ডাইনিপ্রথা নামক ভয়াবহ কুসংস্কারের বিষে এখনও জর্জরিত ভারতবর্ষের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলো , বিশেষত আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চল - যেখানে শিক্ষা স্বাস্থ্য বিজ্ঞানচেতনার আলো পৌঁছতে পারেনি এখনও ঠিকঠাক । ডাইনিপ্রথা কেবল ভারতে নয় , বিশ্বের অনেক দেশ অঞ্চল বা সংস্কৃতিতে এখনো অস্তিত্বশীল । এখনও ডাইনি অপবাদ দিয়ে পুড়িয়ে , গলা কেটে , গাছে বেঁধে খুঁচিয়ে , পিটিয়ে মেরে ফেলার ভুরি ভুরি উদাহরণ আমাদের সমাজে বিদ্যমান । অতীতের সতীদাহ প্রথা নামক কুপ্রথার মতোই , এই ডাইনিপ্রথার পেছনেও রয়েছে কদর্য সব কূট অভিসন্ধি , কোথাও অনাথ বিধবা অসহায় অশক্ত নারীর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে সমাজের অপেক্ষাকৃত সবল অংশ দ্বারা অন্যায়ভাবে সেসব ভোগদখল করার লালসা , কোথাও শরীর দখলের অভিসন্ধি প্রত্যাখ্যাত হলে তার প্রতিশোধ নেবার বাসনা , কোথাও জমিজায়গা ইত্যাদি নিয়ে গণ্ডগোল বা অন্যান্য বিষয়ে ঝামেলার বদলা , আবার অনেক ক্ষেত্রে স্রেফ কুসংস্কারের বশে অলৌকিক কালা জাদু ইত্যাদিতে বিশ্বাস করার ফল । আমরা আলো ঝলমল শহরের বিলাসী জীবনে সেসব ভাবতেও পারিনে , খবরের কাগজে মাঝেমাঝে দেখি শুধু ।
ডাইনিপ্রথার শিকার মূলত নারীরাই । ডাইনি শব্দটির ব্যঞ্জনা অতীতে আজকের মতো নঞর্থক ছিলোনা । ইংরেজির "Witch" শব্দটি এসেছে গ্রীক শব্দ "Wicca" থেকে , যার অর্থ বুদ্ধিমতী নারী । অতীতে ইওরোপিয়ান সমাজে এই উইক্কারা হেলাফেলা বা অসম্মানের পাত্র তো ছিলেনই না , বরং ছিলেন যথেষ্ট সম্মান ও শ্রদ্ধার পাত্র । এই উইক্কারা ছিলেন মডার্ন পেগানিজম বা আধুনিক মূর্তিউপাসনার প্রবক্তা । সম্ভবত এখান থেকেই পিউরিটান প্রটেস্ট্যান্টদের চক্ষুশূল হন উইক্কারা । তাঁদের ধর্ম অবমাননাকারী , শয়তানের উপাসক তকমা দিয়ে অপরাধী সাব্যস্ত করে পুড়িয়ে বা ফাঁসি দিয়ে হত্যা করা শুরু হয় । উইক্কানরা ছিলেন প্রকৃতিপ্রেমী , তাঁরা প্রকৃতিকে নিজেদের ধর্ম বলতে ভালবাসতেন । Nature religion এর একটি ধারা হিসেবে এঁরা নিজেদের প্রতিষ্ঠা চেয়েছিলেন , যা ছিলো প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের ধারণার সাথে সাংঘর্ষিক । এঁরা নানা ভেষজ ওষুধের গুণ জানতেন । ভিষগ হিসেবে কাজও করতেন , সাফল্যও পেতেন । এইজন্যেই ম্যাজিক্যাল প্র্যাকটিসের ধারণাটি এঁদের নামের সাথে জুড়ে যায় যা পরে এঁদের বিরুদ্ধে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয় । এঁরা সংস্কৃতিমনা ছিলেন , নাচ গান সহ নানা গুণে গুণান্বিত ছিলেন তাঁরা । প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের নিয়মকানুন মেনে চলতে চাইতেননা এবং সমান্তরাল একটি ধর্ম অর্থাৎ natute religion প্রচলনের স্বপক্ষে ছিলেন বলেই গীর্জার রোষের মুখে পড়তে হয়েছিলো উইক্কানদের । এই বিরোধ বা বিদ্রোহের কারণেই Witch বা ডাইনি তকমা পান তাঁরা , যার জের চলে বহুকাল অবধি এবং আজও তা বিলুপ্ত হয়নি । প্রচলিত প্রথা বা অন্যায়ের বিরোধ করলেই বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দেশে ডাইনি আখ্যা দিয়ে হত্যা করা হয়েছে অসংখ্য নারীকে ।
খ্রীস্টিয় সপ্তম শতকের শেষভাগ থেকে ইওরোপে ডাইনিপ্রথা নিষিদ্ধ করা হয় । সারা পৃথিবীর বহু দেশে ডাইনিবিদ্যাজনিত অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কার এক জঘন্য ব্যাধি হিসেবে ছড়িয়ে গিয়েছে এবং এখনও তা বিলুপ্ত হয়নি , এখনও বর্তমান । ডাইনি শিকার প্রথা এতোটাই ব্যাপক রূপে ছড়িয়েছিলো যে এটিকে তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়েছিল - প্রাথমিক যুগ , মধ্যযুগ এবং আধুনিক যুগ । ১৪৮০ সাল থেকে ১৭০০ সালকে মোটামুটি প্রাথমিক যুগ হিসেবে চিহ্নিত করা হয় । ডাইনিবিদ্যা গুপ্তবিদ্যারূপে চর্চিত হয় এই গুজব ছড়িয়ে প্রাথমিকভাবে প্রচুর নারীকে সন্দেহের আওতায় আনা হয়েছিলো । ধর্মীয় মূল্যবোধ ডাইনিবিদ্যার চর্চা সমর্থন করেনা - প্রথমত এখান থেকেই ডাইনিবিদ্যা চর্চা নিষেধ এবং ডাইনিশিকার প্রথা শুরু হয় । প্রাথমিকভাবে গীর্জাগুলো সরাসরি ডাইনি বিচার প্রক্রিয়ায় যেতোনা , যদিও বিচার গীর্জার আদর্শেই হতো । মানুষ প্রধানত কুসংস্কার দ্বারা আচ্ছন্ন ও ভীত হয়ে যুক্তিবোধরহিত হয়ে যায় , ফলে ডাকিনীবিদ্যা গুপ্তবিদ্যা সম্পর্কে আতঙ্ক কাজ করে । এইসব কারণেই ডাইনিশিকার প্রথা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়তে থাকে । আফ্রিকায়ও কালা জাদু ইত্যাদির চল ছিলো যাকে আমরা ভুডু নামে জানি ।
পেডেরবর্ন গীর্জা সপ্তম শতকের শেষভাগে ডাইনিবিদ্যা নিষিদ্ধ করে । ১৩০০ শতকে পোপ দ্বাদশ জন ডাকিনীবিদ্যা দমনমূলক নীতি প্রণয়ন করেন । সেই সময়কার ধর্মভিত্তিক সমাজ মনে করতো মূলত নগ্ননৃত্য , বহুজন একত্রিত হয়ে যৌনতা / group sex , orgy sex , cannibalism বা নরমাংসভোজন ইত্যাদি আচরণের মাধ্যমে শয়তান বা ইভিলের সাহায্যে ডাকিনীবিদ্যার চর্চা করা হতো । দক্ষিণ পশ্চিম জার্মানিতে ডাইনি শিকার ১৫-১৬ শতকে ব্যাপক আকার ধারণ করেছিলো । সমগ্র ইওরোপে প্রায় বারো হাজার ডাইনি বিচারের ঘটনা ঘটেছিলো । এসব বিচার কোনো কোনো ক্ষেত্রে গণ আদালতেও সম্পন্ন হয়েছিলো । ডাইনি সন্দেহে কয়েক হাজার নারীকে পুড়িয়ে মারা হয়েছিলো । অষ্টাদশ শতকে এধরনের ঘটনা ঘটা কমতে থাকে ।
