তাসনুভা আনান

মানবাধিকারকর্মী, অভিনেত্রী

তৃতীয় চোখে তৃতীয় লিঙ্গ

পুরুষতান্ত্রিকতা আজ যেন গ্রাস করছে সবকিছু। ভারতীয় উপমহাদেশে বিশেষ এক শ্রেণির মানুষ ঘর ছাড়া হয়ে জীবন যাপনের জন্য বেছে নিয়েছিলো আশীর্বাদ প্রদানের এক জীবন। দিনে দিনে যার নাম দেয়া হয় হিজড়া। দলবদ্ধ এই জনগোষ্ঠীর জীবন প্রণালী সম্পর্কে ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিকসহ কম বেশি সবারই জানা। আমার কথার মূল বিষয় সেখানে নয়।

প্রথমেই মনে খটকা বা প্রশ্ন জাগলো, আমি যদি তৃতীয় লিঙ্গ হই তাহলে প্রথম লিঙ্গ কে আর দ্বিতীয় লিঙ্গই বা কে? আর এই তৃতীয় লিঙ্গ শব্দটাই বা আমার মাথার উপর চাপিয়ে দিলো কে বা কারা? জানি মনে মনে অনেক প্রশ্ন হয়তো অনেকের আসবে আবার কারোই কোনো প্রশ্ন আসবে না। যদি বলি এই তৃতীয় লিঙ্গ শব্দ তৈরি হওয়ার পেছনে অবদান আমাদের সমাজের ছোটো বড়ো সকলের। সামাজিক ও অর্থনৈতিকসহ সকল অবস্থানেই আসন সংখ্যার মান ৩। আবার কোথাও শূণ্য। যদিও তাতে কারো তেমন কিছুই আসে যায় না।

ধরুন, আমি একজন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ (সৌভাগ্য/দূরভাগ্যক্রমে), সমাজের নানান লোক বিভিন্ন প্রয়োজনের তাগিদেই কখনো পাশে থাকে, কখনো পরিচয় দেয় আবার কখনো বা রাস্তায় দেখা হলে চিনেও না চেনার এমন ভান ধরে পাশ কাটিয়ে চলে যায়, যা আগে দেখলে হয়তো খুব কষ্ট লাগতো, কিন্তু হয়তো ধারণ ক্ষমতা একটু হলেও বেড়েছে তাই এখন কষ্ট কম লাগে।

ইদানিং খুব হিড়িক পড়েছে সবাই হিজড়া/থার্ড জেন্ডার ইস্যু নিয়ে কাজ করতে চান। সারাদিনে ছোটো বড়ো, নামহীন, ছদ্ম নাম, অংশ নামের নানা সংস্থা বা গুটি কয়েক ব্যক্তি আছেন যারা কাজ করতে চান।

হয়তো ফোনে, না হয় সামনে পেলে এক গাদা পরিকল্পনা শুনিয়ে ছেড়ে দেন। পাল্টা প্রশ্ন যদি করি, এই যেমন উদ্দেশ্য কী? বা কেনো করবেন? ভবিষ্যতে কী কাজে লাগবে? কয়েকজন ব্যক্তি ছাড়া বাকি সবাই এমন ভাব করেছেন যেনো প্রশ্নটা করাই আমার ভুল ছিলো।

যাই হোক, জীবন এভাবেই চলছে, হয়তো চলবে। এর মাঝে কিছু পর্যবেক্ষণ যা আমাকে ক্ষত বিক্ষত করে চলেছে প্রতিনিয়ত, তার কিছু না বললেই নয়।

