তিয়ান পুতুই

লেখক এবং এক্টিভিস্ট।

মেয়েরা, ভাবিয়া করিও প্রেম

একটি সতর্কবার্তা: যারা বলে যে "কোনো কাগজে সই ভালোবাসা নির্ধারণ করে না মনের মিলই আসল" তাদের থেকে যেসব মেয়েরা কমিটমেন্ট খোঁজে তাদের দূরে থাকার পরামর্শ দিচ্ছি। এরপর যদি কেউ স্বেচ্ছায় কাগজে সই না করে সম্পর্কে যায়, তারা নিজ দায়িত্বে যাবেন এবং "আমাকে তো আগে কেউ সাবধান করে নাই" বলে নাকি কান্না কাঁদবেন না।

প্রথমতঃ মনের মিল বা আকর্ষণের প্রথম ধাপে যে প্রচন্ড ব্রেইন কেমিক্যাল-এর ট্রিপ হয় এটা সাময়িক, সর্বোচ্চ দুই বছর এর আয়ু। কাগজে কলমে সই বা সোশ্যাল অব্লিগেশন না থাকলে এই সমাজের বেশীর ভাগ মানুষই ব্রেইনক্যামিকেল ট্রিপ শেষে নতুনের সন্ধানে দৌঁড়ায়। আমরা নভেলটির জন্য হার্ডওয়্যার্ড। এরপরে প্রিয় মানুষটাকে হারানোর পর ইমোশনাল ড্যামেজ খায়া প্রতারণার মামলা করতে যাওয়া আর ভিক্টিম প্লে করার চূড়ান্ত নির্বুদ্ধিতা। কিন্তু এখানে কথা আছে। বাংলাদেশের সমাজে মেয়েদের ড্যামেজটা সিরিয়াসলি বেশী হয় পশ্চিমা সমাজের চাইতে। সোশ্যালি একঘরে হয়ে যাওয়া, পরিবারের সাথে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হয়ে সামাজিক প্রোটেকশন হারায়ে ফেলে, বন্ধুবান্ধব সব হারায়ে ফেলে, অনেকে আত্মহননের পথ বেছে নিতেছে।

কেউ আত্মহত্যা করতে চাইলে তার সিদ্ধান্তের প্রতি সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা আছে আমার। কিন্তু সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে ইনফর্মড ডিসিশান নেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করি।

বিয়ে বা সম্পর্ক বলতে আমাদের সমাজের বেশীরভাগ মানুষের শারীরিক আকর্ষণজনিত কেমিক্যাল ট্রিপটাকে বোঝে। অথচ বৈবাহিক চুক্তিতে সমাজিক আর অর্থনৈতিক অনেক কিছু জড়িত থাকে। 

আমার সবচে প্রিয় টিভি সিরিজ বোস্টন লিগ্যালে দুইজন স্ট্রেইট ফ্রেন্ড বৈবাহিক সম্পর্কে জড়ায় যাতে সম্পত্তি ট্রান্সফার সহজ হয়। দুইজন আইনজীবী প্রেমে না থেকেও সম্পত্তি হস্তান্তরের জন্য বৈবাহিক সম্পর্কে জড়ায়- কারণ আইনজীবীরা লিগ্যাল ডকুমেন্ট এর গুরুত্ব বোঝে। বাচ্চাকাচ্চা হইলে তাদের ভরণপোষণ নিশ্চিতকরণের জন্য ফাইন্যান্সিয়াল সিকিওরিটি নিশ্চিত করার জন্য হলেও সামাজিক চুক্তির প্রয়োজন আছে। 

যারা বলে "কলমের সই কিছু না" তাদেরকে প্লীজ আপুরা, তৎক্ষণাৎ কলমে সই করতে বইলেন। যেটা কিছু না সেটা করতে তাদের আপত্তি থাকার কথা না। কিন্তু তারা যদি সেটায় আপত্তি করে তারমানে বুঝবেন সেটা আসলে অনেক কিছু। তার প্রতি আপনার লিগ্যাল রাইট প্রতিষ্ঠিত হবে সে চাইলেই আপনার সাথে পল্টিবাজি করতে পারবে না কাগজে কলমে সই করলে এটা সে বোঝে কিন্তু আপনি বোঝেন না এবং আপনার অজ্ঞানতার সুযোগ সে নেয়।

এখন হয়তো বলবেন- যে পল্টিবাজি করে সে প্রকৃত প্রেমিক না। অবশ্যই না, রিয়েল ওয়ার্ল্ডে প্রকৃত প্রেমিক এক্সিস্ট করে না। আইডিয়াল পৃথিবীতে যেখানে মস্তিষ্কে এন্ডরফিনের সাপ্লাই অনন্তকাল চলতে পারে সেখানে প্রকৃত প্রেমিক পাবেন অথবা অবসেসিভ লাভ ডিসঅর্ডারের ভোগা কেউ যে আপনার প্রতি অবসেসড হয়ে আপনার লাইফ পোজেসিভনেসের ঠ্যালায় জাহান্নাম করে তুলবে এমন মানুষ দুনিয়াতে পাবেন কিন্তু আমি গ্যারান্টি দিচ্ছি এরে পাইলেও চাইবেন না।