ডাইনিপ্রথা নিয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময়ে আইন পাশ হয়েছে , তার অভিঘাতও হয়েছে ভিন্নমুখী । ইংল্যাণ্ড , স্কটল্যাণ্ড , আয়ারল্যাণ্ড , ওয়েলস প্রভৃতি দেশ ডাইনিবিদ্যা চর্চার জন্য ধারাবাহিকভাবে শাস্তিবিধান করেছে । ১৫৪২ সালে প্রণীত ডাইনিপ্রথা বিরোধী আইনে ডাইনিবিদ্যা চর্চাকে ঘোর অপরাধ বলে উল্লেখ করা হয় । এই আইনে অপরাধ প্রমাণ হলে অস্থাবর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা থেকে মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত দেয়া হতো । ১৫৬৩ সালের ডাইনিপ্রথা বিরোধী আইনে যাবতীয় জাদুটোনা জাতীয় কার্যকলাপসহ ডাইনিপ্রথাকে নিষিদ্ধ আচরণের তালিকায় ফেলা হয় । দুটিই রাণী প্রথম এলিজাবেথের রাজত্বকালে । এই আইনটি তুলনামূলক কম নিষ্ঠুর বলে উল্লেখ করা হয় , এই আইন অনুযায়ী মৃত্যুদণ্ড কেবল তখনই দেয়া হতো, যখন বিচারকরা মনে করতেন ডাইনিবিদ্যার বা ব্ল্যাক ম্যাজিকের প্রয়োগের ফলে কারো কোনও বাস্তবিক ক্ষতিসাধন হয়েছে । ১৬০৪ সালে প্রণীত আইন ডাইনিবিদ্যা চর্চায় অভিযুক্তদের বিচার ব্রিটিশ কমন ল এর আওতায় হওয়া সুনিশ্চিত করলো । এর আগে এধরনের বিচারগুলো হতো গীর্জার পাদ্রীদের তত্ত্বাবধানে । এই আইনে আরো বলা হলো , অভিযুক্তের অপরাধ যদি লঘু হয় এবং "অপরাধ" প্রথমবার হয় , তাহলে তাকে মৃত্যুদণ্ড থেকে অব্যহতি দেয়া হবে । একবছরের কারাবাস দেয়া হবে তাকে । পুড়িয়ে মারার পরিবর্তে সর্বসমক্ষে ফাঁসি দেয়ার প্রথার ওপর জোর দেয়া হয় । ১৬৪৯ সালে প্রণীত আইন অনুযায়ী Witchcraft শব্দটির আওতা প্রশস্ত করা হয় । এই আইন অনুযায়ী পশু এবং মানুষরূপী শয়তানি আত্মাকে বশীভূত করাও ডাইনিবিদ্যার অন্তর্ভুক্ত করা হয় এবং শাস্তির আওতায় আনা হয় । এই নতুন আইনে ঈশ্বর ব্যতীত অন্য কারোর উপাসনা অর্থাৎ শয়তানের উপাসনাকে ধর্ম অবমাননা তথা ব্লাসফেমি বলে অভিহিত করা হয় এবং এধরনের কাজকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে ঘোষণা করা হয় ।
১৭৩৫ সালের ডাইনিপ্রথা বিরোধী আইনটি ছিলো চরিত্রের দিক থেকে পূর্বতন আইনগুলির সম্পূর্ণ বিপরীত । এই আইনে বলা হলো , এখন থেকে যে ব্যক্তি কারোর নামে ডাইনিবিদ্যা চর্চার অভিযোগ করবেন , অর্থাৎ যিনিই দাবি করবেন কোনো ব্যক্তির আত্মা টাত্মা ডেকে আনার বা লোকের ক্ষতি করার ক্ষমতা আছে , ভবিষ্যৎ বলে দেবার অথবা অলৌকিক উপায়ে চুরি যাওয়া জিনিসপত্র খুঁজে দেয়ার ক্ষমতা আছে , সেই ব্যক্তিই অপরাধী হিসেবে গণ্য হবেন , জেল জরিমানার হকদার হবেন । এই আইন প্রযোজ্য হবে সমগ্র গ্রেটব্রিটেন জুড়ে , এতাবৎকালের এসংক্রান্ত সমস্ত অ্যাক্ট বা আইন বাতিল করে । অর্থাৎ ডাইনিবিদ্যা চর্চার অভিযোগে মৃত্যুদণ্ডেরও এখানেই ইতি ঘটলো । সময়টা প্রায় তিনশো বছর আগের , কুসংস্কারকে একটি তুড়িতে কার্যত উড়িয়ে দেয়ার আইন পাশ হলো । একটি অন্ধকার অধ্যায়ের সমাপ্তিতে আইনি সীলমোহর পড়লো । ষোড়শ - সপ্তদশ শতকের ইওরোপে যে ধর্মীয় অস্থিরতার পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিলো , তার ফলেই মূলত ডাইনিবিদ্যা চর্চার "অপরাধে" মৃত্যুদণ্ড দেয়ার আইন পাশ হয়েছিলো বলে মনে করা হয় ।
ডাইনিশিকার পৃথিবীর ইতিহাসে এক কলঙ্কজনক অধ্যায় । মানুষ কীভাবে কুসংস্কারে , অশিক্ষায় , অন্ধবিশ্বাসে আচ্ছন্ন হয়ে থাকতো বা থাকে , তার জ্বলন্ত উদাহরণ ডাইনিশিকারের ঘটনাগুলো । সারা পৃথিবীর মানুষের বিবেকবোধকে সজোরে ধরে নাড়িয়ে দিয়েছিলো যে ঘটনা , তার নাম SALEM WITCH TRIAL ..... যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস প্রদেশে , ডেনভার শহরের অদূরে ছোট একটি গ্রাম সেলেম , ১৬৯২ সালে ডাইনিশিকারের নামে এক বীভৎস হত্যাযজ্ঞের সাক্ষী থেকেছিলো এখানকার মানুষ । সেবছরের গোড়ার দিকে সেলেম গ্রামের দুটি মেয়ে - বারো বছর বয়সী অ্যাবিগেল উইলিয়ামস এবং তার খুড়তুতো বোন বেটি প্যারিস , দুজন অস্বাভাবিক আচরণ করতে শুরু করে । মৃগী রোগীর মতো আচরণ করতে থাকে তারা , কারণ ছাড়াই একা একা কথা বলা , হাত দুপাশে ছড়িয়ে ওড়ার চেষ্টা করা , ফায়ারপ্লেসের ভেতর ঢুকতে চেষ্টা করা , রান্নাঘরের চিমনি বেয়ে ওপরে ওঠার চেষ্টা , অকারণে চীৎকার চেঁচামেচি কান্নাকাটি করা , মেঝেতে গড়াগড়ি দেয়া ইত্যাদি । এর কিছুদিন পরই ওই একইরকম অস্বাভাবিক আচরণ করতে থাকে আরো ছয়টি মেয়ে । এই ঘটনার কথা ছড়িয়ে পড়ার পর গ্রামবাসীরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েন । বেটির বাবা শরণাপন্ন হন গ্রাম্য ডাক্তারের । "ডাক্তার" দেখেশুনে রায় দেন যে এদের ওপর কোনো অদৃশ্য শয়তানী শক্তি ভর করেছে ।
ষোড়শ শতকের শেষদিকের এই সময়টাতে সেলেম ছিলো ব্রিটিশ উপনিবেশের অংশ । এই অঞ্চলে প্রোটেস্ট্যান্টদের সংখ্যা ছিলো বেশি । এই প্রটেস্ট্যান্টরা ছিলো অতিমাত্রায় পিউরিটান । এরা মূলত প্রাচীনপন্থী ও হতাশাবাদী । এদের দৃঢ় বিশ্বাস ছিলো , পাপের ফলেই মানুষের জন্ম হয় । অতএব ঈশ্বরের পাশাপাশি মানুষের ভেতরে শয়তানের অবস্থান এদের মতে অনিবার্য । তাই এরা সহজেই ডাক্তারের কথায় সায় দেন । ফলে বিপুল অংকের মানুষের সমর্থন পায় কথিত ওই ডাক্তারের সিদ্ধান্ত । এরপর ডেকে আনা হয় গ্রামের গুণিনকে । তার কাছে ওই মেয়েরা সবাই জানায় , গ্রামের কয়েকজন বৃদ্ধা হলেন ডাইনি আর তাদের তুকতাকের ফলেই মেয়েগুলোর এই অবস্থা । দুই বোন অ্যাবিগেল আর বেটি সরাসরি গ্রামের তিনজন বৃদ্ধাকে ডাইনি বলে আঙুল তোলে , লক্ষ্যণীয় , এরা সবাই ছিলেন সমাজের নীচুতলার , অপেক্ষাকৃত দুর্বল শ্রেণীর নারী । টিটুবা নামের বৃদ্ধাটি ছিলেন ক্রীতদাস , সারাহ্ গুড ছিলেন গৃহহীন ভিখারি এবং সারাহ্ অসবোর্ন - যার সাথে গ্রামের কয়েকজনের সম্পত্তি নিয়ে গোলমাল লেগেই ছিলো , এছাড়াও তাঁর বিবাহিত ও ব্যক্তিগত জীবন নিয়েও ছিলো নানা ধরনের কেচ্ছা । তো গ্রামবাসীরা সহজেই মেনে নিলেন এই আরোপ । অতএব সাক্ষ্যের ভিত্তিতে ধরে আনা হলো তিন নারীকে । শুরু হলো বিচারের তোড়জোড় ।
