শাকিল মাহমুদ

সাংস্কৃতিক কর্মী ও সাংবাদিক

নারী ও আমাদের সংকুচিত ভাবনা

১. শাহরুখ খানের আধা ন্যাংটা ছবি দেখে যতো নারী-পুরুষ মুগ্ধ হচ্ছেন তার চেয়ে অধিক সংখ্যক নারী-পুরুষ দীপিকা গেহরাইয়া দেখে গালিগালাজ করেছেন! আর এটাই পুরুষতান্ত্রিক সমাজের উৎকৃষ্ট উদাহরণ। পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব কেবল পুরুষের মধ্যেই বিরাজমান নয়, নারী-পুরুষ উভয়ের মাঝেই রয়েছে৷ এবং কোনো নারী যদি এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজের আইনকানুনের বিরুদ্ধে যায় প্রথমে একজন নারীই এই বিরুদ্ধাচারণের প্রতিবাদ করে থাকেন। ফলে পুরুষতন্ত্র 'পুরুষ বিদ্বেষ' এমন সব মূর্খ প্রলাপ বকা লোকগুলো বাস্তবিকভাবেই নারী বিদ্বেষী। নারীর এগিয়ে যাওয়া, মানুষ হিসেবে সমাজে টিকে থাকার লড়াইকে মেনে নিতে পারে না৷ এই না মেনে নেয়াটা নিজেদের অস্তিত্ব সংকটের ভয় থেকে জন্মায়। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ, যা এতোকাল ধরে তার পূর্বসুরীগণ বয়ে নিয়ে এসে তাদের কাঁধে তুলে দিয়েছেন তা এখন ভেঙে যাবে ভাবলেই তারা নিজেদের অস্তিত্বহীন মনে করে ভয় পান। আর তখনই উঠে পড়ে লাগেন নারীর বিরুদ্ধে কাজ করতে৷ 

২. সাহসী অভিনয় কাকে বলে? এর উত্তর একেক জনের কাছে একেক রকম। কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ট্যাবু ভেঙে পর্দায় নিজেদের অভিনয় দক্ষতা প্রকাশ করা-ই সাহসী অভিনয়, আমার ফিলোসোফি তা-ই বলে। যেমন ধরুন, আমাদের সমাজের অন্যতম একটি ট্যাবু নারীদের পিরিয়ড। পরিবারের লোকজন পর্যন্ত এই বিষয়টিকে ঢেকে রাখে। মেয়ের পিরিয়ড হয়েছে— এই বিষয়টি নিজের জন্মদাতা পিতা, বড় ভাই, ছোট ভাই কেউ জানতে পারে না। মোটাদাগে পুরুষ কেউ জানতে পারে না আবার অনেক ক্ষেত্রে মা কিংবা বোনকে এই বিষয়টি জানাতে লজ্জাবোধ করে প্রথম পিরিয়ড হওয়া মেয়েটি। এই যে একটি ট্যাবু তা নিয়ে পর্দায় হাজির হয়েছেন খুব কম অভিনয়শিল্পী। যারা হাজির হচ্ছেন তাদের আমরা সাহসী বলছি।

পিরিয়ড অন্যতম একটি ট্যাবু। তারচেয়েও বড় ট্যাবু পর্দায় শিল্পীদের একে অন্যের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ দৃশ্য, গল্পের খাতিরে নগ্ন হওয়া সহ সমাজে অস্বীকৃত সমস্ত কিছুই একজন শিল্পীর জন্য সাহসের। ধরুন, এতোকাল যাকে আপনি পর্দায় গ্লামারাস লুকে দেখে আসছেন, হঠাৎ তাকে এমন একটা চরিত্রে দেখলেন যেভাবে কখনো কেউ কল্পনাও করেনি। সেক্ষেত্রে তার গ্ল্যামারাস লুক ভেঙে এই যে তাক লাগানো নতুন লুক এবং অভিনয় এটাকে সাহসী বলা যায় এবং স্বাভাবিক সেন্সে-ই। কিন্তু একজন নারী পর্দায় ক্লিভেজ দেখিয়েছেন, জামার ফাঁক দিয়ে উরু দেখা গিয়েছে— আমরা স্বাভাবিক সেন্সে তা মেনেই নিতে পারি না। সাহসীকতা বলতে তো নারাজ এক বাক্যে। কিন্তু কেনো?

