সোনম সাহা

শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

নেমেছে অদ্ভুত আঁধার

আমি জীবনে প্রথম শিক্ষকের হাতে মার খেয়েছিলাম ক্লাস থ্রি তে পড়ার সময়। বৃহস্পতিবার আমাদের হাফ স্কুল ছিলো, স্কুলে রওনা হবার সময় মা বললো স্কুলের সাদা জুতো জোড়া রেখে যেতে, সেগুলো মা মেজে রাখবে, তার বদলে আমি যেন কালো পিটি স্যু পরে যাই। আধা বেলারই তো ব্যাপার! মায়ের কথামতো কালো স্যু পরে স্কুলে গেলাম আর সেদিনই বেছে বেছে স্কুলে চেক করা হলো কে কে ফুল ইউনিফর্ম পরে আসেনি৷ স্ক্রিনিং এ আমিও ধরা পড়লাম এবং শাস্তি পেলাম। প্রথমে পাঁচ মিনিট হেড মিস্ট্রেসের রুমের সামনে কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকা এবং পরে দু‘হাতে দুইবার করে বেত্রাঘাত৷ আমি যতটা ব্যাথা পেয়েছিলাম, ততটাই অপমানিত হয়েছিলাম৷ শারীরিক প্রহারের শাস্তি আমি কখনো সমর্থন করি না। আজ অব্দি সেই বেত্রাঘাতের স্মৃতি আমি ভুলিনি কিন্তু আজ অব্দি কোনদিন আমার মনে হয়নি সেদিন আমি হিন্দু বলে এই শাস্তি পেয়েছিলাম। 

কলেজে যখন পড়ি, প্রায়ই এসেম্বলি হলে যাবার মুখে কিংবা পিটি ক্লাসের সময় চেক করে দেখা হতো মেয়েদের ইউনিফর্ম ঠিক আছে কী না। শুধু মাত্র জামা-পাজামা-ক্রস বেল্ট-জুতা সেই ইউনিফর্ম এর অংশ ছিলো না৷ বড় চুলে বেনী কিংবা পনি টেইল মাস্ট, চুলের গার্ডার হবে সাদা কিংবা কালো, কানে ছোট টপ কিংবা রিং ছাড়া যেকোনরকম বড় ঝোলা দুল পরা নিষিদ্ধ, হাতে ফ্যান্সি ঘড়ি, ব্রেসলেট, চুড়ি নিষিদ্ধ, লিপস্টিক, নেলপলিশ, মেকআপ সব নিষিদ্ধ, কলেজে মোবাইল আনা ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ, এমনকি বেল্টের সাথে কোমড়ে যে রুমাল গুঁজে রাখার কথা সেটা না থাকলেও ধরে নেয়া হতো, ইউনিফর্ম পরা সম্পূর্ণ হয়নি এবং সেটার জন্য শাস্তি পেতে হতো৷ আমাদের কলেজের কেউ কখনো এই কড়াকড়ি নিয়ে প্রশ্ন তোলেনি৷ 

ক্যাডেট কলেজে যারা পড়েছে বা যেকোন শৃঙ্খলা বাহিনীতে যারা কাজ করে তারাও নিশ্চয়ই স্বীকার করবে ট্রেনিং এর সময় বা ট্রেনিং এর পরেও ইউনিফর্ম সংক্রান্ত ডিসিপ্লিন কত গুরুত্বের সাথে দেখা হয় এবং সেটার অন্যথা হলে শাস্তি পেতে হয়। আশা করি, সেই কঠোর নিয়মের বেলায় কেউ কমান্ডিং অথরিটির ধর্ম পরিচয় নিয়ে প্রশ্ন তোলে না। 

কিন্তু নওগাঁর মহাদেবপুরের একটি স্কুলের শিক্ষিকা আমোদিনী পাল স্কুলের মেয়েদের ইউনিফর্ম ঠিক ভাবে পরা হয়নি বলে তাদের শাস্তি দেয়ায় এখন তার নামে অভিযোগ করা হচ্ছে যে তিনি হিজাব পরার কারণে ছাত্রীদের প্রহার করেছেন। আমোদিনী পালের ধর্মীয় পরিচয় এর দিকে ইঙ্গিত করে স্কুলে তার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ চলছে এবং এলাকাবাসী তাতে যোগ দিয়ে আগুনে ঘি ঢালছে। 

