গত ১৬ জুন ঘটনাক্রমে স্টকহোম/সুইডেন বসবাসরত দুই বাংলাদেশী বাঙ্গালির দুই সন্তানের বিয়েতে উপস্থিত হয়ে অবাক না হয়ে কোনো উপায় ছিলো না। ঘটনাটা ভেবেছিলাম কাউকেই জানাবো না কিন্তু গত এক সপ্তাহের চিন্তা ভাবনার কাছে আজ হেরে গেলাম।
প্রথমত সেই বিয়েতে বা বিয়ের অনুষ্ঠানে আমার যাবার বিন্দুমাত্র কোনো কারণই ছিলো না কিন্তু একটা অপ্রত্যাশিত ঘটনার স্বীকার হয়ে আমাকে বিয়ের অনুষ্ঠানে (প্রধানত এক রেস্টুরেন্টের লোকালে খাওয়া দাওয়ার বিষয়) যেতে হয়েছিলো।
আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু ইংল্যান্ডে বসবাসরত এবং তার ভাগ্নে (সিডনী থেকে আগত)। ইংল্যান্ডের বন্ধু তার আরেক বন্ধুকে নিয়ে এই বিয়েতে নিমন্ত্রিত ছিলো।
আমি আমার বন্ধু এবং তার ভাগ্নেকে বিয়ের অনুষ্ঠানে আমার গাড়ী করে নামিয়ে দিতে গিয়ে লৌকিকতার কারণে আমাকে সেই বিয়ের “খাবার অনুষ্ঠানে” ঢুকতে হয়েছিলো। সেই অনুষ্ঠানে ঢুকার আরও একটা কারণ ছিলো। অনুষ্ঠানের স্থান থেকে আমার বাসায় আসা যাওয়ার দুরত্ব প্রায় ১২০ কিলোমিটার। স্টকহোম শহরের উত্তরে থাকি আমি আর অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিলো স্টকহোমের দক্ষিণে।
আমার বন্ধু এবং তার ভাগ্নেকে সেই অনুষ্ঠান থেকে দ্বিতীয়বার আনতে গেলে আমাকে প্রায় ১২০ কিলোমিটার গাড়ী বেশী চালাতে হতো। এবং এই যাওয়া আসাটা বেশ সময়সাপেক্ষও ছিলো। তাই সকলের অনুরোধে আমি বন্ধুর সাথে বিয়ের তাবুতে যাবার সিদ্ধান্তটাই নিলাম। যেহেতু আমরা সবাই আমার বাসা থেকে রওয়ানা হওয়ার আগে দুপুরের খাওয়া খেয়ে নিয়েছিলাম। এই অনুষ্ঠানে আমাদের কারো জন্যই খাওয়া দাওয়ার বিষয়টা কোনো মুখ্য ঘটনা ছিলো না। তাই সবার সাথে ঢুকে পড়লাম বিয়ের খাওয়ার অনুষ্ঠানের তাবুতে। প্রবেশদ্বারের ডানে এবং বামে ঢুকার সময়ে প্রথমেই আমার এবং আমাদের চোখে পড়লো বড় করে দুইটা লেখা :
“এন্ট্রান্স ফর মেন/Entrance for men” যা ডানদিকে তীর দিয়ে দেখানো আর বামে লেখা ছিলো, “এন্ট্রান্স ফর ওমেন/Entrance for women.”
