খ্যাতনামা ইংরেজ লেখক ভার্জিনিয়া উলফ বলেছিলেন, একজন নারীর চাই নিজস্ব উপার্জন এবং নিজের একটি ঘর, যদি সে রূপকথা লিখতে চায়। এই রূপকথা আসলে সবসময় কল্পকাহিনী নয়, নারীর জীবনের রূপকথা, যা সে লিখতে পারবে নিজস্ব নকশিকাঁথার স্বাধীন বুনোটে, নিজের ইচ্ছে ডানায় ভর করে। আমাদের উপমহাদেশীয় মানসিকতায় নারী শৈশবে পিতৃগৃহে, যৌবনে স্বামীগৃহে এবং বার্ধক্যে থাকে পুত্রের গৃহে। এটাই সমাজের চোখে স্বস্তির এবং শোভন।
কেবল আমাদের উপমহাদেশেই নয়, পৃথিবীব্যাপী সবখানেই নারীর নিজের ঘর পাওয়ার স্বপ্নের বিরুদ্ধে ছিলো সমাজ ও রাষ্ট্রের চোখরাঙানি। "Law of Coverture" নামের বৈষম্যমূলক আইনটি ইওরোপে বহুকাল ধরে চালু ছিলো। মূলত বিবাহিত নারীর সম্পত্তির অধিকার সংক্রান্ত এই আইনটি, কিন্তু অবিবাহিত মেয়েরাও এই আইনের জাঁতাকল থেকে রেহাই পান নি। ঊনবিংশ শতাব্দীতে এই আইনের পরিবর্তন ঘটে। Married Womens Property Act 1882, তে অনেকগুলো সংশোধনী আনার মাধ্যমে এই আইনটির পরিবর্তন ঘটানো হয় ।
এই আইন অনুযায়ী, স্ত্রী ব্যক্তিগতভাবে কোনো সম্পত্তির অধিকারী হতে পারবে না । নিজের নামে কোনো সম্পত্তি কোনো নারী আইনত কিনতেই পারবেন না। তাকে যদি সম্পত্তি কিনতেই হয়, কিনতে হবে স্বামীর নামে। এমনকি, স্বামীর সাথে যৌথভাবেও সম্পত্তির অধিকারী হতে তিনি পারবেন না, কারণ, স্বামীর সাথে তার "আইডেনটিটি" এক ও অবিচ্ছেদ্য। স্বামীর সম্পত্তি থাকলেই স্ত্রীর থাকা হলো, এই ছিলো যুক্তি। আলাদা করে বা যৌথভাবেও স্ত্রীর সম্পত্তি থাকার কোনো উপায় ছিলো না। যদিও, কার্যক্ষেত্রে, স্বামীর সম্পত্তিতেও স্ত্রীর কোনো অধিকার ছিলো না। স্বামীর মৃত্যুর পরেও না। পুত্রসন্তান বা ভাই বা অপর নিকটাত্মীয় কোনো পুরুষ সেই সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হতেন। পিতার সম্পত্তিতেও মেয়েদের অধিকার ছিলো না। এখনও ধর্মবর্ণ দেশকাল নির্বিশেষে পিতার সম্পত্তিতে নারীর অধিকার নেই। এই আইন অনুযায়ী, নারীর অধিকার ছিলো না, এমনকি কোনো ধরণের কোনো চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করার। অর্থাৎ, সম্পত্তি কারোকে কোনোভাবে ভাড়া, লিজ বা বন্ধক কোনোকিছুই দেবার অধিকারী তারা ছিলেন না। দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী লড়াই সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে অবশেষে নারীর সম্পত্তিতে আইনি অধিকার নিশ্চিত করা গিয়েছে।
একজন পুত্র পিতার সম্পত্তির অধিকার পান কেবল এটাই নয়, পিতৃগৃহে সম্পূর্ণ অধিকারের সাথে বসবাস করার সামাজিক জোর পুত্রসন্তানের রয়েছে। বাবার বাড়িতে আজীবন বাস করলেও কেউ তাকে কোনোদিন আঙুল দেখিয়ে বলবে না যে তুমি বাবার বাড়িতে কেনো পড়ে আছো স্ত্রী সন্তানসহ? চাকরি ব্যবসা যা-ই করো না কেনো তুমি সমর্থ এবং সম্পন্ন, অতএব নিজের উপার্জনের তৈরি বাড়ি কেনো তোমার নেই? অথচ কন্যাসন্তানের ক্ষেত্রে এই প্রশ্ন নিরবচ্ছিন্নভাবে সমাজ তুলে চলে। বিবাহিতা কন্যা যদি পিতৃগৃহে বাস করেন, তার জন্য সমাজের চোখ ঠারাঠারি, কটুকাটব্য ইত্যাদির কমতি হয় না । জামাই যদি শ্বশুরবাড়িতে থাকেন, রয়েছে তার জন্য ঘরজামাই উপাধি যা সমাজের চোখে গর্হিত, অসম্মানকর, তাচ্ছিল্যের পাত্র হয়ে থাকার শামিল। জামাই শ্বশুরবাড়িতে বেড়াতে আসবেন কালেভদ্রে, এটাই সমাজের চোখে সম্মানের, বসবাস নৈব নৈব চ। অথচ পুত্রের যেমন সেটি পিতৃগৃহ, কন্যারও তাইই! কিন্তু আইন যতোই কন্যাকে সম্পত্তির অধিকার দিক, বসবাসের ক্ষেত্রে দু‘জনের প্রতি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গী দুইরকম। বাবার বাড়িটি অনায়াসে ছেলের নিজের বাড়ি হয়ে উঠতে পারে, কিন্তু মেয়েটির বেলায় তা পারে না । এই প্রথাটি মজবুত করার জন্য প্রবাদ প্রবচনেরও সৃষ্টি হয়েছে -
" কথায় কথা বাড়ে , জলে বাড়ে ধান,
বাপের বাড়ি থিকলে মেয়ে বাড়ে অপমান" !