পরিস্থিতি এর মাঝেই নিয়ন্ত্রণ এর বাইরে চলে গেছে, গুজবকে সত্যি ধরে নিয়ে পত্রিকায় উস্কানিমূলক রিপোর্ট ছাপাও হয়ে গেছে। 

এটাকে কেনো গুজব বলছি তা আগে স্পষ্ট করি। বাংলাদেশে যে পরিস্থিতি চলছে, হৃদয় মন্ডল স্যারকে নিয়ে যে ঘটনা ঘটেছে এর পরে দেশের কোথাও কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এর কোন ধর্মীয় সংখ্যালঘু শিক্ষক-শিক্ষিকা মেজরিটির ধর্ম কিংবা ধর্মীয় পোশাক নিয়ে মন্তব্য করার দুঃসাহস রাখে না৷ এই বাস্তবতা যারা স্বীকার করবেন না, তারা শঠ ও মিথ্যুক। অতএব, হিজাব পরার জন্য তাদের মারা হয়েছে এটা একটা ষড়যন্ত্রমূলক মিথ্যা, এটা বুঝতে রকেট সাইন্টিস্ট হওয়া লাগে না। আমোদিনী ম্যাডামের নামের শেষে পাল পদবী না থাকলে এমনটা হতো কী? সন্দেহ আছে। 

লক্ষ্য করলে দেখবেন, বাংলাদেশের সমাজের একটা বৈশিষ্ট্য হলো, এখানে যখন একটা খারাপ কাজের চল শুরু হয় তখন সেটা চেইন ইফেক্টের মতো চলতেই থাকে। এই মুহুর্তে চলছে হিন্দু শিক্ষকদেরকে নিগ্রহ করার উৎসব। আমি জানি না এর পেছনে কোনো রাজনৈতিক এজেন্ডা আছে কী না, কিন্তু উদ্দেশ্য যাই হোক না কেনো শিক্ষকতা পেশার সাথে জড়িত ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা এই মুহুর্তে সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠির সফট টার্গেট, যারা কখনোই চায় না এদেশের হিন্দুরা শিক্ষক/চিকিৎসক/প্রকৌশলী কিংবা প্রশাসক হোক। প্রশ্ন হলো এই সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠি আসলে কারা? কোন নির্দিষ্ট রাজনৈতিক বা ধর্মীয় দল? আমার তো তা মনে হয় না৷ তারা উস্কে দেবার পর তাদের সমর্থনের ব্যাপারে দল-মত নির্বিশেষে কোনো মতানৈক্য তো দেখি না৷ সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের আমি আলোচনা করতে নিজ কানে শুনেছি যে দেশের সব সেক্টর না কী হিন্দু অধ্যুষিত! এমনকি শিক্ষক কমিউনিটির যে কিয়দংশকে সারা বছর দাবি করতে শুনি যে তারা কোনো দলের লেজুড় নন, তারা সকল বৈষম্যের বিপক্ষে; অনলাইন ও অফলাইনে তাদের নানা বিষয়ে জ্বালাময়ী বক্তব্য দিতে দেখা যায়; তাদেরকেও দেখলাম না ক্রমাগত (ধর্মীয় সংখ্যালঘু পরিচয় এর) শিক্ষক নিপীড়ন এর বিষয়ে একটি শব্দও ব্যয় করতে। এইসব নীরব দর্শকেরা (এবং তাদের নির্বাচিত ক্ষোভ) কী প্রকারান্তরে সেই সাম্প্রদায়িক শক্তির পরোক্ষ সমর্থক নন? 

একটা অদ্ভুত অন্ধকার গুমোট পরিবেশ তৈরি হয়েছে। শিক্ষক শাসন করতে পারবেন না, শিক্ষক মুক্ত আলোচনা করতে পারবেন না, শিক্ষক যৌক্তিক বিশ্লেষণ করতে পারবেন না এবং শিক্ষক তার শতভাগ দিয়ে প্রাণখুলে পড়াতেও পারবেন না। শিক্ষককে সারাক্ষণ নতজানু হয়ে থাকতে হবে তার শিক্ষার্থীদের সামনে, শিক্ষককে প্রতিটি শব্দ উচ্চারণ এর আগে ভয় পেতে হবে, উচ্ছৃঙ্খল শিক্ষার্থীদেরকে সমীহ করে চলতে হবে, সাম্প্রদায়িক শিক্ষার্থী ও সহকর্মীদের কাছে অসম্মানিত হতে হবে প্রতিনিয়ত। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে এসে এই হলো বাংলাদেশ এর রূপ৷ আপনারা যারা চুপ করে ভাবছেন এসব ঘটনা শুধু ধর্মীয় সংখ্যালঘু শিক্ষকদের সাথে হচ্ছে, আপনাদের তাতে কিছু যায় আসে না, তারা জেনে রাখেন, এই ক্যান্সার থেকে আপনারাও নিরাপদ নন। নগর পুড়িলে দেবালয় এড়ায় না৷ 

