প্রমা ইসরাত

আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মী

সবক্ষেত্রেই নারী স্বাধীনতার চিত্র কি এক?

একই ব্যক্তি, বিভিন্ন সময় এবং অবস্থানে, ক্ষমতাবান এবং, অসহায় হতে পারে। যেমন ধরেন, একজন পি এইচ ডি হোল্ডার নারী, তিনি তার নামের আগে ডক্টরেট লাগান, ভার্সিটিতে শিক্ষকতা করেন, দেখতেও স্মার্ট, ড্রাইভিং জানেন, আবার রান্নাও জানেন। তার স্বামীও ডক্টরেট, এবং তিনিও শিক্ষিত। কিন্তু সেই নারীর সংসারে সকল সিদ্ধান্ত তার স্বামী গ্রহণ করেন। তাদের সন্তানের নাম রাখা থেকে শুরু করে সন্তান কোন খাবার খাবে, এই ক্ষেত্রেও তিনি মতামত দেন, এবং তার স্ত্রী'র নানান বিষয় গুলো নিয়ে ঘরের ভিতর মজা করেন, খোঁচাখুঁচি করেন। এতে সেই নারী হীনমন্যতায় ভোগেন, এবং মানসিক কষ্টে থাকেন। তিনি ডিভোর্স নেয়ার কথাও ভাবতে পারেন না, কারণ তাদের ফ্যামিলি স্ট্যাটাস এতো বেশি হাই লেভেলের যে, এইরকম কোনো ঘটনা ঘটলে, সেই নারীর পরিবার সেই নারীটিকে একদমই গ্রহণ করবে না।

আবার একজন গার্মেন্টস শ্রমিক নারী, তিনি আয় রোজগার করেন, তার আয়ের টাকা তিনি কীভাবে খরচ করবেন, কীভাবে করবেন না, সেই ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত তিনি নেন। তার মতামতের একটা মূল্য আছে তার পরিবারে। তাকে তার ভাই বোন, এমনকি স্বামীও আদর স্নেহ এবং শ্রদ্ধার সাথে কথা বলে।

পি এইচ ডি হোল্ডার নারীটি, মাঝে মাঝে হাই সোসাইটির ক্লাবে গিয়ে মদ খান, তারপর তাদের ড্রাইভার তাকে গাড়ি করে বাড়ি নিয়ে আসে, সে যতো রাতই হোক। কিন্তু গার্মেন্টস শ্রমিক নারীটির সমূহ সম্ভাবনা থাকে কাজ শেষে রাস্তায় রাতে ফেরার পথে ধর্ষণের শিকার হওয়ার।

এই যে, একই ব্যক্তির একেক সময়ে একেক অবস্থা, একবার ক্ষমতাবান হওয়া, আবার অন্য ক্ষেত্রে ক্ষমতাহীন অসহায় হওয়া, এই ব্যপারটিকে ইংরেজিতে Intersectionality বলে। "সামাজিক শ্রেণী সম্পর্কের আন্তঃসংযুক্ত প্রকৃতি"।
[ the interconnected nature of social categorizations such as race, class, and gender as they apply to a given individual or group, regarded as creating overlapping and interdependent systems of discrimination or disadvantage.]

তাই নারী কতো পড়ালেখা করলো, বড়ো চাকরি করে গাড়ি বাড়ি করলো, সেক্ষেত্রে, একটা দিকে নারী ক্ষমতাবান হয় বৈকি, কিন্তু এতে তার মানুষ হিসেবে সম-মর্যাদা পাওয়ার যে স্বীকৃতির লড়াই সেটা সফল হয়ে যায় না।

মদ গাঁজা সিগারেট খাওয়া খাওয়ি তে নারী স্বাধীনতার আসলে কোন প্রশ্ন নেই। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় পুরুষ সিগারেট খেলে হয় খারাপ অভ্যাস। তার প্রেমিকারা সেই সিগারেট ছাড়ানোর জন্য, লক্ষীটি দোহাই তোমার বলে গান গাইতে থাকে। কিন্তু মেয়ে সিগারেট খেলে, তার পুরো চরিত্র খারাপ হয়ে যায়। নারীর বেলাতে সেই সিগারেট, মদ, গাঁজা খাওয়া শুধু খারাপ অভ্যাস থাকে না। সেটা সরাসরি লিংক হয়ে যায় চরিত্রের সাথে।

আবার নারীর শরীর খারাপ হবে বলে, কেয়ারিং বয়ফ্রেন্ডরাও সিগারেট ছাড়ানোর চেষ্টা করেন। এর পেছনের কারণ, নারীর প্রজনন স্বাস্থ্যকে সুস্থ রাখা। পিরিয়ড, প্র্যাগনেন্সি, নানান স্বাস্থ্য সমস্যা, যার কারণে বাচ্চা না হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, যৌন স্বাস্থ্যেও ঝুঁকি তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু সেই ডিসিশনও নারীর জন্য নিয়ে দিচ্ছে তার পুরুষ সঙ্গীটি।

এই সামনে ভ্যালেন্টাইন্স ডে উপলক্ষ্যে, শোয়াশুয়ি না করতে নানান পোস্ট দিচ্ছে একেক জন। যেনো মানুষের যৌন আকাঙ্ক্ষাও শুধু ভ্যালেন্টাইন্স ডে'র দিন চাগাড় দিয়ে উঠে। আর বাদ বাকি দিন ওইখানে তালা মারা থাকে। সেইক্ষেত্রে বোনদের ভার্জিনিটি লুজ না করার জন্য অনেক তৌহিদি ভাই পোস্ট দিচ্ছে। আবার অনেক মেয়ে, বিছানায় যাবে, কারণ তার বয়ফ্রেন্ড, যার সাথে ৫ মাস আগে পরিচয় হয়েছে এবং ইতিমধ্যেই সে তার বয়ফ্রেন্ড এর মা বাবা কে, মা-বাবা ডাকা শুরু করে দিয়েছে, সেই বয়ফ্রেন্ড চায় শুইতে এবং না শুইলে "তুমি আমাকে বিশ্বাস করো না" নামক ভাইরাস বুলি ঝারতে থাকবে।

একটা মেয়ে ১৮ হলে, সেক্স করবে কি করবে না এই সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। "ও অনেক চাচ্ছে", "না দিলে, ছেলেরা অন্য দিকে চলে যায়", "ওকে ভালোবাসি, তাই দেহ দিয়েছি" "ও তো আমাকে বিয়ে করবেই" ইত্যাদি সেন্টিমেন্ট থেকে শুইতে যায়।

নিজের ইচ্ছায়, শুধু সেক্স করতে মন চাইছে ভালোবাসার মানুষটার সাথে, সেই কথা চিন্তা করার ক্ষমতা, বাংলাদেশের হাতে গোনা মেয়েদের মধ্যে আছে। তাও সদ্য ১৮ বা তারও কম মেয়েদের মধ্যে এই চিন্তা হওয়ার সুযোগই কম।

পুরুষতন্ত্র, নারীর শ্রমশক্তি, সন্তান উৎপাদন, নারীর যৌনতা, নারীর চলাফেরা, নারীর অর্থনৈতিক সম্পদ এই ক্ষেত্র গুলোতে নিয়ন্ত্রণ নিয়ে রেখেছে। এবং এই ক্ষেত্রগুলো একটি আরেকটির সাথে কানেক্টেড।

তাই একটি ক্ষেত্রে ক্ষমতা লাভ করলেই, একজন নারী স্বাধীনতা পেয়ে গেলো, বা তার স্বাধীনতার পথ মসৃণ হয়ে গেলো ভাবা ভুল।

1380 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।