সাদা ঘন কাপড় দিয়ে রেস্টুরেন্টটাকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছিলো, যাতে করে পুরুষরা মহিলাদের দেখতে না পারে এবং মহিলারা পুরুষদের দেখতে না পারে। ধর্মের দোহাই দিয়ে পুরুষ মহিলা আলাদা করাই ছিলো মুখ্য উদ্দেশ্য এবং পাত্র পাত্রীর বাবা-মায়ের (আয়োজক) উদ্দেশ্য সম্পুর্ণভাবে সফলতা পেয়েছে নি:সন্দেহে বলা যায়।
তাছাড়াও তাবুর ভিতরে লেখা ছিলো যে, “কোনো ছবি তোলা নিষেধ”। যদিও আমি এতটাই বিপর্যস্তবোধ করছিলাম প্রথম লেখাটা দেখেই যে অন্য লেখার প্রতি নজর দেয়ার মন মানষিকতা ছিলো না। আমার বন্ধুর ভাগ্নে আমাকে বললো যে, সে “ছবি তোলা নিষেধ” লেখাটা দেখেছে। তাকে সম্পুর্ণভাবে বিশ্বাস করা ছাড়া আমার কোনো উপায় ছিলো না কারণ সেই অনুষ্ঠানে আমি স্বচক্ষে কোনো ক্যামেরাও দেখি নাই বা ক্যামেরার শব্দও শুনি নাই।
কোনো এক পরিচিত লোক এসে আমাদের টেবিলে পাশে দাড়িয়ে বললো যে, স্বামী স্ত্রী দুজনেই খুব ধার্মিক তাই এসব….।
আমি নিজে মনে মনে বললাম, ছেলের বাবার চেহারা দেখে বুঝলাম যে বাবাওতো কম ধার্মিক নন, যেরকম বিন লাদেন স্টাইল দাড়ি রেখেছেন আর কপালে কালো দাগ...। দুর্ভাগ্য যে মেয়ে বা ছেলের কোনো মাকে দেখার সুযোগ আমার হয় নাই। তাই তারা কতটুকু ধার্মিক তা আমার বুঝা হয়ে উঠে নাই কিন্তু ধারনা করতে যদিও কোনো অসুবিধা হয় নাই।
জনৈক ব্যাক্তি ছেলে/জামাইকে আমাদের টেবিলে নিয়ে এসে সকলের দোয়া চাইলেন আর বললেন “ছেলে খুব ধার্মিক”। ছেলে/জামাইয়ের চেহারা দেখে মনে হলো সে তার বাবার কার্বন কপি। অর্থাৎ লম্বা বিন লাদেন স্টাইলের মধ্যযুগীয় দাড়ি দিয়ে তার মুখায়ব বেষ্ঠিত।
ঘটনাটা একটু একটু বুঝতে শুরু করলাম। স্টকহোম/সুইডেনের বেশ ক’জন “গন্যমান্য ব্যক্তিকে” দেখলাম সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে। অনেকের সাথেই দেখা হলো এবং কুশল বিনিময় হলো। গন্যমান্য একজনকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, “ভাবী কোথায়?” তিনি হাস্যরস করে সাদা পর্দার বেড়া আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে বললেন যে, “আপনার ভাবী সেই সাদা কাপড়বেষ্ঠিত জেলখানায়”। তার কথায় আমি অট্টহাসীতে ফেটে পড়লাম। আর সেই গন্যমান্য স্টকহোমপ্রবাসী “সেক্যুলার এবং আধুনিক” ব্যক্তিবর্গ নীরবে টেবিলে বসে পর্দাসিক্ত বিয়ের খাবার উপভোগ করছিলেন...।
সুইডেন পশ্চিমবিশ্বের একটা দেশ যেখানে শতবৎসর সামাজিক এবং রাজনৈতিক সংগ্রামের মাধ্যমে পুরুষ মহিলা পার্থক্য অনেকটা দুর করতে সক্ষম হয়েছে। সুইডেন সভ্যতার আলোকে এগিয়ে চলেছে। সমাজে জেন্ডার ইকুয়ালিটি এবং সকলের খেলাখুলি অংশগ্রহণ একটা গুরুত্বপুর্ণ বিষয় কিন্তু কিছু নিও-ইম্পোর্টেড এলিমেন্ট এই নীতির বিপক্ষে নীরবে কাজ করে চলেছে।