এলোমেলো করে কেটে গেছে মেয়ে ছেলে বেলা। কোনো কিছু বুঝে উঠবার আগেই কেমন যেনো সব কিছু শেষ হবার পালা। যে বয়সে আমারই সমবয়সী একটি ছেলে বা মেয়ে রাতে মা না খাইয়ে দিলে খাওয়া হয় না, সেই বয়সেই নিজের খাবারের যোগানসহ থাকার জায়গা খুঁজে মাথা গোজার ঠাঁই করতে হয়েছে। সেই সাথে পড়াশুনা। কখন যে জীবন থেকে কিশোর বয়স হারিয়ে গেলো টেরই পেলাম না। কোমল ছোট্ট একটি শিশু কখন যে বদমেজাজী, রাগী কঠোর পরিশ্রমী হয়ে উঠলো বুঝতেই পারলাম না। ঢং করে কথা বলার বয়সে কেমন যেনো বারুদ বের হয়।

যাই হোক কমিউনিটির একটি বিরাট অংশ অশিক্ষিত, কারণ তাদের পরিবার থেকে ড্রপ আউট আমার থেকেও অনেক আগে। সুতরাং তাদেরকে সঠিক দিক নির্দেশনা দেওয়া অনেক কঠিন। যে মানুষগুলোর দিন কাটে পথে পথে। একদিন পথে না নামলে খাবার জোটে না, এই সব সহজ সরল মানুষের মাথা খাবার জন্যই ভীড় করে আশে পাশে কিছু সুবিধাবাদী, ভন্ড লোক। যারা রাতারাতি নিজেকে স্টার প্রমাণ করার জন্য এই মানুষগুলোর সাথে মেশেন এবং স্বার্থ হাসিলের একটি নির্দিষ্ট সময় পর কেটে পরেন। অবশ্য যারা সত্যিকার অর্থে কাজ করেন তাদের কথা ভিন্ন। কিন্তু এই সরল মনের কমিউনিটির মানুষকে বোঝাবে কে? কিভাবে তারা বোঝে আপনি সুবিধা নিচ্ছেন জানেন? যখন আপনার /তোর/তোমার/তোদের/তোমাদের/আপনাদের কাজ ফুরিয়ে গেলে আর কোনো খবর থাকে না তখন। আর সেই ইফেক্টটা পরে কোথায় জানেন? সত্যিকার অর্থে যিনি বা যারা কাজ করতে যায় বা যান। তখন আপনি বা আপনারা শিশিরদের আবিস্কার করেন বদ মেজাজি, আক্রমণাত্মক, গা ছাড়া, অল্পতেই রেগে যায়, এছাড়া ও অনেক ইংরেজি শব্দ যা না হয় নাই বললাম।

প্রজেক্ট আসে প্রজেক্ট যায়, কিন্তু শিশিরদের ভাগ্য বদল হয় না, শিশিরদের আচরণ সংশোধনের জন্য চলে সেশন, সেশন এবং সেশন। অথচ শিশিরদের অনেক পরে জয়েন্ট করেও আজ শ্রীলঙ্কা, কাল জাপান ঘুরে বেড়ায় অনেক মানুষ। আর সারা বছর আশ্চর্য হলেও সত্যি প্রজেক্ট শেষ হয়ে যায় কিন্তু শিশিরদের আচরণ পরিবর্তন শেখানোর কার্যক্রম শেষ হয় না। হ্যাঁ একথা বলাই যায়, শিশিরদের আপনাদের প্রয়োজনে হয়তো বিশেষ কোনো ট্রেনিং বা কিছু কিছু জায়গায় পাঠান (ডোনারদের চাপে) যেখানে আপনাদের তথা কথিত পেনিস, ভ্যাজাইনার খাওয়া নাই বা ডিমান্ডই হচ্ছে একজন কমিউনিটি রিপ্রেজেন্টিটিভ।