আমরা সহসাই বলি এটা আমাদের সংস্কৃতি না, ওটা আমাদের সংস্কৃতি না! তাহলে, আমাদের সংস্কৃতি কোনটা? শাহরুখ খান কিংবা শাকিব খান যখন জামার বাটন খুলে সিক্স প্যাক দেখিয়ে বেড়ান সেটা আমাদের সংস্কৃতি? এদেশে আজ থেকে ২০/৩০ বছর আগে নারীরা শাড়ীর সঙ্গে ব্লাউজ পরতেন না, নারীরা বিড়ি টানতেন। কোনো কোনো অঞ্চলে পুরুষের সঙ্গে কোমর বেঁধে নারীরা ক্ষেতে খামারে কাজও করতেন। সেসব তো মান্ধাতার আমলের কথা। এখন আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে, মানুষের জানাবোঝার পরিধি বিস্তৃত হয়েছে। কিন্তু ভাবনা হয়েছে সংকুচিত।

৩. কিছুদিন আগেই সানি লিওন বাংলাদেশে আসেন। তা নিয়ে যে কী এক হুলস্থুল কাণ্ড ঘটে গেলো তা কারোর-ই অজানা নয়। কেনো সানি একজন পর্ণস্টার হয়ে এদেশের এলেন? সব দোষ সানি লিওনের! তবে সে দোষ পর্ণস্টার হওয়ার জন্য নয়, নারী হওয়ার জন্য। মূলত, একজন নারী হয়ে তিনি কেনো পর্ণ নামক কাজের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়েছেন। অথচ পর্ণস্টার পুরুষ অনেকেই আছেন। তাদের নিয়ে কোনো উচ্চবাচ্য নাই৷ তবে শুধু সানি লিওনকে নিয়ে সমাজের মানুষগুলোর মাথা ব্যথা তা কিন্তু নয়৷ উনারা আলিয়া ভাট সিনেমার দৃশ্যে যৌন ক্রিয়া করলেই লাফঝাপ দিয়ে ঈমান রক্ষায় নেমে পড়েন, দীপিকা পাড়ুকোন কোনো সিনেমায় পরকীয়ার গল্পে কাজ করেছেন তার খুটিনাটি বিশ্লেষণ করে নানা বিশেষণ এঁটে দেন দীপিকার গায়ে। কোনো সিনেমায় কৃতি শ্যানন সারোগেসির মাধ্যমে সন্তান জন্ম দিয়েছেন, প্রিয়াঙ্কা চোপড়ার ক্লিভেজ, উরু দেখা গিয়েছে কোনো সিনেমায় কিংবা বাস্তব জীবনে তারা কেমন জীবন যাপন করেন তা নিয়ে চলে পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ এবং তা অনুসারে নানা তকমার লেভেল সেঁটে দেয়া। এগুলো কেবলমাত্র নারীর ক্ষেত্রেই হচ্ছে! কেনো না তারা নারী এবং এই সমাজ পুরুষতান্ত্রিক।

পুরুষতান্ত্রিক সমাজের প্রতিনিধি পুরুষরা পর্ণগ্রাফির সঙ্গে যুক্ত থাকতেই পারেন। তারা পর্ণ নয়, বাস্তবেও তাদের ওই অনবদ্য অর্গান দেখিয়ে পুরুষত্বের দাপট দেখিয়ে বেড়াতে পারেন। সচেতন মানুষ হিসেবে এটাকে আপনার কাছে পৈশাচিক উন্মাদনা মনে হলেও এই সমাজের কাছে এটাই স্বাভাবিক; কেনো না সমাজটা মগজে পুরুষত্ব নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। সানি লিওন পর্ণস্টার এটায় সমস্যা তাও কিন্তু নয়। তাহলে?