ম্যাজিস্ট্রেট জোনাথন করউইন এবং জন হ্যাথর্নের বিচারালয়ে তিন অভিযুক্তই প্রথমে তাঁদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অস্বীকার করলেন । কিন্তু পরে টিটুবা তাঁর জবানবন্দী পরিবর্তন করেন এবং বলেন যে দুজন পুরুষ শয়তানের দ্বারা তিনি প্রভাবিত , তাদের কথাতেই কিশোরীদের ওপর জাদুটোনা করেছেন । তিনি গ্রামের আরো কিছু মানুষের নাম বলেন , যারা নাকি শয়তানের অনুচর এবং তার সহ-অপরাধী । এই স্বীকারোক্তির পর সেলেমের পরিবেশ পরিস্থিতি ভয়াবহ অশান্ত রূপ ধারণ করলো । সবাই সবাইকে সন্দেহের চোখে দেখতে লাগলো । এরপর যখন মার্থা ক্যুরি নামে গীর্জার এক নানকে ডাইনি অভিযোগে গ্রেফতার করা হলো , সেলেমের পরিবেশে অস্থিরতা দ্বিগুণ বেড়ে গেলো । শয়তানের কথিত অনুচর বলে যাদের চিহ্নিত করা হয়েছিলো তাদের সবাইকেই ধরে এনে কারারুদ্ধ করা হলো । সব মিলিয়ে প্রায় ২০০ জন নারীকে ধরে আনা হয় ডাইনি সন্দেহে ,এর মধ্যে সারাহ্ অসবোর্নের চার বছরের শিশুকন্যাও ছিলো । অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছিলো যে মানুষ বেড়াল কুকুর দেখলেও ছদ্মবেশি ডাইনি ভাবতে শুরু করেছিলো । সন্ধ্যের পর ডাইনির ভয়ে ঘরের বাইরে বেরোনো কার্যত বন্ধ করে দিয়েছিলো তারা । এক তীব্র আতঙ্ক গ্রাস করেছিলো সমগ্র সেলেমকে ।
মোট ৩৪ জনকে ডাইনি হিসেবে অভিযুক্ত করা হয় । অধিকাংশই ছিলেন নারী । জুলাই , অগাস্ট , সেপ্টেম্বর - এই তিন মাসে ধাপে ধাপে ১৮ জনকে ফাঁসি দেয়া হয় । ইতোমধ্যেই সাতজন বন্দীর মৃত্যু ঘটে । মূল সাক্ষী টিটুবাকে ছেড়ে দেয়া হয় , শর্ত এটাই ছিলো । স্বীকার করলে মুক্তি , অস্বীকার করলে সর্বসমক্ষে ফাঁসি । দুটি কুকুরকেও হত্যা করা হয় ডাইনিবিদ্যা চর্চায় সহযোগিতার অভিযোগে । এই ঘটনার পর সেলেম ক্রমে জনবিরল হতে শুরু করে । অনেকেই অন্যত্র চলে যান । এরপর বেশি সময় লাগেনি প্রশাসনিক কর্তাদের বোধোদয় হতে । গভর্ণর উইলিয়াম ফিলিপ প্রকাশ্যে ক্ষমা চান । শুধুমাত্র ভিত্তিহীন অন্ধবিশ্বাসে ভর করে এতোগুলো মানুষের অহেতুক প্রাণদণ্ড মানুষের সভ্যতার ওপর এক চরম কুঠারাঘাত হয়ে রইলো । পরবর্তীতে অনুসন্ধানের ফলে দেখা গেলো , রাই জাতীয় শস্যের মধ্যে জন্মানো "Ergot" নামে একধরণের ফাঙ্গাস ওই মেয়েদের অমন অস্বাভাবিক আচরণের জন্য দায়ী । গবেষণায় দেখা যায় যে এই ফাঙ্গাস আক্রান্ত শস্য খেলে মানুষের ওপর তার প্রভাব হয় ড্রাগের মতো , যার ফলে মানুষ অস্বাভাবিক আচরণ করতে থাকে , যেটাকে গ্রামবাসীরা ডাইনির তুকতাক বলে বিশ্বাস করেছিলেন । টিটুবা যেহেতু ক্রীতদাস ছিলেন , তাঁর ওপর হওয়া অত্যাচারের প্রতিশোধ নিতেই তিনি অত্যাচারীদের তার সহচর বা শয়তানের অনুচর বলে দাগিয়ে দেন , যার পরিণতি হয় মারাত্মক । ডাইনি অপবাদে বহু জীবন চলে যায়। ম্যাসাচুসেটসের প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ ক্ষমা প্রার্থনা করে নিহতদের নাম আদালতকক্ষে এনগ্রেভ করানোর নির্দেশ দেন এবং প্রত্যেকের পরিবারকে ৬০০ ইউরো করে ক্ষতিপূরণ দেবার নির্দেশ দেন । সেলেম উইচ ট্রায়ালের সাক্ষী হিসেবে আজও রয়ে গিয়েছে কথিত সেই ডাইনিদের বাড়িটি । এখনও মানুষ সেখানে যান বাড়িটি দেখতে । সেখানে একটি জাদুঘর হয়েছে । যেখানে বিচার হয়েছিলো সেটি হয়েছে উইচ ট্রায়াল মেমোরিয়াল পার্ক । অন্ধবিশ্বাস আর অহেতুক আতঙ্কের ফল কতো মারাত্মক হতে পারে , তার জ্বাজ্বল্যমান নিদর্শন হয়ে আছে সেলেম ।
ভারতীয় সংস্কৃতিতে ডাইনি শব্দটির উৎপত্তি ডাকিনী থেকে । মহাদেবের বিভিন্ন অনুচরদের মধ্যে ডাক অন্যতম , এই ডাকের স্ত্রীলিঙ্গবাচক শব্দই ডাকিনী , ডাকিনীর অপভ্রংশ ডাইনি । কথিত আছে ডাক একধরণের পিশাচ । তন্ত্রবিদ্যার সাথে ডাকিনীবিদ্যার সম্পর্ক অঙ্গাঙ্গী । ভারতীয় উপমহাদেশের কুসংস্কারাচ্ছন্ন বাতাবরণে তুকতাক , বাণমারা, বশীকরণ ইত্যাদি অন্ধবিশ্বাসের রমরমার কারণে ডাইনিবিদ্যা বিপুল অংকের মানুষের কাছে বেশ নির্ভরযোগ্য ।
মূলত আদিবাসী অধ্যুষিত সমাজ , যেখানে এখনও শিক্ষার আলো , বিজ্ঞান চেতনার আলো পৌঁছয়নি , সেইসব অঞ্চলগুলোতেই ডাইনিপ্রথা এবং ডাইনিশিকার এখনও চলে আসছে । National Crime Bureau এর রেকর্ড অনুযায়ী , ২০০০ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে এদেশে আড়াই হাজারের বেশি মানুষকে ডাইনি অপবাদ দিয়ে হত্যা করা হয়েছে যার অধিকাংশই নারী , বলাবাহুল্য । তবে বাস্তব সংখ্যাটা আরো বেশি কারণ এসব হত্যাকাণ্ডের বেশিরভাগেরই অভিযোগ নথিভুক্ত করা হয়নি । আমাদের দেশে আজও ডাইনিশিকারের বিরুদ্ধে কোনো সুনির্দিষ্ট আইন নেই । তাছাড়া সাধারণত এসব হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয় দলবদ্ধভাবে , তাই সুনির্দিষ্ট অভিযোগের জন্য প্রমাণ জোটানোও কঠিন হয়ে পড়ে । আর এসবের সুযোগ নিয়ে সমাজের একশ্রেণীর লোক অত্যাচার করে চলে অপেক্ষাকৃত দুর্বল শ্রেণীর মানুষ, বিশেষত নারীর ওপর ।
ডাইনি অপবাদ দেয়া বা হত্যা করার জন্য অনেকক্ষেত্রে ঘটনা ঘটানো হয় সুপরিকল্পিত ভাবে । সাধারণত সহায় সম্বলহীন দরিদ্র যুবতী বা বৃদ্ধারা এর শিকার হন । অর্থনীতিবীদদের মতে , মহামারী বা আর্থ সামাজিক অস্থিতাবস্থার সাথেও এর সম্পর্ক রয়েছে । খ্রীষ্টপূর্ব ৩৩১ -এ রোমে মহামারী দেখা দেওয়ায় মহামারীর কারণ হিসেবে চিহ্নিত করে ১৭০ জন নারীকে ডাইনি অপবাদ দিয়ে হত্যা করা হয় । ভারতেও অনুরূপ ঘটনা ঘটানো হয় যা নিষ্ঠুরতায় ইওরোপকে পেছনে ফেলে দেয় । বিহার , রাজস্থান , ঝাড়খণ্ড , আসাম , ছত্রিশগড় , উত্তর প্রদেশ , মধ্যপ্রদেশ , অন্ধ্রপ্রদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গের নাম এক্ষেত্রে উল্লেখ করা যায় ।
ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী , ২০১৬- ১৭ সালে উড়িষ্যায় ৯৯ টি এবং রাজস্থানে ১২৭ টি ডাইনি হত্যার অভিযোগ নথিবদ্ধ হয়েছে । ২০২০ সালে উড়িষ্যায় এক গুণিনের নিদানে এক মহিলাকে ডাইনি অপবাদে ত্রিশূল দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করা হয়। ছত্তিশগড়ে ২০০১ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে ডাইনি অপবাদ দিয়ে বিচার হয় ১৫০০ জনের , হত্যা করা হয় ২১০ জনকে । ২০২০ সালেও ছত্তিশগড়ে ২২ জনকে ডাইনি অপবাদ দিয়ে হত্যা করা হয় । ২০০২ সালে আসামে ডাইনি অপবাদে হত্যা করা হয় ১৩০ জনকে ,যার অধিকাংশই নারী । ২০১৯ সালে আসামে চারজন নাবালককে ডাইনি অপবাদ দিয়ে বলি দেবার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো , পুলিশ শেষমুহূর্তের তৎপরতায় তাদের উদ্ধার করে । ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলে ২০১০ সালে ২৫০ জনের মতো নারীকে ডাইনি অপবাদে হত্যা করা হয় । ২০১২- ১৩ সালে ২৭০ জন নারীকে ডাইনি অপবাদ দিয়ে লাঠিপেটা করে , চাবুক মেরে , পাথর ছুঁড়ে হত্যা করা হয় । ঝাড়খণ্ডে ডাইনি অপবাদ দিয়ে হত্যা এবং নির্যাতনের ঘটনা সবচেয়ে বেশি । ২০১৫ সালে ৩২ জন মহিলাকে ডাইনি অপবাদ দিয়ে খুন করা হয়েছে । ২০০১ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে মোট ৫৭৫ জন নারীকে ডাইনি অপবাদ দিয়ে নির্যাতন করা হয়েছে , মারধর করা হয়েছে । ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসেও ঝাড়খণ্ডে এক ৬৫ বছরের বৃদ্ধাকে ডাইনি অপবাদ দিয়ে পিটিয়ে মারা হয়েছে । বলাবাহুল্য সব অত্যাচারের ঘটনা অভিযোগ আকারে লিপিবদ্ধ হয়না, বাস্তব সংখ্যাটা তাই স্বাভাবিকভাবেই অনেক বেশি ।
ডাইনিপ্রথা নামক কুসংস্কারের প্রধান শিকার নারীরা , আবার নারীরাও ডাইনি সন্দেহে নারীর হেনস্থায় জড়িয়ে থাকার মতো ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটেছে । ২০১৪ সালে আসামে ৬৩ বছরের বৃদ্ধা পনি ওরাংকে ডাইনি অপবাদ দিয়ে খুন করা হয় । গ্রামের কিছু লোক অসুস্থ হয়ে পড়লে গ্রামের ওঝা নিদান দেন যে পনি ওরাং ডাইনি এবং তাঁর কুদৃষ্টিতেই লোকজন অসুস্থ হয়ে পড়ছেন । এরপর এক মধ্যরাত্রে গ্রামের প্রায় শদেড়েক লোক মিলে পনি ওরাংয়ের বাড়িতে চড়াও হয়ে তাঁকে মারধর করে , এরপর ধারালো অস্ত্র দিয়ে গলা কেটে পনিকে খুন করা হয় । এই হত্যাকাণ্ডের অভিযোগে মোট ১৬ জনকে গ্রেফতার করা হয় ,যার মধ্যে নজন ছিলেন নারী ।
২০১৪ সালে এক নভেম্বরের দুপুরে দলবদ্ধ আক্রমণ হয় রাজস্থানের বাসিন্দা মধ্য চল্লিশের কেশী চন্দনার ওপর । আক্রমণকারীদের দলের মধ্যে ছিলেন চন্দনার কিছু আত্মীয়ও । চীৎকার করে তারা চন্দনাকে ডাইনি বলে ডাকতে থাকে । ঘিরে ধরে মারতে মারতে নগ্ন করা হয় তাঁকে । এরপর জুতোর মালা পরিয়ে , গাধার পিঠে বসিয়ে মাথায় ভারি পাথর চাপিয়ে পুরো গ্রাম ঘোরানো হয় । এরপর সর্বসমক্ষে পুড়িয়ে মারার আগমুহূর্তে পুলিশ খবর পেয়ে চলে আসে এবং উদ্ধার করে চন্দনাকে । কেন চন্দনার ওপর ওভাবে আক্রমণ করা হলো , তার কোনো উত্তর অবশ্য পাওয়া যায়নি গ্রামবাসীদের কাছে ।
২০১৫ সালের আগস্ট মাসে ঝাড়খণ্ডের এক আদিবাসী গ্রামে একটি ছেলে জণ্ডিসে মারা যায় । গ্রামের ওঝা ওই গ্রামের পাঁচজন নারীকে ডাইনি বলে দাগিয়ে দেন , বলেন ছেলেটিকে ওই পাঁচজনই খেয়েছে । এরপর গ্রামের লোক ক্ষিপ্ত হয়ে ওই পাঁচজনকে তাদের ঘরে ঢুকে চুলের মুঠি ধরে ধরে বাইরে বের করে এনে নগ্ন করে লাঠি দিয়ে পিটিয়ে ও টাঙ্গি দিয়ে কুপিয়ে খুন করে ।
প্রত্যন্ত গ্রামগুলিতে যেকোনো সমস্যা হলেই নারীদের দায়ী করা হয় - দুর্ভিক্ষ বন্যা খরাই হোক বা ভূমিকম্প অথবা কুয়োয় জল শুকিয়ে যাওয়া , সবকিছুর সহজ সমাধান মেয়েদের ডাইনি বলে দাগিয়ে দেয়া । কেউ অসুস্থ হলে , দীর্ঘদিন দুরারোগ্য ব্যাধিতে ভুগলে , মারা গেলে , কারো দীর্ঘদিন সন্তান না হলে , কারো গর্ভস্থ ভ্রূণ নষ্ট হয়ে গেলে , দুর্ঘটনায় জখম হলে , এমনকী একটা গাছও যদি শুকিয়ে মারা যায় , ক্ষেতের ফসল নষ্ট হয় , পশুপাখি মারা যায় , তার পেছনেও কোনো নারীকে দায়ী করে ডাইনি অপবাদ দিয়ে দেবার ঘটনা ঘটে । জনজাতিপ্রধান প্রত্যন্ত গ্রামগুলোতে আইন আদালতের হাত প্রায় পৌঁছয়না বললেই চলে । এসব জায়গায় সালিসি সভা বসিয়ে অথবা গ্রাম্য ওঝা , গুণিন , বৈদ্য বা জানগুরু দ্বারা নিদান হেঁকে মেয়েদের ডাইনি বলে চিহ্নিত করা হয় । চলে অকথ্য অত্যাচার , শোষণ , এমনকী হত্যা । দলবদ্ধভাবে পিটিয়ে , ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে , শিরশ্ছেদ করে , ফাঁসিতে ঝুলিয়ে , জীবন্ত পুড়িয়ে হত্যা করার প্রচুর উদাহরণ রয়েছে । এছাড়াও রয়েছে জরিমানা করা । টাকাপয়সা , ক্ষেতের ফসল , জমিজায়গা বা অন্যান্য সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা । এসবও ইওরোপীয় ডাইনিশিকারের আদলেই চলে আসছে । রয়েছে ভিক্টিমকে গণধর্ষণেরও নিদান দেয়ার উদাহরণ । রয়েছে নগ্ন করে গ্রাম ঘোরানোর উদাহরণ । রয়েছে সামাজিকভাবে বয়কট বা একঘরে করে দেয়ার উদাহরণ । এমন সব আচরণ এদের সাথে করা হয় তা জানলে বিস্মিত হওয়াও ভুলে যেতে হয় । বাংলায় ভূত ছাড়ানোর কুসংস্কারের মতোই এদের ঝাঁটাপেটা জুতোপেটা করা , বাঁশ বা লাঠি দিয়ে পেটানো , বিভিন্ন ধারালো অস্ত্র দিয়ে কোপানো , জুতোর মালা পরানো , নাকখত দেয়ানো , চুল কেটে মুখে কালি মাখিয়ে দেয়া, নাকেমুখে শুকনোলংকা পুড়িয়ে ধোঁয়া দেয়া , বলপূর্বক মানুষের ও শূকরের বিষ্ঠাসহ নানা অখাদ্য কুখাদ্য খাওয়ানো ইত্যাদি অমানুষিক ব্যবহার করা হয় । এই জরিমানার টাকা দিতে না পারলে ভিটেমাটি কেড়ে নেয়া থেকে শুরু করে গ্রাম থেকে সমূলে উচ্ছেদ করে তাড়িয়ে দেয়ার উদাহরণ প্রচুর । এইজাতীয় জরিমানার টাকা থেকেই গ্রামের মাতব্বরদের একটা বিশাল অংকের টাকা আয় হয় বলে জানা যায় । এই টাকায় গ্রামের মাতব্বররা অনেকক্ষেত্রে ভোজও খেয়ে থাকেন ।