কমিউনিটির বিশেষ বিশেষ কিছু মানুষ যাদেরকে পাওয়া যায় সুন্নতে খৎনা থেকে শুরু করে এমন কোনো প্রোগ্রাম নেই যেখানে তারা যান না। যাওয়া নিয়ে আমার কোনো প্রব্লেম নেই, কিন্তু প্রব্লেম আমার সেখানেই হয় যখন দেখি এতো বছর কাজ করেও যারা এখনো বোঝেন না কোন বয়সে, কোথায়, কোন প্রোগ্রামে কী কথা বলা উচিৎ। কোথায় যাওয়া উচিৎ। কেমন করে বুঝবেন ওই যে বিশেষ প্রয়োজন যখন দরকার পড়ে তখন হয়তো সেই ব্যক্তিটিকেই সেই সকল মানুষদের প্রয়োজন পড়ে যাদের শেখানো কথাই হয়তো বলা ছাড়া কোনো উপায় নাই।

কমিউনিটির বিশেষ কিছু মানুষ যারা সুবিধা ভোগ করে মেইন্সট্রীম মানুষের সাথে মিশে কিছু বিষয়ের নাম শিখেছেন, কিছু ট্রেনিং করেছেন। কিন্তু ট্রেনিং থেকে শেখা বিষয় না ব্যক্তিগত কাজে লাগায়, না কমিউনিটির উন্নয়নে। অনেক বড় বড় শব্দ উচ্চারণে তাদের নিবিড় মনোযোগ। কিন্তু শব্দের প্রয়োগ, কোথায় কেমন আর তা থেকে কোন বাক্য নির্মাণ সম্ভব সেটার দিকে কোনো মনোযোগ নেই।

আরেকদল মানুষ রয়েছেন, কমিউনিটির যাদের মেইন্সট্রীম মানুষের সাথে কোনো ধরনের যোগাযোগ নেই, তারা না আছে মানুষের কল্যাণে, না অকল্যাণে। কিছু স্বার্থপর, ধর্মপরায়ণ অসাধু ব্যক্তিবর্গ রয়েছেন যারা এতোটাই অসৎ যে বা যারা শুধুই নিজের কথা চিন্তা করেন, নিজেকে নিয়ে ভাবেন, কোনো পড়াশুনা তো নেই-ই, বরং উল্টা সমালোচনা আর হা হা হি হি তে লিপ্ত থাকেন, পাশের সহকর্মীদের নিজেরদের প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবেন। সেই সকল লোক কমিউনিটির কোন কাজে আসছে বা আসবে তা আমার বোধ গম্য নয়।

অসংগঠিত কমিউনিটি------ এ যেনো এক বিরাট গ্যাপ।

এতো গেল কমিউনিটির দোষের কথা। আমি আমার চাকুরী জীবনের প্রায় যে কটা সংস্থায় কাজ করেছি, কম বেশি সব কলিগদের একটা প্রশ্ন করেছি, আচ্ছা, আপনার ছেলে বা মেয়ে যদি একজন ট্রান্স বিয়ে করে বা করতে চায়, আপনি বাবা/মা হিসেবে কী করবেন? কেউ তেলেবেগুনে জ্বলে উঠেছেন, কেউ বা অনেক বাজে ভাবে কথা বলছেন, কেউ চিরদিনের জন্য কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছেন। একবার ও ভাবলেন না তাদের ঘরে অনেক ছেলে মেয়ে আছে (অপ্রকাশিত) বা হলে তখন কী করবেন? উল্লেখ্য যে অনেকেই অনেক দিন যাবৎ কমিউনিটির উন্নয়নে কাজ করে, তারা যে কী উন্নয়নে কাজ করে আসলে আজও বুঝলাম না। আসলে কথা দিয়ে হয়তো অনেক কথার ঝুড়ি বানানো যাবে, কিন্তু শোনার মানুষ কই? কমিউনিটির মানুষদের প্রতি আজ বেগম রোকেয়ার মতো বিনীত আহবানঃ জাগো গো ভগিনী।

নিজেদের ভালো মন্দ নিজেরা কবে বুঝবি, বুঝবা, বুঝবেন? এখনো কি সময় হয় নি? আর কতো? জাগ/জাগো, জাগেন এইবার। প্লিজ।

2128 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।