ঈদের ছুটিতে গ্রামে এসে চল্লিশোর্ধ অধিকাংশ নারীকে আমি অস্টিওপোরোসিসে (হাড়ক্ষয়) ভুগতে দেখেছি। যতোজনকে জিজ্ঞেস করেছি 'কেমন আছেন?' উত্তর পেয়েছি, 'ভালো নেই। হাঁটুতে প্রচন্ড ব্যথা, হাঁটতে পারি না। অথবা শিড়দাঁড়ায় নয়তো কোমড়ে ব্যথা, কেউ কেউ আবার বিছানাগত। দেখাশোনারও কেউ নেই। ছেলেমেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে, আলাদা সংসার।
এতোসংখ্যক মানুষের একসাথে 'ভালো না থাকা' -অবশ্যই আমাদের কনসার্নের ব্যাপার হওয়া উচিৎ। অস্টিওপোরোসিস কী? কেনো হয়? কী এমন পরিবর্তন হয় শরীরে চল্লিশের পরে! কি হতে পারে সমাধান? আমাদের জানা প্রয়োজন।

অস্টিওপোরোসিস হল হাড়ের ক্ষয়রোগ। সাধারণত পঞ্চাশের পর প্রকৃতিগত কারণেই হাড়ের ক্ষয় শুরু হয়। বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে ক্ষয়ের মাত্রা বাড়তে থাকে। প্রাথমিকভাবে ঘাড়, পিঠ, কোমড়ের মাংশপেশীতে ব্যথা করে। এই ব্যথা এক সপ্তাহ থেকে ৩ মাস পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। ধীরে ধীরে এটা শরীরের নিচের অংশে ছড়িয়ে পড়ে। বিশেষ করে হাঁটু। ব্যথা অনেক সময় মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। প্রয়োজন হয় ওষুধ সেবনের।
হাড় ক্ষয়ের ফলে হাড়ের ঘনত্ব কমে যায়। হাড়গুলো হয়ে ওঠে দুর্বল এবং ভঙ্গুর। ফলে খুব অল্প আঘাতেই হাড়গোড় ভেঙে যায় বৃদ্ধ বয়সে। সহজে সারতেও চায় না। হার্ট অ্যাটাকের এক বছরের মধ্যে যত রোগীর মৃত্যু হয়, কোমড়ের হাড় ভেঙে তারচেয়ে বেশি মানুষ মৃত্যুবরণ করে। কিন্তু এসব রোগীরের ব্যাপারে হার্ট পেশেন্টদের তুলানায় ১০% সচেতনতাও দেখা য়ায় না। ব্যাপারটা দু:খজনক।
সারা বিশ্বে প্রায় ২০ কোটি মানুষ অস্টিওপোরোসিসে ভুগছে। প্রতি ৩ সেকেন্ডে নতুন একজন হাড়ের ক্ষয়রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। প্রতি ৩ জন নারীর একজন এই রোগে ভুগে থাকেন। এমন না যে পুরুষরা আক্রান্ত হয় না। তবে তারা সংখ্যায় একটু কম। প্রতি ৫ জনে একজন পুরুষ হাড়ের ক্ষয়রোগে ভোগেন।
এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, নারীরা এই রেসে এগিয়ে কেনো? কারণটা প্রাকৃতিক। পুরুষের মধ্যে যেমন হার্টডিজিজের প্রবণতা বেশি, নারীর মধ্যে হাড়ক্ষয়ের। সাধারণত ৪৫এর পর নারীদের মাসিক বন্ধ হয়ে যায়। একে বলে মেনোপোজ। ক্ষয়রোগে আক্রান্ত হওয়ার অন্যতম কারণ এই মেনোপোজই। কিন্তু কীভাবে? আসুন খুব সহজ কথায় বোঝার চেষ্টা করি।