ডাইনিপ্রথা অনেকক্ষেত্রেই গ্রামীণ নারী নির্যাতনের একটি কার্যকর হাতিয়ার । পারিবারিক বা ব্যক্তিগত হিংসের বলিও হতে হতো অনেক নারীকে ,ডাইনি অপবাদ মাথায় নিয়ে , এগুলো বহু প্রাচীনকাল থেকে ভারতীয় সংস্কৃতিতে বিদ্যমান ছিলো । কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম চক্রবর্ত্তীর চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে ধনপতি সদাগরের প্রথম স্ত্রী লহনা তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী খুল্লনা সম্পর্কে স্বামীকে বলছেন , " তোমার মোহিনীবালা , শিখয়ে ডাইনিকলা , নিত্য পূজে ডাকিনীদেবতা" । অর্থাৎ অপছন্দের নারীটিকে ডাইনি বলে দাগিয়ে দেয়ার প্রচলন অনায়াস ছিলো । ডাইনিপ্রথার মতো কুসংস্কারে বিশ্বাসীরা মনে করেন , অপদেবতা শয়তান ভূতপ্রেতের আরাধনা করে তাদের বশে এনে মানুষ অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী হতে পারেন এবং ওই ক্ষমতার বলে লোকের উপকার অপকার দুইই করতে পারেন । মানুষের নিজস্ব সত্ত্বা গ্রাস করে তাকে বশ করা বা তার চেতনাকে গ্রাস করে নিতে পারেন । এই বিশ্বাস থেকে শত্রুপক্ষের ক্ষতি করতে ডান বা তথাকথিত অলৌকিক ক্ষমতাধরদের লেলিয়ে দেয়া বা নিয়োগ করার মতো ঘটনাও প্রচুর পরিমাণে ঘটে থাকে । এমনও ঘটে , কোনো নারীকে ডাইনি বলে চিহ্নিত করার পরিকল্পনা করলে তাকে মাদকজাতীয় কিছু বা বিষাক্ত শেকড়বাকড় জোর করে খাইয়ে তাকে অসুস্থ ও তন্দ্রাচ্ছন্ন করে ফেলা হয় , তার বাহ্যজ্ঞান লুপ্তপ্রায় হয়ে যায় , তখন তাকে দিয়ে ইচ্ছেমতো অসংলগ্ন কথাবার্তা বলিয়ে নেয়া হয় যাতে তাকে ডাইনি বলে চিহ্নিত করার পথ নিষ্কন্টক হয় ।
এর পেছনে কারণ হিসেবে বিভিন্ন বিষয় থাকে । কখনো ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা চরিতার্থ করা , পারিবারিক হিংসা , প্রেমপ্রস্তাব বা যৌনপ্রস্তাব দিয়ে ব্যর্থ হওয়া , সম্পত্তি দখল করবার চাল । যদি কোনো নারীর মানসিক স্বাস্থ্য বিঘ্নিত হয়, অথবা কোনোরকম hormonal imbalance এর ফলে সে কোনো অস্বাভাবিক আচরণ করে , সেক্ষেত্রেও তাকে ডাইনি আখ্যা দিয়ে দাগিয়ে দেয়া হয় । এছাড়াও দেখা যায় তথাকথিত নীচুজাত বা সম্প্রদায়ের মানুষকে তাঁবে রাখতে উচ্চবর্ণের লোকেরা এই অস্ত্রটি ব্যবহার করেন । অর্থনৈতিক ভাবে যারা নীচুতলায় বিরাজ করেন তাঁদের ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে । এমনকী ভিন্ন রাজনৈতিক মতের অপেক্ষাকৃত দুর্বল প্রতিপক্ষকে ঘায়ের করার অস্ত্র হিসেবেও তাকে ডাইনি বলে দাগিয়ে দেয়া হয় । এছাড়া সমাজের প্রচলিত রীতিনীতি , নিয়মকানুন যদি কোনো মেয়ে মানতে না চায় বা প্রতিবাদ করে , বিদ্রোহ করে , শক্তিমানদের অসুবিধে বা স্বার্থহানির কারণ হয়ে দাঁড়ায় , তাকে দাগিয়ে দেয়া হয় ডাইনি বলে । চাবুক মেরে , ফাঁসি দিয়ে বা পুড়িয়ে মেরে সমাজের অন্যান্য অবাধ্য মেয়েদের সামনে দৃষ্টান্ত স্থাপন করা হয় ।
প্রসঙ্গত ফ্রান্সের অগ্নিকন্যা জোয়ান বা জোন অফ আর্কের সাথে ঠিক এই ঘটনাই ঘটেছিলো । জোন ফরাসী সেনাবাহিনীকে নেতৃত্ব দিয়ে ইংরেজ সেনাবাহিনীকে পর্যুদস্ত করে একের পর এক জয় এনে দেন দেশকে , দেশের স্বাধীনতার কারিগর হয়ে ওঠেন । ইংরেজরা এরপর ছলাকলার আশ্রয় নিয়ে জোনকে আটক করেন । জোনের সাজানো বিচারসভা বসে , বিচারক ইংরেজ চার্চের পাদ্রী । সেই বিচার নামক প্রহসনে জোনের আচরণকে ধর্মমত বিরোধী আখ্যা দিয়ে তাঁকে ডাইনি সাব্যস্ত করে তারপর জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয় । সালটা ছিলো ১৪৩১ , এইসময়ে ইওরোপ জুড়ে ডাইনি অপবাদ দিয়ে একের পর এক নারীহত্যা চলছিলো ।
ঝাড়খণ্ডের ছুটনি মাহাতো এবং আসামের বীরুবালা রাভার নাম ভারতের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে । এঁরা দুজনেই একসময়ে ডাইনি অপবাদের শিকার হয়েছিলেন । এই জঘন্য প্রথার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে মোট ৩২৫ জন ডাইনি অপবাদে নির্যাতিতকে বাঁচিয়ে উদ্ধার করেছেন দুজন । ছুটনি ১২৫ জন এবং বীরুবালা ২০০ জনকে । ২০২১ সালে দুজনেই ভূষিত হয়েছেন ভারত সরকারের পদ্মশ্রী সম্মানে ।
ঝাড়খণ্ডের ভূমিকন্যা ছুটনি গণধর্ষণের শিকার হতে হতে বেঁচেছেন , নির্মমভাবে নিহত হতে হতে বেঁচেছেন , এই জঘন্য প্রথার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে প্রাণ বাঁচিয়েছেন ১২৫ জনকে যাদের জুটেছিলো তাঁর মতোই ডাইনি অপবাদ । আজ ৬২ বছরের ছুটনি দায়িত্ব নিয়েছেন রোজ ১৫ - ২০ জন নারীর ভরণপোষণের , যারা ডাইনি অপবাদে সমাজ সংসার দ্বারা পরিত্যক্ত । ঝাড়খণ্ডের সরাইকেল্লার এক গ্রামের ভূমিকন্যা ছুটনি , ১৯৭৮ সালে তৃতীয় শ্রেণীতে পড়াকালীনই বিয়ে হয়ে যায় তাঁর । ১৯৯৫ সালে প্রতিবেশি একটি মেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়লে ছুটনিকে কালা জাদু এবং মন্ত্রতন্ত্র চর্চার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয় গ্রামবাসীদের পক্ষ থেকে । বাড়িতে চড়াও হয়ে মারধর করা হয় ছুটনিকে , পঞ্চায়েতের তরফে হাঁকা হয় জরিমানা , গণধর্ষণের চেষ্টা করা হয় । এর কিছুদিন পর ছুটনিকে তুলে নিয়ে গিয়ে পিটিয়ে মারার চেষ্টাও করা হয় । কোনোমতে নিজেকে বাঁচিয়ে সেখান থেকে পালিয়ে যান ছুটনি । স্থানীয় বিধায়কের কাছে সাহায্য চেয়েও মেলেনি সাড়া । পুলিশের কাছে অভিযোগ জানাতে গেলে দশহাজার টাকা ঘুষ দাবি করা হয় । এ অবস্থায় ছুটনিকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন সরাইকেল্লার এসডিও নিধি খারে । জামশেদপুরের একটি এনজিওর আইনি সেলে সহায়তার জন্য পাঠানো হয় ছুটনিকে । এরপর ডাইনি প্রথার বিরুদ্ধে সচেতনতার লড়াইয়ে সরাসরি শামিল হলেন ছুটনি । গড়ে তোলেন ডাইনিপ্রথা বিরোধী সচেতনতা কেন্দ্র । ডাইনির ধারণাটি যে একটি কুসংস্কার মাত্র , বাস্তবে এর কোনো অস্তিত্ব নেই , এই বার্তা প্রচার করাকেই লড়াইয়ের হাতিয়ার করে তোলেন ছুটনি মাহাতো । তাঁর সংগ্রাম নিয়ে ১৯৯৬ সালে একটি তথ্যচিত্র তৈরি হয় । তাঁর জীবনকাহিনীর ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছে দুটি চলচ্চিত্র - "অউর কব তক" এবং "কালা সচ্ - The Black Truth".
