পৃথিবী এগিয়ে গেলেও, সমাজব্যবস্থায় বারবার করে যেন পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থাটি টিকে যায়। যেন মনে হয়, সেই আগে পিতৃতন্ত্রকে সমাজ ছয় বেহারার পালকিতে করে ঘরে নিয়ে আসতো, এখন গাড়িতে করে নিয়ে আসে। কিন্তু নতুন মোড়কে বারবার ঘুরে ফিরে আসে ওই পিতৃতন্ত্রই। দাসপ্রথা বিলুপ্ত হয়েছে, বর্ণবৈষম্যের সেই সময়কেও বিদ্রোহে বিপ্লবে দমন করা গিয়েছে, কিন্তু পিতৃতন্ত্রকে এখনো কাবু করা যায় নি। এর কারণ সম্ভবত এই যে, যারা এই পিতৃতন্ত্রের ভাইরাসের ভিক্টিম, তারা জানে না যে তারা ভিক্টিম।
নিজের অবস্থান সম্পর্কে এই অজ্ঞতার জন্যেই, পিতৃতন্ত্র টিকে থাকে, এই সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। তো এটা যদি টিকেই থাকে, তবে কেনো একে নিয়ে এতো কাটাছেড়া? এতো বারবার গলা ফাটিয়ে কেনো সমতার কথা বলতে চাওয়া। এর কারণ, মানুষ কে মানুষের মর্যাদা নিয়ে বাঁচতে হলে যে সমতাবোধের প্রয়োজন হয়, তা পিতৃতন্ত্র কেড়ে নেয়।
ফেমিনিজম নিয়ে কথা বলতে গেলে, অনেকেই মনে করে যে, নারীই হচ্ছে একমাত্র ভিক্টিম। কিন্তু খুব খেয়াল করলে দেখা যায় যে, নারী নয়, পিতৃতন্ত্রের প্রথম ভিক্টিম পুরুষ নিজেই।
একটি ছেলেকে, এই চাপ নিয়ে সমাজে বড় হতে হয় যে, তাকে সংসারের হাল ধরতে হবে, সমাজে অবস্থান তৈরি করতে হবে, এবং সেই অবস্থান তৈরি করতে হলে, তাকে লায়েক হতে হবে, তার গাড়ি-বাড়ি-সম্পত্তি থাকতে হবে, তার স্ত্রী হতে হবে, তার পুত্র সন্তান থাকতে হবে, পুত্র সন্তান না হলেও অন্তত কন্যা সন্তান থাকতে হবে, সন্তান না হলে, সেই স্ত্রী কে ত্যাগ করে অন্য নারীকে স্ত্রী রূপে গ্রহণের মানসিকতা থাকতে হবে। তাকে সুন্দর স্ত্রী পেতে হবে, সমাজে তাহলে তার অবস্থান ভালো হবে। আর সুন্দর স্ত্রী পেতে হলে তাকে শুধু ভাগ্যবান হওয়া চলবে না, তাকে সম্পদশালী হতে হবে, শারিরীক ভাবে শক্ত সমর্থ্য হতে হবে, আর সে রূপবান হলে তো কথাই নেই।
এই যে সমাজে অবস্থান পাওয়ার প্রতিযোগীতা, এটা একটি ছেলে শিশুর মাথায় ছোট বেলা থেকেই ঢুকিয়ে দেয়া হয়, রাজকুমারের নানান রূপকথার মাধ্যমে। আর মেয়ে শিশুদের প্রতিযোগীতা থাকে, শুধু কোনমতে ঠিক এমন রাজকুমারকে স্বামী হিসেবে পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করা।
একজন নারী এই সমাজে স্বপ্ন দেখে না, নিজের সম্পত্তি , নিজের বাড়ি বা নিজের গাড়ি করার। তার মননে মগজে, নিজের সংসারের সকল খরচ বহন করার চাপ থাকে না। একজন নারীকে যদি সংসারের হাল ধরতে হয়, যদি তার পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের জন্য অর্থ রোজগারে নামতে হয়, তাহলে সমাজে সেটা সাধারণ চিত্র না। তার মানে হচ্ছে, সেই নারীর সংসারে বা পরিবারে কর্মক্ষম পুরুষ সদস্য নেই, সেই নারী অসহায়, এবং তার একটা সংগ্রামী রূপকেই তুলে ধরা হয়। কারণ, পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায়, একজন নারী সংসার পরিচালনা করছে মানে, এটা সেই নারীর জন্য সংগ্রামের, এবং পুরুষ সংসার পরিচালনা করছে মানে, এটা খুবই সাধারণ।
