মিনার্ভা সেঁজুতি

লেখক ও আবৃত্তিকার

অটোর ভিতরে অন্ধকার, পাশে দুইজন অপরিচিত পুরুষ!

ভেলোর গান্ধীরোড, সিএমসি হাসপাতালের সামনে। এ জায়গাটায় অনেক ভিড় থাকে। বিশেষ করে সকাল আটটা থেকে প্রায় রাত নয়টা পর্যন্ত। এসময় সিএমসি হাসপাতাল থেকে বের হয়ে রাস্তার অপর পারে যাওয়া আসা ঝক্কির ব্যাপার। ছোট রাস্তা, গাড়ির চেয়েও মানুষ বেশি। সবারই চিকিৎসার জন্য আসা। সবার অনেক তাড়া। গান্ধীরোড খুব ঘিঞ্জি এলাকা। এখানেই বেশিরভাগ লজ, হোটেল। রোগীরা এদিকেই বেশি থাকে কারণ হাসপাতালের পাশে থাকা যায়। যার জন্য এ রোডটাতে ভিড়বাট্টা লেগেই থাকে। আমার কাছে অনেকটা ঢাকার গাউছিয়ার মতো লাগে। রাস্তার দুই পাশে ছোট ছোট দোকান। ফুটপাতেও লোকজন জিনিসপত্র নিয়ে বসে থাকে।

প্রথম যখন এখানে আসি তখন খুব আতংকিত হয়ে চলাফেরা করতাম। ব্যাগটা বুকে চেপে হাঁটতাম। ভয়ে থাকতাম কে কখন কোনদিক দিয়ে গুতা মারে এই ভিড়ের ভিতর। কিছুদিন যাওয়ার পর খুবই অবাক হলাম, আরে কেউ ধাক্কা মারে না! গুতাও মারে না! আমিতো খুবই অবাক! বাংলাদেশের মাইয়া! সেই ছোটবেলা থেকেই ভয় আর আতংক নিয়ে পথ চলা অভ্যাস। ব্যাগ বুকে চেপে চলা অভ্যাস! খুবই অবাক হয়ে যাই আমি! আরো অবাক হই যদি আমিই তাল সামলাতে না পেরে এখানকার স্থানীয় কোনো পুরুষের গায়ে পড়তে যাই সে অসম্ভব দ্রুততায় নিজেই সরে যায় যেন ধাক্কা না লাগে তার সাথে আমার! এসব দেখে তো আমার অজ্ঞান হওয়ার দশা! আমিও খুশীতে এখানে ছড়ায়ে ছিটায়ে হাঁটি! ভাবি ধাক্কা লাগার হইলে অন্যরাই সরে যাবে। জীবনের প্রথমে কোন জড়তা ছাড়া হাঁটি আমি! আরো আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে দুই একবার ধাক্কা খাইছি অবাক হয়ে দেখছি ধাক্কা মারা লোকটা আমারই দেশের! চিকিৎসা করতে আইসাও...! ঐ আরকি! কয়লা ধুইলে ময়লা যায় না, স্বভাব যায় না ম'লে! আমাদেরও অভ্যাস হয়ে গেছে জড়সড় হয়ে হাঁটা আর ওদেরও অভ্যাস সুযোগ পাইলেই!

সিএমসি হাসপাতালে এত এত ভিড় হয় কি বলবো! কিন্তু সেখানেও মেয়েদের কেউ ধাক্কাধুক্কা দেয় না! আমি এখানে ধাক্কা খাই নাই! আর দিলেও ঐ যে বললামতো কারা দেয়! এখানকার সবধরনের সব পেশার মেয়েদের (নিম্নশ্রেণী থেকে উচ্চশ্রেণী) দেখলেই অন্যরকম লাগে। শাড়ী, সালোয়ার কামিজ, ওড়না, জিন্স, টি শার্ট, হাফ প্যান্ট, স্লিভলেস, ফুলহাতা, বোরখা ইত্যাদি ইত্যাদি .. যেই পোশাকই পরা থাক না কেন ওদের মুখে যে আত্নবিশ্বাসের আলো তা আমাকে অবাক করে! ওদের কিশোরী মেয়েদের স্বাভাবিক উচ্ছ্বল প্রাণবন্ত চলাফেরা আমায় মনে করিয়ে দেয় আমরা এত ফ্রি চলাফেরা করতে পারতাম না। কত ভয়, শংকা নিয়ে আমরা জড়সড় হয়ে পথ চলেছি। এখনো তাই চলতে হয়! এখানে পোশাকের ক্ষেত্রেও কত স্বাধীনতা! কেউ কারো দিকে পোষাকের জন্য অদ্ভূতভাবে তাকিয়ে থাকে না।