আসামের ৭২ বছর বয়সী বীরুবালা রাভার কাহিনীও অনেকটা এরকমই । আসাম মেঘালয় সীমান্তবর্তী এক গ্রামের মেয়ে বীরুবালার বিয়ে হয় পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ার সময়েই । একের পর এক প্রতিবেশির মৃত্যুর জন্য বীরুবালাকে ডাইনি সাব্যস্ত করে গ্রামবাসী । পঞ্চায়েত চাপায় মোটা জরিমানা । এখানেই শেষ নয় , একঘরে করা হয় বীরুবালাকে । বহু অত্যাচার সহ্য করেও ভেঙে পড়েননি বীরুবালা , জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নিজের চেষ্টায় একটি ডাইনিপ্রথা বিরোধী মিশন গঠন করেছেন , কুসংস্কারের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলেছেন , ডাইনি অপবাদে আক্রান্তদের পাশে দাঁড়িয়েছেন , তাঁদের উদ্ধার করেছেন । সাথে রয়েছেন সহযোগীরা । এক দশক আগেও যেখানে আসামে গড়ে প্রতি বছর ১০-১৫ জনকে হত্যা করা হতো ডাইনি অপবাদ দিয়ে , সেই সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে বীরুবালার এই মিশনের কারণে । বর্তমানে ৬০০ সদস্য কাজ করছেন এই মিশনে , এঁদের সাহায্যে ২০০ মানুষকে বাঁচিয়েছেন বীরুবালা ,যাঁরা তাঁর মতোই ডাইনি অপবাদের শিকার হয়েছিলেন ।
অত্যাচারিত হয়েও , ডাইনি অপবাদের শিকার হয়েও যেভাবে ঘুরে দাঁড়িয়ে কুসংস্কারের বিরুদ্ধে কাজ করে পদ্মশ্রী সম্মান ছিনিয়ে নিয়েছেন এই দুই সাহসিকা , তাতে তাঁদের জীবন এক উদাহরণ হয়ে থাকবে ।
এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে , ঝাড়খণ্ডের উপজাতি তরুণীর চোখের সামনে তাঁর শৈশবে তাঁর ঠাকুমাকে ডাইনি অপবাদ দেয়া হয় । ক্ষিপ্ত উন্মত্ত গ্রামবাসী , যার মধ্যে তাঁর আত্মীয়রাও ছিলেন , ওই নারীকে ঘর থেকে টেনে বের করে নগ্ন করে জোর করে বিষ্ঠা খাওয়ায় । এরপর তাঁকে পিটিয়ে খুন করা হয় পরিবারের লোকজনের সামনেই । বয়স বাড়ার সাথে সাথে শৈশবের সেই ঘটনার অভিঘাত সেই ট্রমা কাটিয়ে উঠে তরুণী উপলব্ধি করেন , এই কুসংস্কারের বিরুদ্ধে লড়তে হবে , এটাই একমাত্র পথ । আত্মবিশ্বাসী তরুণী এখন ঝাড়খণ্ডের প্রত্যন্ত গ্রামগুলিতে গিয়ে কুসংস্কার বিরোধী প্রচার চালাচ্ছেন । একশ্রেণীর অসাধু ব্যক্তি যে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্যেই এই ডাইনিপ্রথা নামক অন্ধবিশ্বাসে ইন্ধন জোগাচ্ছে এই কথা প্রচার করে সচেতনতা অভিযানে শামিল হচ্ছেন । সহায় সম্পত্তি হাতানো , যৌনশোষণ ইত্যাদি ডাইনি অপবাদ দেয়ার পেছনের কারণগুলোও জনমানসে তুলে ধরছেন । আসামের ডাইনিশিকারে দোষী প্রমাণিত ব্যক্তিদের শাস্তির দাবিতেও সরব হয়েছেন তরুণী , শামিল হয়েছেন আন্দোলনে । ছুটনি বীরুবালাদের ব্যাটন হাতে , আলোর মশাল হাতে ছুটে চলেছেন এই তরুণীরাও । এই আলোর মালা ভারতবর্ষের আত্মার গভীর থেকে অন্ধবিশ্বাসের অন্ধকারের শেকড় উপড়ে ফেলবেই , এই প্রত্যয়েই নতুন দিনের ভারতবর্ষ প্রত্যয়ী ।
ডাইনিপ্রথা একটি সভ্য দেশ ও জাতির অগ্রগতির পথে অন্তরায় । এই একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়েও আমাদের দেশে এই জঘন্য কুসংস্কারের চর্চা হয় ,ডাইনি অপবাদে মানুষ নির্যাতনের শিকার হন , তাঁদের হত্যা করা হয় , একথা আমাদের পক্ষে অত্যন্ত লজ্জাজনক । অর্থনৈতিক অগ্রগতির সুফল ভালোভাবে পৌঁছয়নি দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে , পৌঁছয়নি শিক্ষার আলো , বিজ্ঞানচেতনার আশীর্বাদ । পিতৃতন্ত্রের কূটচাল , লিঙ্গবৈষম্য , পশ্চাদপসারী ধ্যানধারণার সাথে যুক্ত হয়েছে দারিদ্র্য , সামাজিক সচেতনতার অভাব , পুলিশ প্রশাসন ও সরকারের উপেক্ষা নির্লিপ্তি নিষ্ক্রিয়তা । অনেক অঞ্চলেই আইনের শাসন বলে কিছু নেই , ন্যূনতম শিক্ষা পরিকাঠামো নেই , গুণিন জানগুরু শেকড় বাকড় ছাড়া ন্যূনতম চিকিৎসা পরিকাঠামো নেই । সব মিলিয়ে এমন এক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে যা আমরা শহরের পরিবেশে বসে চিন্তাও করতে পারিনা ।
সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী , আইন বিশেষজ্ঞ ইন্দিরা জয়সিংহ ডয়েচে ভেলেকে প্রদত্ত এক সাক্ষাৎকার প্রসঙ্গে বলেন , ভারতে এখনো ডাইনিশিকারের মতো ঘটনা ঘটে চলেছে , এর কারণ অজ্ঞতা , কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানসিকতা , অশিক্ষা দারিদ্র্য ইত্যাদির পাশাপাশি , ডাইনিশিকারের বিরুদ্ধে ভারতে সুনির্দিষ্ট কোনো কেন্দ্রীয় আইন নেই । একেক রাজ্যের আইন একেক রকম , সব রাজ্যে ডাইনিশিকারের বিরুদ্ধে আইন নেইও । এসব কারণে একশ্রেণীর সুযোগসন্ধানী লোক এখনও ডাইনিশিকারের মতো জঘন্য কাজ করে বা ইন্ধন জুগিয়ে পার পেয়ে যাচ্ছে । যদিও ভারতীয় সংবিধানের 51A(h) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী বিজ্ঞানচেতনার প্রচার ও প্রসার ঘটানো এবং সেইসাথে কুসংস্কার ছড়ানো ও চর্চার বিরোধ করা নাগরিকদের অবশ্যকর্তব্য , তবু এটা যথেষ্ট নয় । ডাইনিশিকার রুখতে কঠোর কেন্দ্রীয় আইন একান্ত প্রয়োজন এইমুহূর্তে ।