মেনোপোজ হলে নারী শরীরে সেক্স হরমোন ইস্ট্রোজেনের ভারসাম্য নষ্ট হয়। ইস্ট্রোজেনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজের একটি হলো হাড়ের ক্ষয়পূরণ। আমাদের শরীরের প্রতিনিয়ত হাড়ের ভাঙাগড়া চলে। এই ভাঙাগড়ায় মূলত যে উপাদানটি কমে-বাড়ে তা হচ্ছে ক্যালসিয়াম।
শারীরবৃত্তীয় কাজের প্রয়োজন ক্যালসিয়াম যদি আমরা খাবারের সাথে গ্রহণ না করি, তাহলে হাড় থেকে প্রয়োজনমতো ক্যালসিয়াম নিয়ে সে অভাব পূরণ করে শরীর। এবার হাড় থেকে যেটুকু ক্যালসিয়াম বের করে নেওয়া হল, সেটুকু পূরণ করতে শুধু ক্যালসিয়াম সাপ্লাই দিলেই হয় না। সাথে দরকার হয় ভিটামিন-ডি এবং ইস্ট্রোজেন হরমোন।
হাড়ের এই ভাঙা-গড়ার চক্রে মেনোপোজেরর পর 'ভাঙা' তো আগের মতোই থাকে, পিছিয়ে পড়ে 'গড়া'। শরীরে তখন পর্যাপ্ত পরিমাণ ইস্ট্রোজেন থাকে না। হাড়ক্ষয়ের এই মোটামোটি কারণ।
একটু আগেই বলেছি ক্যালসিয়াম হাড়ে ঠিকভাবে জমা করার ক্ষেত্রে ইস্ট্রোজেনের পাশাপাশি আরেকজন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে, এটি হচ্ছে ভিটামিন-ডি। ভিটামিন-ডি অন্ত্র থেকে ক্যালসিয়াম শোষণ করে শরীরের বিভিন্ন কাজে ক্যালসিয়ামের সাথে অংশ নেয়। এরপর অবশিষ্ট ক্যালসিয়ামকে হাড়ে নিয়ে জমা করে। অর্থাৎ, ভিটামিন-ডি ছাড়া ক্যালসিয়াম ঠিকভাবে কাজ করতে পারে না।
আসুন এবার আরেকটি মারাত্মক তথ্য দিই। গতবছর বাংলাদেশের ১০০ জন প্রাপ্তবয়স্ক নারীর উপর গবেষণা করে দেখা গেছে তাদের মধ্যে ৯৭ জন ভিটামিন-ডি এর অভাবে ভুগছে। অর্থাৎ মাত্র ৩ জনের শরীরেও সাফিসিয়েন্ট না, পরিমিত ভিটা-ডি পাওয়া গেছে। এবার বুঝুন কি ভয়ঙ্কর ডেফিসিয়েন্সিতে ভুগছে আমাদের নারীরা। হাড়ক্ষয় আমাদের দেশে বেশি হবে না তো কোথায় হবে?
আমরা এ পর্যন্ত হাড়ক্ষয়ের জন্য রেসপন্সিবল তিনটা উপাদানের সাথে পরিচিত হলাম। ক্যালসিয়াম, ভিটামিন-ডি এবং ইস্ট্রোজেন। মেনোপজের সাথে সাথে ইস্ট্রোজেনের পরিমাণ কমে যাবে-এটা তো ন্যাচারাল। আমাদের বাকি দুটো উপাদানের সাথে ডিল করতে হবে।
আমাদের খাদ্য তালিকায় ক্যালসিয়ামযুক্ত খাবার কম থাকায় আমরা ক্যালসিয়ামের অভাবে ভুগি জন্মের পর থেকেই। প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় পরিমাণমতো দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার, পণির, কলিজা, ঝিঙে, গুঁড়ামাছ, শিম, পালংশাকসহ অন্যান্য শাকসবজি খেতে হবে বেশি করে। সম্প্রতি আরেকটি গবেষণা বলছে, প্রতিদিন খাবার তালিকায় টকদই (দইও হতে পারে) যুক্ত করা গেলে হাড়ের ক্ষয়পূরণ অনেকাংশে সম্ভব। দইয়ে ক্যালসিয়াম এবং ভিটামিন-ডি দুটোই ভালো পরিমাণে থাকে। এটি হাড়ের ঘনত্ব বাড়াতে সাহায্য করে। এ ছাড়াও ক্যালসিয়াম, ভিটামিন ডি ট্যাবলেটের মাধ্যমে এ চাহিদা পূরণ করা যায়।
