছে। আত্মীয় স্বজন পাড়া প্রতিবেশি রিকশাওয়ালা মুদির দোকানদার ড্রাইভার মালি ট্রাক ড্রাইভার পিনাকি লম্বা মোটা খাটো বড় ছোট কেউই বাদ নেই। নারীর মাথাভর্তি খালি সেক্স আর সেক্স, কারটা কয় ইঞ্চি সেই মাপামাপি ছাড়া আর কিছু সে কল্পনা করতে পারে না।
ধর্মীয় মোল্লাশ্রেণি বহুযুগ ধরেই এই কথা প্রচার করে আসছে, যেসব মেয়েরা অধিকারের কথা বলে তারা হচ্ছে বেশ্যা! তাদের হাতে আরো বেশি অস্ত্র তুলে দেয়া যেন কিছু আওয়ামী মন্ত্রী চাচার টাকায় গলাবাজি করা কথিত নারীবাদীর প্রধান লক্ষ্য৷ আমাদের দেশের যেই নারী শ্রমিক পুরুষের সমান মজুরির জন্য লড়াই করছে, এই অধিকারের লড়াই চালানো দমন করার জন্য মোল্লাশ্রেণির খুব সাধারণ কৌশল হচ্ছে, তাকে বেশ্যা হিসেবে উপস্থাপন করা। সে যার তার সাথে শুয়ে বেড়ায়, সারাক্ষণ সেক্স নিয়ে ব্যস্ত থাকে, এরকম ধারণা মানুষের মধ্যে প্রচার করা। নারীকে একটি সেক্স সর্বস্ব সত্ত্বা হিসেবে উপস্থাপনের এই মোল্লাতান্ত্রিক কাজে ঘি ঢালছে এইসব কিছু কথিত এলিট নারীবাদী!
পর্নগ্রাফি আর ধর্মের মতো নারীর সম্পর্কে ঠিক একই ধারণা বর্তমানে কিছু কথিত নারীবাদী প্রচার করে যাচ্ছে, খুব জোরেসোরে। ধারণাটি হচ্ছে, নারীরা অধিকার সচেতন হলে এরকম হয়, সেরকম হয়। তারা দিনে বিশজন আলাদা আলাদা পুরুষের সাথে শুয়ে বেড়ায়, এতগুলো পুরুষ হাতের কাছে না পেলে রিকশাওয়ালা, তাও না পাওয়া গেলে মেয়েদের সাথেও শোয়। যেন একজন নারী মাত্রই নিম্ফোম্যানিয়াক, সে তাড়িত হয় শুধুমাত্র সেক্স দ্বারা, যার কোনো রুচি বা পছন্দ অপছন্দ নেই। নারীর সম্পর্কে এই ধারণার প্রচার আমাদের সমাজে নারীর অবস্থান আরো ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
সেই ব্লগ জীবনের শুরু থেকে নারীবাদ, নারীর অধিকার, লৈঙ্গিক সাম্য নিয়ে লেখালেখি করি। সেই সময়ে আজকের মত এত নারীবাদী ছিলো না, ধর্মান্ধ মৌলবাদীদের অশ্রাব্য গালাগালি একাই হজম করে লিখে যেতে হতো। একবার সামহোয়্যারইন ব্লগে একটা লেখা লিখলাম, নারীর পোশাকের স্বাধীনতা নিয়ে। তারপরের দিনই ব্যান করা হলো একমাসের জন্য৷ কারণ হচ্ছে, আমার নামে রিপোর্ট করা হয়েছে। অবাক কাণ্ড। এরকম বহুবার হয়েছে। মন খারাপ হতো তখন খুব। কিন্তু কিছু করার থাকতো না৷
পিঠ দিয়ে পাহাড় ঠেলা কাকে বলে, সেটা হাড়ে হাড়ে জানি। সেইসময় অনলাইন দখল করার জন্য ধর্মান্ধ মৌলবাদী গোষ্ঠী নানাভাবে কাজ করতো। মগবাজারে জামাতের অফিসে ৫৩ টা ল্যাপটপ ডেলিভারি দিয়েছিলো আমারই পরিচিত এক কম্পিউটার ব্যবসায়ী। সে বলেছিলো, এই ৫৩ টা, আরো বেশি ল্যাপটপ দিয়ে শিবির কর্মীরা সোশাল মিডিয়া আর ব্লগ জামাত শিবিরের পক্ষে জনমত গঠন করে৷ শিফটে শিফটে লোক এসে জামাতের পক্ষে কাজ করে।
সেই সময় শেষ করে এখন আমরা আরেকটু ভালো সময়ে প্রবেশ করেছি। এখন নারীর অধিকার নিয়ে প্রকাশ্যে অন্তত লেখালেখি করা সম্ভব। একটা সময় ছিলো যখন কাউকেই পাশে পাওয়া যেতো না। একলা লড়াইটা চালিয়ে যেতে হতো। এখন নারীবাদীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে, প্রগতিশীলরা লেখালেখি করছে। রাস্তাটা যারা তৈরি করে, আর যারা সেই সুন্দর রাস্তায় হাঁটে, তাদের মধ্যে পার্থক্য থাকে।
বেগম রোকেয়ারা যেই রাস্তাটা তৈরি করে দিয়ে গিয়েছিলেন, সেই নারীবাদ এখন বয়ফ্রেন্ডকে পিরিয়ডের রক্ত খাওয়ানোতে এসে দাঁড়িয়েছে৷ যেই গার্মেন্টস শ্রমিক তার অধিকার নিয়ে লড়াই করছে, তাকে এখন শুনতে হচ্ছে, নারীবাদ মানে লেসবিয়ান সেক্সের ছবি ফেইসবুকে পোস্ট করা আর বয়ফ্রেন্ডকে দিয়ে পিরিয়ডের রক্ত চাটানো। আসলে, আমরা কী এই নারীবাদ চেয়েছিলাম?