রিয়েল সম্পর্কের ডাইনামিক্স এ লিগ্যাল ডকুমেন্ট এর গুরুত্ব অপরিহার্য। এটা অনেকটা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার মতো। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়া গুটিকয়েক মানুষ স্বশিক্ষিত হয় কিন্তু একটা জনগোষ্ঠীর সংখ্যাগরিষ্ঠকে শিক্ষিত করতে চাইলে একটা স্ট্রাকচার্ড সিস্টেমের মধ্যে দিয়ে যাইতে হয়। লিগ্যাল ডকুমেন্ট ছাড়া কমিটমেন্ট মেইন্টেইন করার মতো মানুষ যে নাই তা না, তারা সংখ্যায় এত কম যে র‍্যান্ডম স্যাম্পলিং করলে আপনার ভাগ্যে সেরকম একজন পড়ার সম্ভাবনা আর লটারি জেতার সম্ভাবনা প্রায় একই। আরজ আলী মাতুব্বরের হয়তো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাগে না কিন্তু রহিম কুদ্দুসের মতো মিডিওকার মানুষ যারা সাধারণ কোনো জব করে বিশেষত্বহীন জীবন কাটায়ে মরে যায় তাদের টিকে থাকার জন্য সার্টিফিকেট এর মূল্য আছে কারণ আর কোনো উপায়ে তারা নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণ করতে সক্ষম না এবং একটা পপুলেশনে এদের সংখ্যাটাই বেশী।

লিগ্যাল রাইট থাকলে বহু মানুষ ভয়ে পল্টি খাবে না, খাইলেও লুকায় ছাপায়ে খাবে, কেননা সমাজের কাছে তার দায়বদ্ধতা আছে। এই যে "লুকায় ছাপায়া" ব্যাপারটায় আপনাদের হয়তো ভন্ডামি লাগবে কিন্তু এটা বহু মানুষের কাছে প্রেফারেবল, উদ্ধত হয়ে কারুর অনুভূতির তোয়াক্কা না করে "আমি যা ইচ্ছা করবো পারলে ঠ্যাকা" এটিটিউট প্রদর্শন করে আপনার চোখের সামনে পল্টিবাজি করার থেকে। 

একটা সাইকোলজিক্যাল এক্সপেরিমেন্ট এর কথা বলি দুইটা ঘরে তিরিশজন করে লোক নিছে, এক ঘরে কোনো আসবাব নাই আরেক ঘরে টেবিলের উপ্রে ব্রিফকেইস আর ল্যাপটপ আছে। দুই ঘরের মানুষকে তাদের প্রেফারেবল পেশা লিখতে বলছে। যে ঘরে ব্রিফকেইস আর ল্যাপটপ রাখা হইছে সেই ঘরের মানুষ মোটাদাগে কর্পোরেট জবের কথা উল্লেখ করছে আর যে ঘরে কোনো আসবাব নাই তাদের জবে অনেক ভ্যারিয়েশন উপস্থিত ছিলো। একটা ব্রিফকেইস আর একটা ল্যাপটপের উপস্থিতি যদি মানুষের মনে প্রভাব ফেলতে পারে একটা সামাজিক চুক্তি যেখানে পরিবার সমাজ সব ইনভলভড সেটা আরও বেশী প্রভাব ফেলতে পারে।

সুতরাং "একটা সিগনেচার আমাদের ভালোবাসাকে নির্ধারণ করতে পারে না" বলে যারা সম্পর্কে যেতে চায় তাদের সাথে আপনি কোনো লিগ্যাল ডকুমেন্ট ছাড়া সম্পর্কে জড়ানোর অর্থ তাকে সকল প্রকার রেস্পন্সিবিলিটি থেকে অব্যাহতি দেওয়া। আপনার যদি সামাজিক অবস্থান দৃঢ় হয় অর্থ প্রতিপত্তি থাকে বা একগাদা সাপোর্টিভ বন্ধু থাকে তাহলে ড্যামেজ সামলায়ে উঠতে পারবেন কিন্তু এগুলার কোনো কিছু না থাকলে ড্যামেজ কন্ট্রোল করতে পারার সম্ভাবনা কম, এবং বহু সোশ্যাল স্ক্রুটিনি আর জাজমেন্ট এর মধ্যে দিয়ে যেতে হবে এবং ফেসবুকে বড়ো বড়ো কথা বলা এক্টিভিস্টদের অধিকাংশই আপনার পাশে দাঁড়াবে না। বাংলাদেশে মোট সুইসাইড এর মধ্যে ৮৫ শতাংশ মেয়ে যাদের আবার অধিকাংশই অবিবাহিত, এইজন্য আমি দুঃশ্চিন্তাগ্রস্ত।

সুতরাং আপনি যদি সব কিছু জেনে বুঝে অনিশ্চয়তাকে আলিঙ্গন করতে চান, করেন। আবেগে গা ভাসায়ে পরে প্রতারিত হয়ে ধর্ষণের মামলা করে নিজেকে হাস্যরসের বস্তু বানানোর আগে এই বিষয়গুলা জেনে রাখা উচিৎ। আপনার জীবন আপনার, এই জীবনে আপনি কতোটুকু ঝুঁকি নিবেন আপনার ব্যাপার। কিন্তু ঝুঁকি নেওয়ার আগে জেনে বুঝে নিন, নয়তো আপনার সিদ্ধান্ত আর গ্রামের যেসব লোকেরা কোরান শরীফে কসম কাইটা ভোট দিতে যায় তাদের সিদ্ধান্তে কোনো ফারাক নাই।

2049 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।