সামাজিকভাবে পুরুষ মহিলাদের এভাবে বিয়ের অনুষ্ঠানে আলাদা করতে আমি আমার ৫৫ বছরের জীবনে জন্মভুমি বাংলাদেশেও কখনই দেখি নাই, যেখানে ৯১ শতাংশ লোক একই ধর্মে দীক্ষিত। অবাক আমি।
সুইডেনে নিরবে একটা জনসংখ্যা তাদের অচল, পুরাতন এবং অনাধুনিক ধর্মান্ধ এজেন্ডা নিয়ে কাজ করে চলেছে এতে কোনো সন্দেহ নাই। সুইডেনে আমার ৩৪ বছরের জীবন যাপন কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে দেখছি ‘হালাল খাবার’ এর জমজমাট ব্যবসা। কিছু নিউ-ইম্পোর্টেড এলিমেন্ট হালাল আর হারাম খেতে চায় তাই ব্যবসা জমজমাট হয়ে উঠেছে। ‘হালাল আর হারাম’, কোনোটাই হয়তো সমাজের জন্য এতটা ক্ষতিকর নয় যতটা জেন্ডার ইকুয়ালিটি নস্যাৎ হলে সমাজ পিছনে হাঁটতে শুরু করবে। সেদিকেই হয়তো এগোচ্ছে আমাদের সুন্দর, স্বচ্ছ এবং গনতান্ত্রিক সুইডেন।
একই গুরুত্তপূর্ণ বিষয়ে এভাবে “প্যারালাল (সমসাময়িক)” দুইটা সামাজিক স্রোত হয়তো কোনো শুভলক্ষণ নয়। কোনো সভ্য দেশ মানবিকতাকে, সমাজকে পিছনে হাঁটতে দেবে না বা দিতে পারে না। যদি তাই হয় সামাজিক সংঘর্ষ অনিবার্য।
এসব ঘটনার কারণে সবচাইতে বিপদে এদেশে আমাদের ভবিষ্যৎ, আমাদের উত্তরপুরুষের ভবিষ্যৎ। আমরা যারা হালাম হারাম পার্থক্য বুঝতে নারাজ এবং এই বিষয় আমাদের জীবনধারাকে প্রভাবিত করে না, আমরা যারা সমাজে পুরুষ মহিলা মিশ্রণে একটা সাম্য/সমান এবং ইকুয়েল সমাজে বিশ্বাস করি।
বিপদের আশংকা আমাদেরও, যদিও আমরা কোনো উগ্র ধর্মবিশ্বাসে বিশ্বাসী নই, শুধু মানুষ হিসাবে সমাজে সুন্দর জীবনের প্রত্যাশী। হালাল হারাম বুঝি না, রোজগার করে নিজের রোজগারের টাকায় খাবার কিনে খাই।
প্রশ্ন করবেন কিভাবে আমরাও বিপদগ্রস্ত হতে পারি?
উত্তর দিতে হলে বলতে হয় যে, ৮০/৯০ দশকে সুইডেনে ইমিগ্রেন্টবিরোধী রাজনৈতিক দলের কোনো চিহ্নই ছিলো না কিন্তু সুইডেনে আজ সেই ইমিগ্র্যান্টবিরোধী রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব সকলের জানা। সুইডেনের ইমিগ্রেন্টবিরোধী দল আজ দ্বিতীয় সর্ববৃহত্তম দল। সহসাই এই দল “বৃহত্তম দল” দল হতে চলেছে বলে আমার ধারনা। কারণ জনসাধারন ট্র্যাডিশনাল রাজনৈতিক দলের ভোট-হিপোক্রিসিতে খুব আর বিশ্বাস করে না।
আমরা যারা ধর্মকলুষিত সমাজ থেকে পালিয়ে গণতান্ত্রিক সমাজে শান্তিতে বসবাসের জন্য সুইডেনে এসেছিলাম, বিপদ আমাদেরও হতে পারে এই দেশে যদি ধর্মকলুষিত কিছু মানুষ আমাদের এই সত্য, সুন্দর, গনতান্ত্রিক দেশ সমাজকে ভুল পথে টানতে চায় বা টানে। এই ঘটনাটা এই পথে চলারই একটা উদাহরণ মাত্র। সেদিনের অপেক্ষায় রইলাম...।