ভিটামিন-ডি এর সবচেয়ে ভালো সোর্স 'সূর্যের আলো'। সকালের রোদটা যদিও সবচেয়ে ভালো, তবে সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত রোদ গ্রহণ করা যেতে পারে। এখন প্রশ্ন হলো শুধু রোদে থাকলেই কি হবে? উত্তর হচ্ছে, না। আমাদের ত্বক সূর্যের আলো থেকে ভিটামিন-ডি শোষণ করে। তাই রোদটা সরাসরি ত্বকে পড়তে দিতে হবে। শরীরের বেসিক কিছু অংশ-হাত পা, কাঁধ ও গলার চারপাশ, মুখমন্ডল অনাবৃত করে রাখলে আলাদা কোনো ব্যবস্থার দরকার নেই। তবে যারা আপাদমস্তক ঢেকে রাখেন বোরখা কিংবা আলখেল্লায় তারা প্রতিদিন অন্ততো ১৫-২০ মিনিট বাড়ির ভেতরে যেখানে পর্যাপ্ত সূর্যের আলো প্রবেশ করে সেখানে বসে রোদ পোহাবেন। তাতে কিছুটা ফল পাবেন আশা করছি।
মেনোপোজের পর দুধ জাতীয় খাবারের পরিমাণ বাড়াতে হবে, কেনো বাড়াতে হবে উপরে বিস্তারিত বলেছি। ব্যথা বেশি হলে শারীরিক পরিশ্রম কমিয়ে বিশ্রাম বাড়াতে হবে। অতিরিক্ত ফিজিক্যাল অ্যাক্টিভিটি হাড় ভাঙার কারণ হয়ে উঠতে পারে। তবে জয়েন্টগুলো ফ্লেক্সিবল রাখতে ডাক্তারের পরামর্শে ব্যায়াম করা যেতে পারে।
সবশেষে যেটি বলবো, হাড়ের সুস্থ্যতার জন্য চার ধরণের খাবার আমাদের অবশ্যই এড়িয়ে চলতে হবে। অতিরিক্ত চিনি ও লবণযুক্ত খাবার, মাত্রাতিক্ত ক্যাফেইন ও অ্যালকোহল। পাশাপাশি ধূমপান কমিয়ে দিতে হবে। এই খাবারগুলো হাড় থেকে ক্যালসিয়াম বের হয়ে যেতে সাহায্য করে। এছাড়া হাড়ে মিনারেলের পরিমাণ কমিয়ে দেয়, ভঙ্গুরতা বাড়ায়, এমনকি হাড়ের পুনর্গঠনকে বাধাগ্রস্ত করে।
হাড়ের ক্ষয় তো একেবারে নিরাময় করা সম্ভব না। তবে পরিমাণমতো ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন-ডি গ্রহণ করলে অনেকটা সুস্থ্য জীবনযাপন করা যায়। ২২-৩৯বছর পর্যন্ত হাড়ের গঠনপ্রক্রিয়া চলতে থাকে। এই সময়টা ক্যালসিয়ামযুক্ত খাবরে জোর দিতে হবে। হাড় যতো সুগঠিত আর শক্তিশালী হবে অল্পতে ভেঙে যাওয়ার সম্ভবনা ততো কম থাকবে।
নারীর জীবনকে সুস্থ্যভাবে যাপন করা নারীবাদের বাহিরে নয়। নারীদের এক তৃতীয়াংশকে সীমাহীন শারীরিক কষ্টে রেখে নারীবাদ হবে না। নারীর সুস্বাস্থ্যের কথাও আমাদের ভাবতে হবে। নারীদের তাদের শারীরিক সুস্থ্যতার ব্যপারে সচেতন করে তুলতে হবে। নিজেদের সুস্থ্য রাখার ব্যপারে আমাদের যত্নশীল হতে হবে। অসুস্থ্যতায় জর্জরিত জনগোষ্ঠী কখনোই তাদের অধিকার আদায় করতে পারে না।
