একটা সমাজ ব্যবস্থা হাজার বছর ধরে টিকে থাকে, কারণ আইন, আইন প্রয়োগ করার জন্য তৈরি করা কাঠামো এবং সংস্কৃতি সেই সমাজ ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখে। একটির সাথে আরেকটি এমন ভাবে সম্পর্কিত যে, কখনো মাত্র একটি জায়গায় কাজ করলেই খুব সুনির্দিষ্ট কোনো ফল পাওয়া যায় না।
সমাজ ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার জন্য যে আইন কানুন, তা সমাজের বিরুদ্ধে কোনো সমালোচনা গ্রহণ করে না। ব্যবস্থার বিরুদ্ধ ত্বত্ত্ব ও মত যেমন সে দমন করে থাকে, তেমনি ব্যবস্থার পক্ষে যে তত্ত্ব বা মত রয়েছে, তা প্রতিষ্ঠিত করার জন্য সর্বদা সচেষ্ট থাকে। এই কথা আমার নয়, দেবীপ্রসাদ চট্টপাধ্যায় এর বক্তব্যের আলোকে বলা। এই কথা গুলো এখনও কতো প্রাসঙ্গিক। কেননা, এই ২০২০ এ এসেও, নারী এবং পুরুষের সমতার যে লক্ষ্য, তা এখনো পূরণ হয় নি। প্রতিবারই আপনি নারী দিবস, নারী অধিকার, নারীর ক্ষমতায়ন, নারীর স্বাধীনতা এমনকি নারীর স্বাস্থ্য সেবা নিয়ে কথা বলতে যান, কোনো না কোনো বিরুদ্ধ মত, নিত্য নতুন মোড়কে, নতুন ঢঙে রঙে একই ভাবে সমতার বিরোধিতা করতে এগিয়ে আসবে। কখনো আপনি বিভ্রান্ত হবেন, কেননা আপনার মনে হবে, ঠিক কথাই তো বলছে, ভালো ভালো কথাই বলছে, সুন্দর লাগছে শুনতে। কিন্তু প্রকৃত পক্ষে, তাঁর ভেতরে শুভঙ্করের একটা ভয়াবহ ফাঁকি রয়েছে।
আমাদের তাই প্রতিবারই বার বার করে অধিকার, মানবাধিকার, সমতা, এই সকল শব্দের সংজ্ঞা, তুলে ধরতে হয়।
বার বার বলতে হয় যে, অধিকার মানে সম্পর্কের ভিত্তিতে একটি ন্যায্য দাবির স্বীকৃতি। বারবার বলতে হয় যে, মানবাধিকার মানে মর্যাদার দাবি। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত মানুষের মর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকার অধিকারই হচ্ছে মানবাধিকার। যে অধিকার সহজাত, সার্বজনীন, অহস্তান্তরযোগ্য এবং অখন্ডনীয়। বারবার আমাদের বলতে হয় আমরা সম্পদের সুষম বন্টন চাই। আমরা সাম্যের প্রক্রিয়ায় সমতা অর্জন করতে চাই।
আমরা যখন বলি আমরা বৈষম্যহীন সমাজ চাই, তখন আমাদের বারবার মনে করতে এবং মনে করিয়ে দিতে হয় যে বৈষম্য কাকে বলে। আমাদের যে সকল অধিকার রয়েছে, যা আমাদের নাগরিক অধিকার, অর্থনৈতিক অধিকার, সামাজিক অধিকার, রাজনৈতিক অধিকার, সাংস্কৃতিক অধিকার, সেই সকল অধিকার এর স্বীকৃতি, সেই সকল অধিকার ভোগ করা, সেই সকল অধিকার চর্চা করার ক্ষেত্রে, বাঁধা দেয়া, বাদ দেয়া, পার্থক্য করা, সীমাবদ্ধ করে রাখা যার জন্য একজন মানুষ দূর্বল এবং ক্ষতিগ্রস্থ হয়, তাকেই বলে বৈষম্য।
ব্যাপারটা তো এমন না যে, নারীকে পুরুষের মতো অধিকার ভোগ করতে হবে। সমাজে পুরুষের অবস্থান কে আদর্শ ধরে, নারীর অবস্থান নির্ধারণ করাতে নারীর সমতা অসমতা নির্ধারিত হয় না। আর নারীর সম অধিকারের দিকটি একটি একরৈখিক দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়ও না, বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই সেটাকে দেখা হয়।
এই বছর নারী দিবসের মূল বিষয়, Each for Equal, যেখানে বলা হচ্ছে সমষ্টিগত স্বতন্ত্রতার কথা।
অনেকে ইকুয়ালিটির কথা আসলেই বলে বসেন, নারী ও পুরুষকে সমান ভাবে সব জায়গায় অংশগ্রহণ করতে হবে, পুরুষ যেমন করে ঠিক তেমনি। এই ধরণের সমতার চিন্তায়, সমস্যা হচ্ছে, এই চিন্তা নারী ও পুরুষের যে শারীরিক পার্থক্য আছে, সেটাকে অস্বীকার করে এবং কোনভাবেই, প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য গুলোকে গ্রাহ্য করে না। কিন্তু যে সমষ্টিগত স্বতন্ত্রতার কথা বলা হচ্ছে আজকে, তা প্রকৃত পক্ষে, নারী ও পুরুষের শারীরিক পার্থক্যকে স্বীকার করে এবং যে যে বিষয় নারীকে সমান ভাবে অংশগ্রহণের সুযোগ থেকে বঞ্চিত করে, তা নিঃরসণ করার কথা বলে।
আন্তর্জাতিক নারী দিবস নিয়ে প্রতি বছরই নতুন নতুন ভাবনা ভাবছি আমরা।
ঐতিহাসিক ৭ মার্চ এবং ৮ মার্চ। দুটো দিবসে পার্থক্য থাকলেও, মূল ভাব একই, তা হলো “মুক্তি”। ৭ মার্চের ভাষণে, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান বলেছিলেন, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। হ্যাঁ, আমাদের লড়াইটা শেষ পর্যন্ত মানুষের মুক্তির জন্যে। আর তাই মনে পড়ে যায় যে নিকোলাই অস্ত্রোভস্কির কলমেও উঠে এসেছিলো মুক্তির জন্য বলে যাওয়া আরো শ্রেষ্ঠ কিছু বাক্য।
"জীবন মানুষের সবচাইতে প্রিয়। এই জীবন সে পায় মাত্র একবার বাঁচবার জন্য। এমনভাবে বাঁচতে হবে তাকে যাতে বছরের পর বছর লক্ষ্যহীন জীবন যাপন করার জন্য পরে যন্ত্রণাভরা অনুশোচনায় ভুগতে না হয়, যাতে বিগত জীবনের গ্লানিভরা হীনতার জন্য লজ্জার দগ্ধানি তাকে সইতে না হয়। এমনভাবে বাঁচতে হবে যাতে মৃত্যুর মুহুর্তে সে যেন বলতে পারে: আমার সমস্ত জীবন, সমস্ত শক্তি আমি ব্যয় করেছি এই দুনিয়ার সবচেয়ে বড় আদর্শের জন্য- মানুষের মুক্তির জন্য সংগ্রামে"।
সমষ্টিগত স্বতন্ত্রতা নিয়ে, অধিকার ও মর্যাদায় মানুষ সমান হবে, এই তো লক্ষ্য, এবং এই লক্ষ্য অর্জনেই মানুষ পাবে মুক্তি।