২১ ফেব্রুয়ারি সব্যসাচী থেকে প্রকাশিত হয়েছে তসলিমা নাসরিনের নতুন কাব্যগ্রন্থ 'গল্প'। মোট ১৮৫টি কবিতা নিয়ে এই কাব্যগ্রন্থ। ১৭৬ পৃষ্টার বইটি কবিতার বিন্যাস করা হয়েছে একটানা বিরতিহীন। বইটির একেকটি কবিতা একেকটি গল্প। বইটির প্রচ্ছদ করেছেন শিল্পী কাব্য কারিম। বইটি পাওয়া যাচ্ছে অমর একুশে বইমেলায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সব্যসাচীতে। স্টল নং ৬২২ ও বাংলা একাডেমি'র বহেরাতলায় লিটলম্যাগ কর্নারের ছোটকাগজ সব্যসাচীতে। বইটির বিনিময় মূল্য ধরা হয়েছে ৩৭১ টাকা।
১৯৯৪ সাল থেকে তসলিমা নাসরিন স্বদেশ থেকে বিতাড়িত। দেশে এখনও ঝুলছে তাঁর বিরুদ্ধে ধর্মান্ধদের দেওয়া ফতোয়া। আদালতে তাঁর নামে এখনো ঝুলছে বা-স্বাধীনতা বিরোধী কুচক্রীদের ঠুকে দেওয়া অনেকগুলো মামলা। বাংলাদেশে কবি আসতে পারছেন না দীর্ঘ প্রায় দুই যুগ। সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ রয়েছে তাঁর পাঁচটি বই। সেগুলো হলো- মানবতার বিরুদ্ধে তাঁর তথ্যভিত্তিক উপন্যাস 'লজ্বা', নিজের শৈশব স্মৃতি নিয়ে 'আমার মেয়েবেলা', কৈশোর ও প্রথম যৌবনের স্মৃতি নিয়ে লেখা 'উতল হাওয়া', আত্মজীবনী তৃতীয় ও চতুর্থ খণ্ড 'ক' ও 'সেইসব অন্ধকার'।
'গল্প' কাব্যগন্থের প্রথম কবিতাটির নাম শোধ। কবিতার কয়েকটি লাইন এমন- '... গর্বে সারারাত ফুলে ছিলো লোকটার বুক। মাটিতে পা পড়েনি, তিরতির করে কেঁপেছে ত্বক, আমার ঠোঁট যেন মুক্তো, আমার স্তন যেন হীরে, আমার যোনী যেন স্বর্গদ্বার, এমনভাবে ছুঁয়েছে আমাকে। সারারাত ঘুমোয়নি লোকটা, কেবল দিয়েছে, যা চেয়েছি তার চেয়ে ঢের বেশি।...'
'একটি শ্লীল ইশতেহার' কবিতার কয়েকটি লাইন এমন- '...ও পুরুষ শোনো! তুমি দাঁড়াও তো একটু। একটু দাঁড়াও। দাঁড়িয়ে আমার শেষ কথা শুনে যাও, আমি তোমাকে চাই না, আমি তোমাকে চাই না, না, চাই না তোমাকে। তুমি দেখতে ভালো, এ তোমার কোনও গুণ নয়। তুমি কথা বলো ভালো, এও তোমার কোনও গুণ নয়। গুণ নয়, কারণ তুমি যা বলো মিথ্যে বলো।...'
'মুক্তি' কবিতার কয়েকটি লাইন এমন- '... ভুলে যেতে হলে ভুলে যাও, বাঁচি। যত মনে রাখবে, যত চাইবে আমাকে, যত কাছে আসবে, যত বলবে ভালোবাসো, তত আমি বন্দি হতে থাকবো তোমার হৃদয়ে, তোমার জালে, তোমার পায়ের তলায়, তোমার হাতের মুঠোয়, তোমার দশনখে। ভুলে যাও, মুখের রংচংগুলো ধুয়ে একটু হালকা হই, একটুখানি আমি হই।'
'আমেরিকা' কবিতার কয়েকটি লাইন এমন- 'কবে তোমার লজ্বা হবে আমেরিকা? কবে তোমার চেতন হবে আমেরিকা?কবে তোমার সন্ত্রাস বন্ধ করবে তুমি আমেরিকা?... তোমার কত সহস্র আদিবাসীকে তুমি খুন করেছো, কত খুন করেছো এল সালভাদরে, কত খুন করেছো নিকারাগুয়ায়, করেছো চিলিতে, কিউবায়, করেছো পানামায়, ইন্দোনেশিয়ায়, কোরিয়ায়, খুন করেছো ফিলিপাইনে, করেছো ইরাকে, লিবিয়ায়, মিশরে, প্যালেস্টাইনে, ভিয়েতনামে, সুদানে, আফগানিস্তানে, - মৃত্যুগুলো হিসাব করো, আমেরিকা তুমি হিসাব করো, নিজেকে ঘৃণা তরো তুমি আমেরিকা।...'