যাতায়াতের ক্ষেত্রেও প্রথমে লোকাল বাসে চড়তে ভয় পেয়েছি, শেয়ার অটোতে ও! কিন্তু দুই একবার চড়েই বুঝলাম কোন ভয় নেই! নিরাপদে চলাফেরা করা যায় এখানে! কেউ ধাক্কা বা গুতা মারবে না, বরং সহযোগিতা করে। সেদিন শেয়ার অটোতে প্রথমে আমি উঠার পর রাস্তা থেকে আরো দুজন পুরুষ উঠলো, আমি আমার স্বভাবজাত ভয়ে আক্রান্ত হলাম! রাত প্রায় আটটা বাজে। অটো ড্রাইভার আর ঐ দুটো লোক! আমার আত্মারাম খাঁচা ছাড়া হবার যোগাড়! মি টু তে লেখা অনেকের অনেক অভিজ্ঞতার কথা মনে পড়ছিলো। ডরে ডরে ভাবতাছি ঠিক জায়গায় নামাবে তো! অটোর ভিতরে অন্ধকার, পাশে দুইজন অপরিচিত পুরুষ! এমন অবস্থায় আমি আমার ছোটবেলার অভ্যাসে ভিড় দেখলে, লোকাল বাসে সুরা পড়ি। তাই পড়তেছিলাম কিন্তু ভুলভাল না ঠিকঠাক তা কিন্তু বলতে পারবো না। শক্ত হয়ে বসে রইছি। জায়গায় আসলেই চিৎকার করে থামতে বলবো! কিন্তু চিৎকার ছাড়াই অটো জায়গামতো এসেই দাঁড়ালো আর ঐ পুরুষ দু’টো নেমে দাঁড়িয়ে আমাকে নামার জায়গা করে দিলো। আমাকে কিছুই বলতে হলো না! এদের এখানকার এমন ব্যবহার আমাকে অবাক করে, মুগ্ধ করে। আমি কালো কালো কিন্তু মনের আলোয় আলোকিত লোকগুলোকে অবাক হয়ে দেখি!

আমি শুধু নিজের বিষয়ে না, আমার সামনে অন্য কোনো মেয়েকে কেউ হ্যারাস করতে চাইলে নিজে যেচে সেই ঘটনায় ঢুকে পড়ি। ঐ মেয়েটার পাশে দাঁড়াই। সেদিন হাসপাতালে আর্যরে নিয়ে বসে আছি। ডাক্তারের ডাকের অপেক্ষায়। এমন সময় দেখি, আমাদের পাশের সিটের একলোক তার হাটুঁ এভাবে রাখছে সামনের সিটে যে তামিল মেয়েটা বসছে তার পাছাতে কিছুক্ষন পর পর সেটা লাগছে। বোঝাই যাচ্ছে ইচ্ছে করেই লোকটা এমন করছে। তামিল মেয়েরা এত সহজভাবে চলে যে মনে হয় ওদের আমাদের মতো এধরনের অভিজ্ঞতা নেই। আমি এই বদমাইশটাকে কিছু না বলে মেয়েটাকে ডেকে বললাম, এই লোকটা পা লাগাচ্ছে তোমার গায়ে। এটা বলার সাথে সাথে বদমাইশটা সরি টরি বলে পা নামিয়ে নিল। আর আমার জন্য লজ্জা এবং মন খারাপের বিষয় হলো যখন বুঝতে পারলাম এ বদমাইশটা আমারই দেশের!

ভেলোরে খারাপ লোক নাই, খারাপ ঘটনা ঘটে না তা আমি বলছি না। তবে আমি আমার দেশে এত নিরাপদে, এত স্বস্তিতে কোনোদিন পথে হাঁটি নাই। কিন্তু ভেলোরে হেঁটেছি!

 

2999 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।