নারীর নিজস্ব ঘর বা বাড়ি নেই, কারণ পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা নারীকে সম্পূর্ণ মানুষ হিসেবে দেখে না। পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা নারীকে অবলা অসহায় এবং সব সময় রক্ষণাবেক্ষণ করে রাখতে হবে, এমন অব মানব রূপে দেখে। তাই একা পুরুষের জন্য সমাজ অতো চিন্তা করে না, আহা বেচারা একলা বলে, কিন্তু একা নারীর জন্য, সমাজ তার সুরক্ষার কথা ভাবে, করুণা করে, দুশ্চিন্তা গ্রস্থ থাকে।
নারীর নিজস্ব ঘর বা বাড়ি নেই, কারণ সম্পত্তিতে নারীর অধিকার পুরুষের মতো সমান নয়। কারণ মানসিকতাটা হচ্ছে, তার সম্পত্তির সমান ভাগের প্রয়োজন কী? নারী তো একলা থাকবেই না, তাকে তো বিয়ে করতেই হবে, তার তো ছেলে পুলে হতেই হবে। আর তার সম্পত্তির বা নিজস্ব ঘর আবার কী! পিতার বাড়ি বা স্বামীর বাড়িই তো তার, কিংবা তার সম্পত্তির রক্ষণাবেক্ষণ তো ওই স্বামীকেই, পুত্রকেই করতে হবে, তো সেই হিসেবে কোনো প্রয়োজন নেই নিজস্ব সম্পত্তির, নিজস্ব ঘরের, নিজের ভরণপোষন এর জন্য আয় রোজগারের।
এখনের সময় অনেক নারীই শিক্ষায় অগ্রগামী এবং উপার্জন করছেন। বিয়ের ক্ষেত্রেও উপার্জন করে এমন নারীর খোঁজ করছে অনেক পরিবার। খেয়াল করলে দেখা যায়, বিয়ের পর সেই অর্থ ব্যয় করার ক্ষেত্রে, তার একক সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার নেই। কিংবা সেই উপার্জিত অর্থটুকু তাকে দিয়ে দিতে হচ্ছে পুরুষ সদস্যটির কাছে। সেক্ষেত্রে, সেই নারী শুধু একজন শ্রমিক হয়ে স্থান পাচ্ছে পরিবারে, তার প্রাপ্য মর্যাদা সে পাচ্ছে না।
মানে নারীর প্রতি পিতৃতান্ত্রিক সমাজের শোষণ, সেটা চলমান, ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন রূপে। কারণ যার সাথে শোষণ ঘটছে, সেই শোষিত শ্রেণি জানেই না বা অনুভবই করতে পারছে না যে তারা শোষিত। পিতৃতন্ত্রের সুকৌশলে টিকে থাকার আরেকটি বিষয় হচ্ছে, নারীদের বিচ্ছিন্ন করে রাখা। একজনের থেকে আরেকজনকে খারিজ করে দেয়ার রাজনীতিতে ফেলে দেয়া, বা সুকৌশলে পিতৃতন্ত্রের নারী এজেন্ট তৈরি করে রাখা, যার জন্য সব সময়, একই জেন্ডার হওয়ার পরও একজন নারী আরেকজন নারীর পাশে দাঁড়াতে পারে না, বা চায় না।
এই সমাজব্যবস্থা সবচেয়ে বেশি ভয় পায় নারীর প্রতিবাদ কে। একজন নারী যদি বিচক্ষণ হয়, জ্ঞানে গুণে এগিয়ে থাকে তাহলে এই সমাজ সেই নারীকে পছন্দ করে, কিছু কিছু ক্ষেত্রে তার কদর করে, তার বিচক্ষণতাকে কাজে লাগাতে চেষ্টা করে, আদরে বা শোষণে। কিন্তু যদি সেই নারী প্রতিবাদী হয়, যদি দ্বিমত পোষণ করে, যদি স্বাধীন হতে চায়, তখনই তাকে আক্রমণ করে। এই আক্রমণ শুধু অপছন্দ বা ঘৃণার না, এই আক্রমণ ভয়ের।