'দুঃখবতী মা' কবিতার কয়েকছত্র এমন- '... দুঃখগুলো মা'র সঙ্গে নিভৃতে কী সব কথা বলতো... কে জানে কী সব কথা।... দুঃখগুলো মা'র সাথে শেষ অবধি কবর অবধি গেছে।...'
'মুক্ত দাম্পত্য' কবিতার কয়েকছত্র এমন- 'ফুলশয্যা কাকে বলে আমি জানি। কাকে বলে সারারাত জেগে থাকা বন্দরের ভয়ানক রাত। আমি জানি, আমার হাড়-মাংস জানে, জানে বন্দরের সব ক'টি সাম্পান মাঝি, জানে কার্গোর শ্রমিক, ভোরের লঞ্চ জানে, তুমিও কি কিছু কম জানো?...তুমি মদে চুর, তুমি ঘুমে ঘোর, তবু তুমি কিছু কম জানো না, তোমাকে ভেলায় তুলে আমি বেহুলা হয়েছি কতবার কত ক্লান্ত যমুনায়। যদি জানোই, জগৎ জুড়ে এত তোমার আস্ফালন কিসের?'
'দেবদারুপুরুষ' কবিতার শেষ কয়েকটি লাইন এমন- '... ধ্বংসের আগুন তুমি ছুড়ে দাও প্লাবনের হাঁ-মুখো জঠরে। হে দেবদারুপুরুষ, তোমার প্রস্থান পথ আগলে দাঁড়িয়ে থাকি অমোঘ ইস্পাত, হলুদ লণ্ঠন তুলে নিরুচ্চার মেনে নিই চরম সন্ন্যাস।'
১৯৭৯ থেকে বর্তমান সময়কাল পর্যন্ত লেখা কবিতা 'গল্প' কাব্যগ্রন্থটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। কিছু কিছু পূর্বে প্রকাশিত কবিতাও চোখে পড়লো। তবে তসলিমা নাসরিনের কবিতার যে কণ্ঠস্বর, সেটি পাঠককে মুহূর্তে নিমগ্ন করে কবিতার অতলে, দ্রোহে, বিদ্রোহে, প্রেমে, যৌবনে, প্রতিবাদের রাজপথে, গৃহিনীর মনোজগতের তেপান্তরে, কিশোরীর ধবলবুকে কিংবা যুবকের উত্থিত লিঙ্গের শ্লেষে।
তসলিমা কবিতায় যেভাবে ঠাট্টা করেন, শ্লেষ করেন, ঘাই মারেন, তা পুরুষজাতির হাজার বছরের পৌরুষকে নিমিষে খড় বানিয়ে উড়িয়ে দেয়। নারীকে আরো আত্মপ্রত্যয় ও স্বাধীনভাবে বাঁচার যে আহবান কবিতার ছত্রেছত্রে তা পাঠককের হৃদয়ে নাড়া দেয়। এই প্রচলিত সমাজের অন্যায়, অবিচার, নির্যাতন ও পালিত আয়োজনকে তসলিমা চ্যালেঞ্জ করেন। তাঁর কবিতার সেই শক্তিকে এখনও ভয় পায় ধর্মান্ধ কাপুরুষ।
কবিতা পড়ে আত্মস্থ করার বিষয়। কবিতা নিয়ে আলোচনা এত স্বল্প পরিসরে অসম্ভব একটি কাজ। তসলিমার কবিতায় যারা অশ্লিলতা খুঁজে পান, তারা কবিতাই বোঝেন না। কবিতার শক্তি বোঝার ব্যাপারটা আরো সুদূর পরাহত। সব্যসাচী থেকে প্রকাশিত 'গল্প' কাব্যগ্রন্থের প্রত্যেকটি কবিতাই একেকটি গল্প। সেই গল্পগুলো পাঠক বুঝতে পারলে, হাজার বছরের গ্লানি হয়তো কিছুটা আবার মুখর হবে, রাজপথে, মিছিলে, চায়ের আড্ডায়, প্রেমিকযুগলের ভালোবাসায়, প্রহরীর একাকীত্বযাপনে, মানবতার বিরুদ্ধে সত্য উচ্চারণের জয়গাঁথায়।
২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৮
'গল্প' কাব্যগ্রন্থ পাঠ শেষে