ডাইনিশিকারের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি রাজ্যে আইন রয়েছে । সবচেয়ে কঠোর আইন রয়েছে আসামে । ২০০৮ সাল থেকে আসামে ডাইনিশিকার সংক্রান্ত অনেক মামলার কোনো সুরাহাই হয়নি । দীর্ঘ সাতবছর সলতে পাকানোর পর ২০১৫ সালে আসাম সরকার ডাইনিপ্রথা বিরোধী বিল পাশ করেন । এই আইন অনুযায়ী কারোকে ডাইনি বলে অপবাদ দেয়া আইনবিরুদ্ধ , এজাতীয় অপবাদ দেয়া হলে , যিনি বা যারা অপবাদ দেবেন , সেই অভিযুক্তকে তিন থেকে পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড এবং পঞ্চাশ হাজার থেকে পাঁচ লক্ষ টাকা পর্যন্ত জরিমানা ধার্য করা যেতে পারে । ডাইনি অপবাদ দিয়ে হত্যা করা হলে তার বিচার হবে ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩০২ ধারা অনুযায়ী । একই অপবাদে কারোকে আত্মহত্যায় প্ররোচিত করা অথবা বাধ্য করলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বিধান করা হতে পারে । অভিযুক্তকে ওয়ারেন্ট ছাড়াই গ্রেফতার করা যাবে এবং বিচার হবে জামিন অযোগ্য ধারায় ।
মহারাষ্ট্রে কুসংস্কার ও কালাজাদু বিরোধী আইন পাশ হয় ২০১৩ সালে । মহারাষ্ট্র অন্ধশ্রদ্ধা নির্মূল কমিটি (MANS) এর প্রতিষ্ঠাতা ডা. নরেন্দ্র দাভোলকর ২০০৩ সাল থেকে এই মর্মে আইন করার জন্য লড়াই করছিলেন । ২০১০ সালে বিলের খসড়া তৈরি করা হয় । দক্ষিণপন্থী উগ্র ধর্মান্ধ সংগঠন তাঁর এ কাজকে ধর্মবিরোধী আখ্যা দিয়ে বিরোধ করে আসছিলো , কিন্তু বাধার মুখে দমে না গিয়ে ডা. দাভোলকর তাঁর কাজ করে যাচ্ছিলেন । সমাজ থেকে কুসংস্কার দূর করে মানুষকে বিজ্ঞানমনস্ক করে তোলার এই লড়াইয়ের মূল্য জীবন দিয়ে চোকাতে হয়েছে বিজ্ঞানযোদ্ধা ডা. দাভোলকরকে । ২০১৩ সালের ২০শে আগস্ট তাঁকে গুলি করে হত্যা করা হয় । এর চারদিন পরেই পাশ হয় অর্ডিন্যান্স । ডা. নরেন্দ্র দাভোলকরের হত্যা কেবল হত্যা নয় , বিজ্ঞানাশ্রয়ী চিন্তাভাবনাকে কুসংস্কারাচ্ছন্ন ভাবধারার একটি সরাসরি হুমকি , অর্থাৎ কুসংস্কারের জাল ছিঁড়ে বেরোতে চাইলে , মানুষকে আলোর পথে নিয়ে যেতে চাইলে সে পথ রুদ্ধ করে দিতে যথাসম্ভব চেষ্টা করা হবে । সভ্যতার অগ্রগতির পথে একটি কলঙ্কজনক দাগ , ডা. দাভোলকরের হত্যা । বিজ্ঞানমনস্কতার অগ্রগতির জয়যাত্রার ইতিহাসে ডা. নরেন্দ্র দাভোলকরের নাম , তাঁর আত্মত্যাগের কথা স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে । ২০১৪ সালে সমাজে তাঁর কালজয়ী অবদানের কারণে ভারত সরকার তাঁকে মরণোত্তর পদ্মশ্রী সম্মানে ভূষিত করেন । তাঁর প্রয়াণ দিবস ২০শে আগস্ট National Science Temper Day হিসেবে পালন করা হয় ।
মহারাষ্ট্রের এই আইন অনুযায়ী , অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন বলে নিজেকে কেউ দাবী করলে ( ভূত নামানো , গর্ভস্থ শিশুর লিঙ্গ পরিবর্তন , অলৌকিক উপায়ে বন্ধ্যাত্ব দূরীকরণ ইত্যাদি ) অথবা কারোকে ডাইনি অপবাদ দিলে , মানসিক অসুস্থ কোনো ব্যক্তিকে ব্যক্তিগত স্বার্থে অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন বলে দাবি করলে , ডাইনি অপবাদ দিয়ে শারীরিক মানসিক নির্যাতন করলে ইত্যাদি - অভিযুক্ত ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের ছ'মাস থেকে সাত বছর পর্যন্ত কারাবাস এবং পাঁচ হাজার থেকে পঞ্চাশ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা হতে পারে । অভিযুক্তকে ওয়ারেন্ট ছাড়াও গ্রেফতার করা যাবে (Cognizable offence) এবং অভিযোগের বিচার হবে জামিন অযোগ্য ধারায় (Non - bailable )।
ঝাড়খণ্ডে ডাইনিশিকার বিরোধী আইন পাশ হয়েছে সবচেয়ে আগে , ঝাড়খণ্ডেই ডাইনিশিকারের ঘটনা বা ডাইনি অপবাদ দিয়ে হত্যা করার ঘটনা ঘটেছে সবচেয়ে বেশি । ঝাড়খণ্ডে ডাইনিশিকার বিরোধী আইন পাশ হয় ২০০১ সালে । এই আইনে কারোকে ডাইনি অপবাদ দিলে শাস্তি তিনমাস কারাদণ্ড ও একহাজার টাকা জরিমানা । ডাইনি অপবাদ দিয়ে নির্যাতন করলে শাস্তি ছ'মাসের কারাদণ্ড এবং দুহাজার টাকা জরিমানা । নিজেকে গুনিন হিসেবে দাবি করে , কোনো মানুষের ঘাড় থেকে ভূত নামানো বা ডাইনি ভর করেছে বলে দাবি করে তাকে সারানোর নামে কোনোধরনের শারীরিক অত্যাচার করলে শাস্তি একবছরের কারাবাস এবং দুহাজার টাকা জরিমানা ।
ছত্তিশগড় এবং উড়িষ্যাতেও ডাইনিশিকার বিরোধী আইন বা Anti Witchcraft Law রয়েছে । পশ্চিমবঙ্গেও ডাইনিশিকার বিরোধী আইন পাশ করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে । বিচারপতি প্রণবকুমার চট্টোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে এই মর্মে একটি কমিশন গঠন করা হয়েছে । ডাইনি বলে অপবাদ দিলে শাস্তিবিধান , জরিমানার পাশাপাশি ডাইনি অপবাদের শিকার মেয়েদের সমাজে ও জীবিকায় পুনর্বাসন , আদিবাসী এলাকাগুলোতে কুসংস্কার বিরোধী প্রচারাভিযান , শিক্ষার প্রসার ইত্যাদি বিষয়েও উদ্যোগ নেয়ার পরিকল্পনা করা হচ্ছে । কমিশন ডাইনি অপবাদে হত্যা এবং আত্মহত্যায় প্ররোচিত করার শাস্তি হিসেবে তিন বছরের কারাদণ্ডের প্রস্তাব করেছেন , সঙ্গে জরিমানা । জরিমানার অর্থ ডাইনি বলে কথিত ব্যক্তি অথবা তার পরিবারকে হস্তান্তর করা হবে । তবে হত্যার ক্ষেত্রে বিচার ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩০২ ধারা অনুযায়ী হলেই যথাযথ হবে বলে মনে হয় , কারণ আইন কঠোর না হলে তার প্রয়োগ অনেক সময়েই সুফল বয়ে আনেনা ।
