সারথি বিশ্বাস

প্রাথমিক স্কুল শিক্ষক, পশ্চিম বঙ্গ।

সমাজ নারীকে শরীর সর্বস্ব ভাবলেও সে শরীরের মালিকানা নারীর না

আত্মা আছে, শরীর নাই। হাওয়ার শনশন, পাতার মড়মড় শব্দ এইসব অশরীরী আত্মাদের অস্তিত্ব বয়ে বেড়ায়। আমি আশৈশব এদের জন্য অনিবার্য ভয়ে কুঁকড়ে থাকতাম। তখন কি বুঝতাম ছাই, আমি নিজেই একটা অশরীরী আত্মা! 

মেয়েদের শরীর তো আছে, কিন্তু সেই শরীরের উপর তার নিজের অধিকার নেই। নারীর শরীর পুরুষের মালিকানাধীন, পুরুষতন্ত্রের খাঁচায় বন্দী। পরিবার থেকে সমাজ, রাষ্ট্র সর্বত্র নারীরা পুরুষতন্ত্র এবং লিঙ্গবৈষম্যের শিকার। পুরুষ কায়া, আর নারী তার ছায়া! তাই,  অশরীরী আত্মার মতো এইসব ছায়া সঙ্গীদের শরীরকে অস্বীকার করা হয়, আর না হয় 'অত্যধিক নজর' দিয়ে গুদামঘরে রাখা হয়। 

শরীরের উপর মেয়েদের অধিকার নিয়ে রাষ্ট্রপুঞ্জের পপুলেশন ফান্ডের (ইউএনএফপিএ) সমীক্ষা বলছে, বিশ্বের ৫৭টি উন্নয়নশীল দেশের প্রায় অর্ধেক সংখ্যক নারীর শরীর পুরুষের মালিকানাধীন। ৫৭ টি দেশের মধ্যে ২০টি দেশে ধর্ষককে বিয়ে করার আইন বহাল। এটা ধর্ষককে শাস্তির হাত থেকে বাঁচানোর জন্য রাষ্ট্রের বেছে দেওয়া ব্যবস্থা। নারীর ইচ্ছা অনিচ্ছা, তার অপমান, লাঞ্ছনা, কিছুই এক্ষেত্রে বিন্দুমাত্র গুরুত্ব পায় না। 

৫৭টি দেশের মধ্যে  ৪৩টি দেশে বৈবাহিক ধর্ষণ সংক্রান্ত কোনো আইন নেই। অর্থাৎ এক্ষেত্রে ধরে নেওয়াই হয়, নারী মানেই  পুরুষের সম্পত্তি এবং পুরুষকে তার সম্পত্তি ভোগ করার থেকে কেউ বিরত করতে পারে না। অর্থাৎ, এখানেও নারীর ইচ্ছা অনিচ্ছার কোনো মূল্য তো নেই-ই, উপরন্তু ধর্ষণের অমানবিকতা, নিষ্ঠুরতার চেয়ে ধর্ষকের পরিচয়টাই বড় হচ্ছে। ধর্ষক 'প্রাণী'-টি স্বামী হলে তার আর কোনো অপরাধ থাকছে না। 

এর মধ্যে ৩০টিরও বেশি দেশ নারীর ঘরের বাইরে ঘোরাফেরায় বাধা দেয়। আর যেসব দেশ বাইরে ঘোরাফেরায় সরাসরি বাধা দেয় না, সেদেশেও নারীরা পদে পদে কত বাধার সম্মুখীন হয় তা নারী মাত্রেই জানে। ৫৭টি দেশের মধ্যে প্রায় ৩০ শতাংশ দেশে এখনও মাতৃত্বকালীন পরিচর্যার অভাব। ২৫ শতাংশ দেশে নারীর গর্ভনিরোধকের সুব্যবস্থা নেই। সুচিকিৎসা দূরে থাক, ন্যূনতম স্বাস্থ্য সুরক্ষা ব্যবস্থাও জোটে সব মেয়ের। 

আমাদের দেশে এখনও বহু মেয়ে স্যানিটারি ন্যাপকিন ছুঁয়ে দেখে নি। নোংরা কাপড় অবৈজ্ঞানিকভাবে ব্যবহার করে 'মেয়েলি রোগ'-এর শিকার হয় এবং উপহসিত হয়। অথচ, কী আশ্চর্য! পুরুষদেরও নির্দিষ্ট কিছু রোগ আছে, সেগুলো কিন্তু পুরুষালি রোগ বলে উপহসিত হয় না। শুধু তা-ই নয়, যা আদতে কোনো রোগই নয়, শুধুমাত্র নারী শরীরের সঙ্গে যুক্ত বলে তাকেও 'রোগ' বলে দাগিয়ে দেওয়া হয়। পিরিয়ড কথাটা তাই ফিসফিস করে উচ্চারণ করতে হয়। এবং সমাজের একটা বড় অংশ এবং অনেক মেয়ে নিজেও পিরিয়ডকে 'শরীর খারাপ' হওয়া বলে। আর ইংরেজি জানা কিছু স্মার্ট ব্যক্তি একে বলে 'মান্থলি ডিজিজ'। অথচ পিরিয়ড কোনো ডিজিজ নয়, বরং সময়কালে তা না হলেই ডাক্তারের কাছে ছুটতে হয়। একটা প্রাকৃতিক শারীরবৃত্তীয়  নিয়মকে কেমন অচ্ছুৎ করে রাখা হয়েছে যুগের পর যুগ! শুধুমাত্র শরীরটা নারীর বলেই ! 

নারীর সাংবিধানিক সমানাধিকার প্রায় সর্বত্র স্বীকৃত। এর পরেও, বৈষম্য, অমর্যাদা, নির্যাতন, উপহাস নারীর নিত্যপ্রাপ্তি। রাষ্ট্রের আইন ও বিচারব্যবস্থা এই অসাম্য রোধে খুব সক্রিয় বলা যায় না। মানব সভ্যতার ইতিহাস এইভাবে যুগে যুগে নারীদের ঊনমানব করে রেখেছে।

1732 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।