অর্থাৎ সমাজ রাষ্ট্র শাস্ত্র পরিবার সবাই তাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেবে, বিয়ে নামক বিষয়টি ঘটে গেলেই তুমি আজন্মের পরিবারটির পর, এই ঘরখানিও তোমার কাছে আজ থেকে "পরের ঘর"! অহো, কী অদ্ভুত কৌতুক, তাই না?
বিয়ের আগ পর্যন্ত পিতৃগৃহটি মেয়েদের নিজের বাড়িই থাকে, বিয়ের পরেই হয়ে যায় "বাপের বাড়ি"। নিজের বাড়ির নাম হয় শ্বশুরবাড়ি। অথচ এর কোনোটিই ঠিকঠাক মেয়েদের নিজের হয় না । স্বামী বা স্বামীর বাড়ির সাথে বনিবনা না হলে বা অত্যাচারিত হলে ফের অবধারিত ঠাঁই হয় সেই বাপের বাড়িটিই। অর্থাৎ শ্বশুরবাড়ি নামক ঘরটিও চিরস্থায়ী নয়, নিজস্ব তো নয়ই! সমাজ নামক বিষয়টির মার মেয়েরা যদি দেয়ালে পিঠ দিয়ে নেয়া শিখে যায়, অথবা দৃঢ়তার সাথে ফিরিয়ে দেয়া, এ পরিস্থিতি কিন্তু কিছুটা পাল্টায়। পিতার সম্পত্তিতে আইন যখন অধিকার নিশ্চিত করেছে, তখন কেনো নয় সেটি তার নিজের বাড়ি? ঠিক যেমনটি তার ভাইয়ের ক্ষেত্রে? অপরে কিন্তু কেউ নয় তাকে সেকথা বলার। মেয়েদের আগে টান হয়ে দাঁড়িয়ে সেকথা বলতে শেখা দরকার। বাবা মায়েরা সম্পত্তি করেন মূলত সন্তানের ভবিষ্যতের আশ্রয়ের কথা ভেবেই, সেখানে পুত্র ও কন্যা দুজনেরই সমান দাবী আছে। পুত্রের যদি নিজ অধিকারে পিতৃগৃহে থাকার মধ্যে অসম্মান না থাকে, কন্যারও নেই। অধিকার শুধু পেলেই হয় না , কখনো কখনো হাতেকলমে বুঝেও নিতে হয়।
যদি সম্ভব হয়, যত ছোটই হোক, নিজের উপার্জনে সম্পূর্ণ নিজের একটি ঘর সেতো সর্বশ্রেষ্ঠ আশ্রয়। কবি রজনীকান্তের বাবুইপাখির ঘরের মতো, কাঙ্খিত। ঘর মানে তো কেবল চারটে দেয়াল নয়, কিছু ইঁট বালি সিমেন্টের নিষ্প্রাণ খাঁচা নয়, ঘর মানে স্বপ্ন, ঘর মানে স্বাধীন ডানার উড়াল, ঘর মানে আত্মসম্মান, যেখান থেকে কেউ কখনো বলতে পারবে না বেরিয়ে যাও, বলতে পারবে না পান থেকে চুন খসলেই, ধাক্কা দিয়ে রাস্তায় বের করে দেবো, বলতে পারবে না আছো তো আমার আশ্রয়ে! নিজের অবসরমতো রূপকথা লেখা, বিশ্রাম নেয়া, বা কিছুই না করে বসে বসে কল্পনার রাজ্যে বাঁধভাঙা উড়াল .... নিজের একান্ত ঘর ছাড়া কি সত্যিই সম্ভব হয়? জীবন তো হাজার দায় হাজার দায়িত্ব হাজার শেকলে ঘিরে রেখেছে আমাদের। তবু সেই সব পেরিয়ে, নিজের ঘরের স্বপ্নের দৌড়ের ফিনিশিং টেপটা ছোঁয়ার স্বপ্নটুকু বেঁচে থাক, একদিন ছোট্ট ছোট্ট পায়ে চলতে চলতে পৌঁছে যাক সকল নারী, তার নিজস্ব ঘরে।