ভারতবর্ষের মতো দেশে ডাইনিশিকারের মতো অমানবিক কুসংস্কার নির্মূল করতে গেলে কঠোর আইন প্রণয়নের পাশাপাশি প্রয়োজন শিক্ষার প্রচার ও প্রসার , প্রয়োজন বিজ্ঞানমনস্কতার প্রসার , প্রয়োজন শতাব্দীপ্রাচীন অন্ধবিশ্বাসের ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে আসা , প্রয়োজন যুক্তিবাদী মানসিকতার চর্চা । বিশেষত যেসব অনুন্নত দারিদ্র্যপীড়িত জনজাতি অধ্যুষিত অঞ্চল রয়েছে, সেসব অঞ্চলে ব্যাপকভাবে এই মর্মে সচেতনতা ও প্রচার অভিযান চালানো দরকার । যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি ঘটানোও সমূহ প্রয়োজন কারণ যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হলে প্রত্যন্ত এলাকাগুলিতে আইনের শাসন তুলনামূলক সুনিশ্চিত হবে , চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নতি হবে । জানগুরু ওঝা গুণিনদের ওপর যারা বাধ্য হয়ে নির্ভর করছেন সেইসব মানুষদের এদের ওপর থেকে নির্ভরতা কমবে অনেকাংশেই । সেইসাথে স্বাস্থ্যব্যবস্থার উন্নতিও প্রয়োজন , গ্রামীন এলাকাগুলিতে ন্যূনতম চিকিৎসাব্যবস্থা নিশ্চিত করা আশু প্রয়োজন । পিতৃতন্ত্রের রোপণ করা লিঙ্গবৈষম্যের বীজ মূল থেকে উপড়ে ফেলাও জরুরী , এর জন্য প্রাথমিক স্তর থেকে শিক্ষাব্যবস্থায় পরিবর্তন আনা জরুরী । এই সবকিছুর জন্যই তৃণমূল স্তর থেকে নীতি প্রণয়ন প্রয়োজন । সরকারী স্তরে তো বটেই , সেইসাথে প্রচারমাধ্যম বা মিডিয়াকে এবিষয়ে সক্রিয় ভূমিকা নিতে হবে । বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনকে এগিয়ে আসতে হবে । গড়ে তুলতে হবে কমিউনিটি ভিত্তিক সংগঠন বা মিশন , যেটা করে দেখিয়েছেন পদ্মশ্রী বীরুবালা রাভা । ডাইনি অপবাদের শিকার ব্যক্তিদের উদ্ধার করা , জীবিকা ও সমাজে পুনর্বাসন , ক্ষতিপূরণ দেয়া ছাড়াও সামাজিক হেনস্থার ভয়ে যাতে ডাইনি বলে চিহ্নিত ব্যক্তিকে তার পরিবার ব্রাত্য না করে দেয় সে বিষয়েও পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে । সামাজিক মাধ্যমকে হাতিয়ার করে অনলাইন অ্যাক্টিভিটির মাধ্যমেও সচেতনতা অভিযান এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে । আইনি সচেতনতামূলক শিবির আয়োজন করতে হবে প্রত্যন্ত গ্রামগুলিতে , বিভিন্ন রাজ্যে ডাইনিশিকার ও কুসংস্কার চর্চার বিরুদ্ধে কী আইন আছে এটা মানুষকে জানানো জরুরী । এলাকার স্কুল স্তরেও এবিষয়ে উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে । স্কুল কলেজভিত্তিক কুসংস্কারবিরোধী শিক্ষাশিবির বা সেমিনার আয়োজন করতে হবে । প্রত্যন্ত এলাকার শিশুদের নিয়েও করা যেতে পারে তাদের উপযোগী সচেতনতা শিবির । তারা এই ঘটনাগুলোর সাথে অনেক বেশি কানেক্টও করতে পারে । বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনকে এগিয়ে আসতে হবে মঞ্চে কুসংস্কার বিরোধী গান কবিতা নাটক পরিবেশন করে জনসচেতনতা গড়ে তোলবার কাজে । এর একটির সাথে আরেকটি অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত , কোনো একটি ক্ষেত্র ধরে এগোলে সমস্যার সমাধান সম্ভব নয় । এগোতে হবে সর্বতোভাবে , সব স্তরের মানুষকে সাথে নিয়ে , তাদের সাহায্য নিয়ে । বহু মানুষ এবং বহু সংগঠন এগিয়েও এসেছেন , আসছেন এই কাজে ।
তবে এক্ষেত্রে আশু এবং সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে ডাইনিশিকার বিরোধী কঠোর একটি কেন্দ্রীয় আইন । অপরাধ এবং সমাজ বিশেষজ্ঞরাও মনে করেন , কেন্দ্রীয় আইন থাকাটা অত্যন্ত জরুরী । কেন্দ্রীয় আইন থাকলে ডাইনিশিকারের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য ভাবে কমতে বাধ্য । বর্তমান ভারতীয় দণ্ডবিধি কেবল হত্যা করলে তার বিচার করবে , কিন্তু ডাইনি অপবাদ দিয়ে মারধর বা অন্যান্য শারীরিক নির্যাতনের কেবল সাধারণ মারধরের মতোই বিচার হয় । নিগৃহীতের যে দীর্ঘকালীন মানসিক ট্রমা , সামাজিক নিগ্রহ , আঘাত , আতঙ্ক এইগুলোর কোনো নির্দিষ্ট বা যথাযথ বিচারের অথবা কোনো ক্ষতিপূরণের যথাযথ নিদান ভারতীয় দণ্ডবিধিতে নেই । এই সুযোগে ঘটে চলেছে একের পর এক ডাইনিশিকার বা ডাইনি অপবাদ দিয়ে নিগ্রহের ঘটনা । ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর তথ্যগুলো দেখলে এটাই প্রমাণ হয় । এছাড়াও প্রচুর ঘটনার অভিযোগ নথিবদ্ধ হয়না , থেকে যায় চোখের আড়ালে । বাস্তবে প্রাপ্ত তথ্যের চেয়েও অনেক বেশি সংখ্যায় এসব ঘটনা ঘটে থাকে । অনেকক্ষেত্রে যদিওবা নির্যাতিতরা আইনের দ্বারস্থ হন , সামাজিক চাপে অভিযোগ প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হন । এবিষয়ে কেন্দ্রীয় স্তরে সুনির্দিষ্ট আইনে Non Compoundable তথা অপ্রত্যাহারযোগ্য ধারায় অভিযোগ করবার সুযোগ থাকা অত্যন্ত জরুরী , যেমন অনেক রাজ্যস্তরের আইনে রয়েছে । আমাদের দেশের বুক থেকে ডাইনিপ্রথা নামক কুসংস্কারের শেকড় সমূলে উৎপাটন করতে হলে কঠোর কেন্দ্রীয় আইন প্রণয়ন করা ছাড়া অন্য রাস্তা নেই । ভারতে ডাইনিশিকার বিরোধী কেন্দ্রীয় আইন প্রণয়ন এখন সময়ের দাবী ।
ভবিষ্যৎ পেতে চলেছে আরো ছুটনি মাহাতো , বীরুবালা রাভাদের । যারা অন্ধকারের অতলে তলিয়ে যেতে যেতেও প্রাণপণে আঁকড়ে ধরেন আলো , তাঁদের দেখানো সেই আলোয় আলোকিত হয় বহু জীবন । পেতে চলেছে নরেন্দ্র দাভোলকরদের , নষ্ট সমাজের নষ্ট প্রাণীদের হুমকির মুখেও দমে না গিয়ে , জীবন দিয়ে হলেও প্রমিথিয়াসের মতো সত্যের আগুন যাঁরা জ্বালিয়ে গিয়েছেন এবং যাবেন । এই আগুনের তাপেই একদিন পুড়ে ছাই হয়ে যাবে ডাইনিপ্রথা নামক অন্ধবিশ্বাসের শতাব্দীপ্রাচীন অভিশাপ ।