ধরুন একজন ফোনে পর্ণ দেখছেন। দেখতে দেখতে বন্ধুদের কাছে ধরা পড়ে গেলেন এবং নিজেকে বাঁচাতে বললেন, এসব বেশ্যাদের দেখে কী হবে! 'বেশ্যা'! এতক্ষণ যাদের দেখে পুরুষত্বের গা ঘিনঘিনে জ্বালা মেটাচ্ছিলেন অথচ এক মুহুর্তেই বেশ্যা হয়ে গেলেন! যেমন ধরুন, আমার আশেপাশের অনেক ছেলেকেই দেখেছি প্রেম করছে, ডেট করছে, সেক্স হওয়ার পর যখন জানাজানি হচ্ছে তখন ছেলেটি মেয়েটিকে 'মাগি' সম্বোধন করে নিজেকে নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে নিচ্ছেন। অর্থাৎ নারী পুরুষের কাছে কেবল মাত্র একটা শরীর, যে শরীর কামনা বাসনা মেটাতেই প্রয়োজন এবং তা ফুরিয়ে গেলে বেশ্যা, মাগিতে পরিণত হন। এই লজিকে আমাদের প্রত্যেকের মা, বোন, মেয়ে অন্য সব পুরুষের কাছেও বেশ্যা, মাগি— তা-ই নয় কি!

জানি এখন অনেকের গা রাগে কিটমিট করবে, আমাকে গালাগাল করবেন, আরো হাজার কিছু। কিন্তু পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা নারীকে প্রাপ্য সম্মান না দিয়ে দিয়েছে বেশ্যা, মাগি খেতাব। আর পুরুষকে করেছে মহামহিম অনবদ্য অর্গান সমেত অশেষ সম্মানে সম্মানিত। সুতরাং সানি লিওনের পর্ণ ভিডিও দেখে মাস্টারবেশন করে যে পুরুষটার দিন শুরু হয়, পুরুষতান্ত্রিক জোশে সেও সুযোগ পেয়ে তাকে বেশ্যা, মাগি বলে গালি দিচ্ছে। এটাই পুরুষতান্ত্রিক সমাজে বাস করা প্রত্যেকের সাইকোলজি।


হিপোক্রেট সাইকোলজির বস্তা বস্তা উদাহরণ চোখের সামনে কিলবিল করে ঘুরে বেড়ায়। যেমন, কয়েক মাস আগেই আরিফিন শুভ-এর অর্ধনগ্ন শরীর দেখিয়ে শারীরিক কসরত করার ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছিল। যে ভিডিও নিয়ে চলেছে ব্যাপক প্রশংসা এবং আরিফিন শুভ-এর এমন শারীরিক কসরতকে অনেকেই সাধুবাদ জানিয়েছে৷ আমিও জানাই৷ কিন্তু সামাজিক মাধ্যমে আরিফিন শুভ-এর খোলা শরীর দেখে কেউ জাত গেলো! জাত গেলো! বলে মাতম তোলেনি। অথচ জয়া আহসান পোশাক পরে একই কাজের ছবি পোস্ট করলে গেলো! গেলো! বলে ঈমানী চিৎকার শুরু হয়ে যেতো। সঙ্গে চলতো কুৎসিত মন্তব্য, পৈশাচিক বাসনা প্রকাশ পেতো সেসব মন্তব্যে। অভিনয় শিল্পী হিসেবে শুভকে যেমন সাধুবাদ জানানো হচ্ছে তেমন জয়াকে জানানো হচ্ছে না কারণ জয়া নারী, তার অনবদ্য পুরুষালি অর্গান নাই যা শুভ-এর রয়েছে। ফলে শুভ এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজে এক্সট্রা সুবিধা বাগিয়ে নিচ্ছে ওই অর্গানের জোরে। আর জয়া মার খেয়ে যাচ্ছে নারী হওয়ার কারণে। অথচ অভিনয় নৈপুন্যতায় শুভ-এর থেকে কয়েক গুন এগিয়ে জয়া!

একই চিত্র বাঁধনের ক্ষেত্রে। সিঙ্গেল মাদার হওয়ার কারণে নানা রকম কথা শুনতে হয় তাকে। পুরুষের নানা কু-প্রস্তাব যে আসে না তা এই সমাজে কল্পনা করাও পাপ। কিন্তু একজন সিঙ্গেল ফাদার! তাকে কি কোনো নারী কু-প্রস্তাব দিচ্ছে? এই সমাজ তার উদাহরণ দিতে পারবে? পারবে না, কারণ পুরুষের জন্য গোটা সমাজ ব্যবস্থা এবং নারীর বিপরীতে। মেধার বিচারে সমাজে কাউকে মূল্যায়ন করা হয় না। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর মেধাকে পদদলিত করে রাখা হয়। কারণ তার দোষ সে নারী; এটাই তার আজন্মের পাপ।

 

1853 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।