একজন নারী লেসবিয়ান হতে পারে, বয়ফ্রেন্ডকে তার পিরিয়ডের রক্তও খাওয়াতে পারে। যার যার নিতান্তই ব্যক্তিগত বিষয়। কারো প্রেমিক যদি তার প্রেমিকার পিরিয়ডের রক্ত খেয়ে সুস্থ ও খুশি থাকে, তাতে আমাদের আপত্তির কিছু নেই। কিন্তু এগুলো কী ঢোল পিটিয়ে জানাবার মতো বিষয়? যদি নারীবাদের ছদ্মবেশে এগুলো করা হয়, নারীবাদ সম্পর্ক আমাদের সমাজে কী মেসেজ যাচ্ছে?
বাংলাদেশের যেই মেয়েটি শিক্ষার অধিকারের জন্য তার পরিবারের সাথে লড়াই করছে, তাকে আজ শুনতে হচ্ছে, নারীরা এত অধিকার পেলে এইরকম হতে হবে। যেই বাবা মা এই টাইপের নারীবাদীদের দেখে মেয়েটিকে আর বেশি পড়ালেখা করতে দেবে না, বাইরে বের হতে দেবে না, এই ভয়ে যে, বেশি অধিকার সচেতন হলে তার মেয়েরও এই অবস্থা হবে, তাদের আমরা কীভাবে বোঝাবো যে, তার মেয়ে এরকম নাও হতে পারে। তার মেয়ের নিজের সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার থাকা জরুরি?
অবশ্যই, পোশাকের স্বাধীনতা প্রয়োজনীয়, নারীর নিজের সিদ্ধান্ত নিজের নিতে পারা প্রয়োজনীয়। একজন নারী যদি ইচ্ছুক হয়, সে কী পোশাক পড়বে, সেই ছবি কোথায় দেবে, তা সেই সিদ্ধান্ত নেবে। এই কাজগুলো জরুরিও। দেখতে দেখতে একসময় মানুষ অভ্যস্ত হয়ে ওঠে। প্রথম দিকে যেরকম প্রতিক্রিয়া দেখায়, পরে প্রতিক্রিয়াগুলো আর একরকম থাকে না। কিন্তু সেটি করতে গিয়ে বয়ফ্রেন্ডকে পিরিয়ডের রক্ত খাওয়ানো, সেসব আবার ফেইসবুকে প্রচার করা কীভাবে সুস্থ মানুষের কাজ হতে পারে! এগুলো করে আমাদের সমাজের নারীদের আসলে আরো বেশি দমন পীড়নের রাস্তা তৈরি করা হচ্ছে না তো?
একলাফে কখনো মগডালে পৌঁছানো যায় না। ধর্মান্ধ পরিবেশে বড় হওয়া একজন হিজাবী নারীর জন্য এইসব উদাহরণ তাকে আরো বেশি বদ্ধ করে তুলবে। সে নিজেকে আরো বেশি শেকলে বেধে ফেলবে, এই ভয়ে যে, ঐরকম হওয়া যাবে না৷ নারীর অধিকার মানে "এইরকম" হওয়া!
নারীবাদীর ছদ্মবেশে সেই ধর্মান্ধ মৌলবাদী শক্তি ঢুকে যায় নি তো? তারা এখন কৌশলে নারীর অধিকারের বিরুদ্ধে কাজ করে যাচ্ছে না তো? তারা দৃষ্টান্ত স্থাপন করছে না তো, যে একজন খেটে খাওয়া নারী তার অধিকারের প্রশ্নে আর সাহস করে কিছু বলতে না পারে?