২০১৪ সালে যখন আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিই তখন নিজেকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, দেশকে আমি কী দিতে যাচ্ছি? নিজের কাছে জবাব পেয়েছিলাম; আমি এক প্রজন্মের বোধের শতমূলে স্পর্শ করে যাবো৷ প্রতিটি রাত আমি যখন পরের ক্লাসের জন্য না ঘুমিয়ে প্রস্তুতি নিই, নিজেকে তৈরি করি ক্লাসরুমে আসা সব ধরনের প্রশ্নের জন্য; তখন নিজের ক্লান্তিকে শাসন করি এই বলে যে এটাই তোমার দায়িত্ব, এটাই তোমার দেশের প্রতি ঋণ শোধ করার পথ। 

২০১৯ সালে এসে খোদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার এক ভয়াবহ অভিজ্ঞতা হলো। আমি আবিস্কার করলাম, আমার শিক্ষার্থীরা আমাকে যখন তাদের সামনে দেখে, তারা একজন শিক্ষককে নয়, তারা দেখে একজন হিন্দুকে, আমার প্রতিটা কথা এবং কাজের বিচার এই নিক্তিতেই হয়৷ ২০১৯ এর সেই ধাক্কার পর আমি আর কখনো ক্লাসে আমার শতভাগ উদ্যম দিতে পারিনি৷ যতবার ডায়াসের সামনে গেছি ততবারই সংকুচিত হয়ে গেছি, আর যতবার ঘরে ফিরেছি; নত হয়ে গেছি নিজের কাছেই। সামাজিক বিজ্ঞানের শিক্ষক হিসেবে দর্শন এবং ইতিহাস ঘিরে কোনো আলোচনা এলে স্নায়ু টানটান সতর্ক রেখে কথা বলেছি, প্রতি ক্লাসের আগে ডিসক্লেইমার দিয়ে ছাত্রদের অনুরোধ করেছি তারা যেন এসব একাডেমিক আলোচনাকে ব্যক্তিগত বিশ্বাস দিয়ে বিচার না করে। 

কিন্তু এভাবে হয় না। শিক্ষকতা এমন এক পেশা যেখানে শিক্ষককে ক্রমাগত শিখতে হয়। একজন প্রকৃত শিক্ষক নিজের জ্ঞান, নিজের দর্শন, নিজের বিশ্লেষণ তার শিক্ষার্থীদের জানিয়ে, শিক্ষার্থীদের সাথে বিভিন্ন তত্ত্ব ও উপাত্ত নিয়ে যুক্তিতর্ক করে যে আনন্দ পান তার সাথে আর কিছুর তুলনা হয় না। একজন শিক্ষক যখন তার শিক্ষার্থীদের সামনে প্রাণ খুলতে পারেন না, একজন শিক্ষককে যখন বীতস্পৃহ হতে বাধ্য করা হয়; সেই মুহুর্তে সেই শিক্ষক সত্তার মৃত্যু হয়৷ এই বাংলাদেশে আপনারা হৃদয় কৃষ্ণ মন্ডল কিংবা আমোদিনী পাল কিংবা শ্যামল কান্তি স্যারকে অসম্মান-অবমাননা-লাঞ্চনা করে আরো অসংখ্য শিক্ষককে মানসিকভাবে হত্যা করেছেন৷ আপনারা যদি মনে করে থাকেন দেশের যেকোনো ক্ষেত্রে মাত্র দশ শতাংশের থাকা না থাকায় কিছু এসে যায় না; তাহলে জেনে রাখেন মনুষ্য বর্জ্যের যে উল্লম্ফনে আপনারা এতো উৎফুল্ল, একদিন সেই কলুষিত পাকেই আপনাদের পতন হবে৷ সে দিন বেশি দূরে নয়।

1844 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।